- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৮ অক্টোবর ২০২২, ০৯:২৩, আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২২, ০৯:২৫
বাংলাদেশের দক্ষিণে পায়রা সমুদ্র বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসব প্রকল্প বাবদ মোট খরচ ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৭২ কোটি টাকা। যার পুরোটাই বাংলাদেশের রিজার্ভের টাকা দিয়ে তৈরি করা তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যার নাম ‘বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল’।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদেশী অর্থায়নে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এজন্য রিজার্ভের টাকা দিয়ে এই বন্দরের কাজ কাজ শুরু করা হচ্ছে। এতে ঘরের টাকা ঘরেই থাকবে।’
আগামী ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে এবং এর ফলে বন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
তবে এই পায়রা বন্দর থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে বন্দরের নাব্যতা ধরে রাখতে দেশের বৃহত্তর ক্যাপিটাল ড্রেজিং।
এই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে রাবনাবাদ বন্দরে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ১০০ থেকে ১২৫ মিটার প্রশস্ত এবং ১০.৫ মিটার গভীর চ্যানেল নির্মাণ কাজ এগিয়ে নেয়া হবে।
এতে বন্দরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিকটন কার্গো বহনকারী জাহাজ ভিড়তে পারবে।
উন্নয়ন প্রকল্পে আরো রয়েছে আটটি জাহাজের নির্মাণ কাজ। এর মধ্যে সাতটি জাহাজ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে তৈরি। এই জাহাজ দিয়ে পায়রা বন্দরে এককভাবে বিদেশী জাহাজ হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করা হবে।
এছাড়া নির্মাণ হবে ৬৫০ মিটার দীর্ঘ প্রথম টার্মিনাল যাতে ২০০ মিটারের ৩টি জাহাজ একসাথে ভিড়তে পারে। একইসাথে কন্টেইনারাইজড কার্গো ও বাল্ক কার্গো হ্যান্ডেল করা যাবে।
পায়রা বন্দরে এতোদিন নিজস্ব টার্মিনাল ছিল না। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিদেশি জাহাজ এই টার্মিনালে মাল খালাস করতে পারবে, তারপর সেগুলো বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাবে, রফতানির কাজও হবে এই টার্মিনাল থেকে।
জাহাজ থেকে খালাস হওয়া পণ্য পরিবহনের জন্য ছয় লেনের সংযোগ সড়ক ও আন্ধারমানিক নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ কাজও চলবে।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে এবং মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ অনেকটা নিরসন করা যাবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটার একপাশে মংলা আর এক পাশে চট্টগ্রাম বন্দর। তাই পায়রা বন্দরের আলাদা গুরুত্ব আছে। এর সাথে বিভিন্ন বন্দরগুলোর যোগাযোগ বাড়াবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক করিডোরের সাথে সংযুক্ত হবে। ভারত, ভুটান, নেপাল সবাই এটি ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারবে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে। নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন হবে, পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে। বহু কর্মসংস্থান হবে।’
আর্থিক দিক থেকে লাভবান না হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত খরচের কারণে গত বছর পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছিল সরকার। তবে এবার পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দরে উন্নীত করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে সামগ্রিক বাণিজ্যের ৯২% সমুদ্র বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। দেশটির আমদানি রফতানি খাতে গতি আনতে পায়রা বন্দর বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভৌগোলিকভাবে পায়রা বন্দরের অবস্থান এমন এক জায়গায় যেখানে নদীর পানি সমুদ্রে পড়ার আগে প্রচুর পলি ফেলে যায়। এছাড়া নিয়মিত জোয়ার-ভাটা ও ঝড়ের কারণে পলি পড়ে।
পায়রা বন্দরের পলি নিয়ে ২০১৯ সালে সমীক্ষা চালায় জার্মানি, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের পাঁচজন গবেষকের একটি দল।
তারা জানান, হিমালয় থেকে বছরে ১১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে।
এর মধ্যে পায়রা নদীর ওই চ্যানেলের আশপাশের এলাকায় বছরে ৪০ কোটি কিউবিক মিটার পলি জমা হয়।
এখানে সমুদ্রবন্দর করলে তা নিয়মিত চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
এমন অবস্থায় বন্দর চালু রাখতে প্রতিবছর ড্রেজিং করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এই প্রক্রিয়া বেশ ব্যয়বহুল।
ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কোন চ্যানেল একবার ভরাট হয়ে গেলে সেটি খনন করতে খরচ পড়ে আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। যদিও পায়রা বন্দরে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে বাজেট ধরা হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা।
এ ব্যাপারে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব সোহরাব হোসেন জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্রকল্প কাজ শেষ হবে এবং বন্দর পুরোপুরি চালু হলে নিজস্ব আয়ের মাধ্যমে এই রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পায়রা বন্দরটি পুরোপুরি অপারেশনে আসবে বলে আশা করছি। তবে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলবে। তারপর যে পলি পড়বে সেটা নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বন্দর চালু রাখা হবে। যখন এই জেটিতে বিদেশি জাহাজ আসা যাওয়া করবে তখন পায়রা বন্দরের নিজস্ব ইনকাম বাড়বে। নিজস্ব ইনকাম থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা যাবে।’
এই বন্দর চালু হলে বাণিজ্যের প্রসার দিন দিন বাড়বে। বন্দর-কেন্দ্রিক শিল্প গড়ে উঠবে। শুরুর দিকে এই বন্দর তেমন একটা লাভ না করলেও বন্দরটি বিদেশে পরিচিতি পাওয়ার পর বন্দর-কেন্দ্রিক কার্যক্রম বাড়বে।
ফলে খুব দ্রুত এটি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে এবং এই লাভের টাকা রক্ষণাবেক্ষনের কাজে ব্যয় করা হবে বলে তিনি জানান।
এর তিন বছর পর ২০১৬ সালের ১৩ অগাষ্ট সমুদ্র বন্দরটিতে প্রথমবারের মতো কন্টেইনার জাহাজ খালাসের মাধ্যমে শুরু হয় অপারেশনাল কার্যক্রম।
প্রাথমিকভাবে বহিঃনোঙ্গরে ক্লিংকার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনা ও লাইটারেজ কার্যক্রমের মাধ্যমে সীমিত আকারে বন্দরটি চালু রয়েছে।
এই বন্দরটি শুরুতে কক্সবাজারে সোনাদিয়ায় করার কথা থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় সেটা পায়রায় স্থানান্তর করা হয়।
তারপর থেকেই এই বন্দর থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
পায়রা বন্দরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর এখন পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় বছরে ২৬০টি জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে এবং রাজস্ব আয় হয়েছে ৬১৩ কোটি টাকা।
এমন বাস্তবতায় পুনরায় রিজার্ভের এতো বিপুল পরিমাণ টাকা এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করা কতোটা লাভজনক হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি জানান, যে রাজনৈতিক বিবেচনায় সোনাদিয়া থেকে সরিয়ে বন্দরটি পায়রায় আনা হল, সেই দেশগুলো এখন আবার মাতারবাড়ি বন্দরের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। এইভাবে বার বার গোলপোস্ট শিফট হওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ব্যয় হচ্ছে, সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, রিজার্ভের অর্থ বিফলে যাচ্ছে।
যে ব্যয়টি হতে যাচ্ছে বা সামনে যে ব্যয় অব্যাহত থাকবে নাব্যতা ধরে রাখার জন্য সেই ব্যয় কতোটা যৌক্তিক হবে সেটা সরকারের বিবেচনায় রাখা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য অর্থাৎ ভারত, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে এসব বন্দরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে এই দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সহযোগিতায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ কারণে ব্যাপকভাবে আঞ্চলিক বাণিজ্যের যে আশা করা হচ্ছে সেই আশা কম বলে আশঙ্কা করছেন মোয়াজ্জেম।
আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ এই বন্দর কতোটা ব্যবহার করবে অর্থাৎ আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে বাংলাদেশে কতোটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেটার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিশেষ করে নেপাল ও ভুটান তৃতীয় দেশের সাথে বাংলাদেশের মাধ্যমে কতোটা বাণিজ্য করতে পারবে, ভারতের বাণিজ্যের কতোটুকু অংশ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে হবে, বাংলাদেশের এই বন্দরগুলো চীনের ব্যবহার করার সম্ভাব্যতা কতোটা রয়েছে- এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সেইসাথে এই বন্দরকে নাব্য রাখতে রক্ষণাবেক্ষণে যে ব্যয় হবে, সরকারের তার জন্য আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে কিনা সেটা যাচাই করার ওপরও জোর দেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি