বড় কাটরা ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়, শিলালিপির সন্ধান

বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রক্ষিত ‘বড় কাটরা উত্তর গেটে’র শিলালিপি। ডানে শিলালিপিটি থেকে উদ্ধার করা লেখার পুরো অংশ। ছবি: তরুন সরকার

মুঘল প্রাসাদ ভবন বড় কাটরার মালিকানা সংক্রান্ত দলিল ‘বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপি’র সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় ৭০ বছর ধরে একাডেমিক মহলে শিলালিপিটি নিখোঁজ বলেই ধারণা ছিল।

প্রাচীন তাম্রশাসন ও শিলালিপি নিয়ে গবেষণারত সংগঠন ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি সম্প্রতি শনাক্ত করেছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে ‘বড় কাটরার শিলালিপি’ বলে রক্ষিত শিলালিপিটিই ‘বড় কাটরা উত্তর গেটে’র।

বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপিটিতে ভবন ও ভবন সংলগ্ন ২২টি দোকান ওয়াকফ করার কথা উল্লেখ আছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে বড় কাটরার দখলকারীরা নিজেদেরকে বড় কাটরার স্বত্বাধিকারী বলে দাবি করে আসছেন।

ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপিটি ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে লেখক, গবেষক ও প্রত্নসম্পদ সংগ্রাহক হাকিম হাবিবুর রহমানের সংগ্রহে ছিল। তবে শিলালিপিটি মিউজিয়ামকে দান করার আগে সংগ্রহে থাকার বিষয়টি কোথাও প্রকাশ করেননি তিনি ও তার ছেলে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রক্ষিত বড় কাটরার উত্তর গেটের শিলালিপিটি বর্তমানে খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থায় আছে। ২টি কাঠের ফ্রেমে খণ্ড-বিখণ্ড টুকরাগুলো বিন্যস্ত করে রাখা হয়েছে। ফলে শিলালিপিটি এখন পাঠ করা যায় না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কমিটি ঢাকার প্রাচীন শিলালিপি নিয়ে গবেষণা কাজের অংশ হিসেবে বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপিটি শনাক্ত করেছে। বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত ও একাডেমিক মহলে নিখোঁজ বলে প্রচলিত বড় কাটরার উত্তর গেটের শিলালিপিসহ ঢাকার ৪টি শিলালিপি শনাক্ত করা হয়েছে। কমিটি ইতোপূর্বে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত সুলতানি আমলের মান্ডা মসজিদের শিলালিপিটির মসজিদস্থল শনাক্ত করেছিল। মান্ডা মসজিদের শিলালিপিটির অপর পিঠে রয়েছে একটি মূর্তির ভগ্ন অংশ। মান্ডা মসজিদের শিলালিপিটি ঢাকা শহরের হাজার বছরের নগরায়নের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। এ ছাড়া, কমিটি খুলনা বিভাগীয় মিউজিয়ামে পুরাণ ঢাকার মসজিদের শিলালিপি বলে রক্ষিত সিংটোলা বিবি যামিনা মসজিদ ও লালবাগ শাহী মসজিদের শিলালিপি শনাক্ত করেছে।’

অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জানান, এই কমিটি ঢাকার শিলালিপি বিষয়ে জরিপ চালিয়ে ২০১০ সালে প্রকাশ করেছিল ‘ঢাকার শিলালিপি’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদন। ঢাকার নিখোঁজ শিলালিপি বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১৩ সালে প্রকাশ করেছিল ‘ঢাকার নিখোঁজ শিলালিপি’ শীর্ষক প্রতিবেদন।

এরপর কমিটি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত ঢাকার শিলালিপি বিষয়ে গবেষণা চালায় এবং ঢাকার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি শিলালিপি শনাক্ত করেছে। আরবি-ফারসি-উর্দু শিলালিপি পাঠ ও অনুবাদ কাজের অন্যতম সম্পাদক মওলানা মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহপুরীর নেতৃত্বে একদল প্রবীণ ও তরুণ গবেষক বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত বড় কাটরার উত্তর গেটের শিলালিপিসহ ঢাকার অশনাক্তকৃত বিভিন্ন শিলালিপি শনাক্তকরণের কাজ করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, বড় কাটরায় ২টি শিলালিপি ছিল। একটি নির্মাণের ও অপরটি ভবনটি ওয়াকফ করা বিষয়ক। ১০৫৩ হিজরি বা ১৬৪৩-৪৪ সালে তৎকালীন সুবেদার শাহ শুজার নির্দেশে আবুল কাশেম ভবনটি নির্মাণ করেন এবং ১০৫৫ হিজরি বা ১৬৪৫-৪৬ সালে ভবনটি ওয়াকফ করা হয়।

১৮৭০ সালে তোলা বড় কাটরার একটি ছবি। ছবি: সংগৃহীত

নির্মাণের শিলালিপিটি লিপিকলার নাস্তালিক রীতিতে পদ্যে লেখা। এতে ১৮টি লাইন রয়েছে। ১৮টি পৃথক আয়তাকার কালো পাথরে উৎকীর্ণ শিলালিপিটি স্থাপন করা আছে দক্ষিণ গেটের গম্বুজের নিচে চারপাশে। অন্যদিকে বড় কাটরার উত্তর গেটের দেয়ালে স্থাপন করা শিলালিপিটি লেখা হয়েছে গদ্যে, তুঘরা রীতিতে। ভবনটির নির্মাতা হিসেবে দক্ষিণ গেটের শিলালিপিতে আবুল কাশেম ও উত্তর গেটের শিলালিপিতে আবুল কাশেম আল হোসাইনী আত্তাবাতাবায়ী আসসেমনানী নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

গবেষকদের ধারণা, বড় কাটরার দক্ষিণ গেটের শিলালিপিতে উল্লিখিত আবুল কাশেম ও উত্তর গেটের শিলালিপিতে উল্লিখিত আবুল কাশেম আল হোসাইনী আত্তাবাতাবায়ী আসসেমনানী একই ব্যক্তি।

১৮২২ সালে প্রকাশিত চার্লস ডয়লীর ‘এন্টিকুইটিস অব ঢাকা’ গ্রন্থে বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপির প্রতিলিপি ও অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয়। ফারসি ভাষায় লেখা শিলালিপিতে উল্লেখ আছে, ‘সুলতান শাহ শুজা বাহাদুর সৎকাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। বিশেষ করে আল্লাহর রহমতের আশাবাদী আবুল কাসেম আল হোসাইনী আত্তাবাতাবায়ী আসসেমনানী এ পবিত্র স্থানটি ও তার সাথে সংলগ্ন ২২টি দোকান ওয়াকফ করেন। এবং ধর্মীয় বিধান মতে, শর্তারোপ করেন যে, এর পরিচালক যেন এর প্রাপ্ত আয় দ্বারা এগুলোর সংস্কার ও দরিদ্রদের জন্য ব্যয় করতে পারেন। যদি কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি (এখানে) আগমন করেন, তাহলে তার থেকে কোনো ভাড়া নিতে পারবেন না— যেন তিনি এর প্রতিদান হিসেবের দিনে প্রাপ্ত হন এবং যিনি এটি লঙ্ঘন করবেন, তিনি হিসাবের দিনে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবেন। এর উৎকীর্ণকারী সা’দুদ্দিন ১০৫৫ মোহাম্মদী সনে।’ (অনুবাদ: মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহপুরী।)

বাংলাদেশের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ মুঘল স্থাপনা বড় কাটরার দক্ষিণ গেট এখনো মোটামুটি অটুট আছে। কিন্তু উত্তর গেট অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় কাটরার উত্তর গেটসহ উত্তর ব্লক সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। মুনশি রহমান আলী তায়েশের ১৯১০ সালে প্রকাশিত ‘তাওয়ারীখে ঢাকা’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, উত্তর গেট তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে ধ্বংসপ্রাপ্ত উত্তর গেটের শিলালিপিটি কোথায় তখন ছিল, এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই ‘তাওয়ারীখে ঢাকা’য়।

সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা’ গ্রন্থে বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপি নিখোঁজ বলে উল্লেখ করা হয়। সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরকে উদ্ধৃত করে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ড. আবদুল করিমের ‘কর্পাস অব দ্য অ্যারাবিক অ্যান্ড পার্সিয়ান ইন্সক্রিপশন্স অব বেঙ্গল’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন গ্রন্থে বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপিটি নিখোঁজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বড় কাটরার উত্তর গেট। ছবি: প্রবীর দাশ

অন্যদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রক্ষিত ‘বড় কাটরার শিলালিপি’ নামে শিলালিপিটি পাঠ করতে না পারায় রক্ষিত শিলালিপিটি বিষয়ে বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত ছিলেন জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ও গবেষকরা।

ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি সূত্র জানায়, তারা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত ঢাকার শিলালিপি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রক্ষিত ঢাকার শিলালিপিগুলোর নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা এবং ‘বড় কাটরা শিলালিপি’র নথিতে উল্লিখিত দাতার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি নিশ্চিত হয় যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রক্ষিত ‘বড় কাটরার শিলালিপি’ বলে উল্লিখিত শিলালিপিটি বড় কাটরা উত্তর গেটের এবং  ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে হাকিম হাবিবুর রহমানের সংগ্রহে ছিল এটি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির আরবি, ফারসি ও উর্দু শিলালিপি পাঠ ও অনুবাদ সম্পাদনা পরিষদের অন্যতম সদস্য মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহপুরী বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রক্ষিত বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপির খণ্ড-বিখণ্ড টুকরাগুলো লেখার ক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত করে রাখা হলে শিলালিপিটি আবারো পাঠযোগ্য হয়ে উঠবে।

জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত রেকর্ড অনুযায়ী, শিলালিপিটি হাকিম ইরতিজার রহমান খান ১৯৬৭ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামকে দান করেন। মিউজিয়ামের নথিতে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী,  শিলালিপিটি গ্রহণ করার সময় ১২টি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। শিলালিপিটি কিভাবে এবং কখন খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় সে বিষয়ে জাতীয় জাদুঘর, ইরতিজার রহমান খানের পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি স্থানে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

হাকিম ইরতিজার রহমান খান কবে বা কোথায় থেকে এই শিলালিপিটি সংগ্রহ করেছিলেন, এ তথ্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে নেই। হাকিম ইরতিজার রহমান খান ছিলেন লেখক, গবেষক ও প্রত্নসম্পদ সংগ্রাহক হাকিম হাবিবুর রহমানের বড় ছেলে। হাকিম ইরতিজার রহমান ১৯৮০ সালের ৩০ জুলাই মারাযান।

ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি ২০১৫ সালে ইরতিজার রহমান খানের ছেলে চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তখন মাহফুজুর রহমান খান জানিয়েছিলেন, শিলালিপিটি সংগ্রহ করেছিলেন তার দাদা হাকিম হাবিবুর রহমান। তার দাদা হাকিম হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে পিতা হাকিম ইরতিজার রহমান খান শিলালিপিটি পেয়েছিলেন। তবে বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপিটি কবে এবং কোথায় থেকে হাকিম হাবিবুর রহমান সংগ্রহ করেছিলেন সেই বিষয়ে কোনো তথ্য হাকিম হাবিবুর রহমানের উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকা মিউজিয়াম তথা বর্তমান বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামকে প্রাচীন মুদ্রা ও কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামকে ঢাকার চকবাজারের শিলালিপি দান করেছিলেন। হাকিম হাবিবুর রহমান রচনা করেছেন ‘আসুদগানে ঢাকা’, ‘ঢাকা পচাশ বারস পহেলে’সহ ঢাকা বিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ। তবে হাকিম হাবিবুর রহমান কোনো গ্রন্থে বা কোনো গবেষকের কাছে উত্তর গেটের শিলালিপিটি তার সংগ্রহে থাকার বিষয়টি কখনো উল্লেখ করেছেন বলে জানা যায় না।

বড় কাটরার একটি অংশ এখন মাদরাসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ছবি: প্রবীর দাশ

বড় কাটরা উত্তর গেটের শিলালিপি ও চকবাজারের শিলালিপি ছাড়া ঢাকার অন্য কোনো স্থাপনার শিলালিপি তার সংগ্রহে ছিল কি না, এ বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ঢাকা গবেষক হাশেম সূফীর মতে, দোলাই তীরবর্তী রোকনপুর মহল্লার রোকন চিশতীর মাযারের শিলালিপিটি রোকনপুর থেকে সংগ্রহ করেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। রোকন চিশতীর মাযারের শিলালিপিটি এখন নিখোঁজ।

হাশেম সূফী আরও বলেন, ‘হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাচীন শিলালিপি সংগ্রহ করেছেন। সংগৃহীত শিলালিপি মিউজিয়ামকে দানও করেছেন। হাকিম হাবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তার ছেলে বড় কাটরার খণ্ড-বিখণ্ড শিলালিপি জাদুঘরকে দান করেছেন। শুধু বড় কাটরার উত্তর গেটের খণ্ড-বিখণ্ড শিলালিপি নয়, ঢাকার আরও শিলালিপি হাকিম হাবিবুর রহমানের সংগ্রহে ছিল বলে আমার ধারণা।’

বুড়িগঙ্গা নদী ও চকবাজারের মাঝখানে ছিল বড় কাটরার অবস্থান। নির্মাণের পর ৩ শতাধিক বছর বড় কাটরার দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো বুড়িগঙ্গা। বিগত খ্রিষ্টীয় শতকের আশির দশকের শেষভাগে ঢাকা রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করায় বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বড় কাটরা থেকে দূরে সরে গেছে। এরপর বড় কাটরা থেকে বাঁধ পর্যন্ত বসতি গড়ে উঠেছে। বর্তমান চকবাজার থানায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বড় কাটরা লেনে বাংলাদেশের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ মুঘল স্থাপত্য বড় কাটরার অবস্থান। বর্তমানে বড় কাটরার দক্ষিণ গেট থেকে উত্তর গেট পর্যন্ত সড়কটির নাম বড় কাটরা লেন। বড় কাটরা সংলগ্ন পশ্চিম দিকে দেবীদাস ঘাট লেন এবং পূর্ব দিকে সোয়ারীঘাট লেন। বড় কাটরার উত্তর দিকে রয়েছে চক সার্কুলার রোড।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, সুবেদার শাহ শুজার প্রাসাদ হিসেবে এই ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রাসাদ হিসেবে পছন্দ না হওয়ায় শাহ সুজা এই প্রাসাদ আবুল কাশেমকে দান করেন। আবুল কাশেম এটিকে সরাইখানায় পরিণত করেন।

বড় কাটরায় মুঘল রাজকীয় স্থাপত্য রীতির সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একটি আয়তাকার উন্মুক্ত চত্বরের চারপাশে উপরে ও নিচে ভবনটিতে রয়েছে অসংখ্য কক্ষ। ভবনের সামনের দিক ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে ছিল ২টি প্রধান প্রবেশপথ।

এ ছাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছোট ছোট ২টি প্রবেশপথ ছিল, দক্ষিণ দিকে ৩তলা বিশিষ্ট প্রবেশদ্বার। ভবনের বাকি অংশ দোতলা।  ভবনটির দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব দিকের অংশ কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। উত্তর দিক সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে গড়ে উঠেছে নতুন দালান।

মুঘল আমলে ভবনটি মুসাফির ও ব্যবসায়ীদের সরাইখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন আমলে ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হয়েছে। এখানে ঢাকার সুবেদারদের অনেকে বাস করতেন। নিমতলী প্রাসাদ নির্মাণের আগে ঢাকার নবাবরা এখানে বসবাস করেছেন। পরবর্তীকালে ছিন্নমূল মানুষ এখানে বসবাস করতেন। বর্তমানে ভবনটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ মাদ্রাসা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশ প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। দোকান, কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি আদি কাঠামো  ভেঙে ফেলা এবং নতুন দালানও নির্মাণ করছে দখলদাররা।

বড় কাটরার দক্ষিণ গেট। ছবি: প্রবীর দাশ

গত জুলাইয়ে বড় কাটরার একটি অংশ ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করে এক দখলদার। গত ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পুলিশসহ এসে বড় কাটরার ভাঙার কাজ বন্ধ করেন। এরপর সেপ্টেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস বড় কাটরা ও ছোট কাটরা পরিদর্শন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিত, স্থাপত্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমদ প্রমুখ।

মেয়র তাপস উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘বড় কাটরা সরকারের হাতেই ন্যস্ত হওয়ার কথা। হয় জেলা প্রশাসনের কাছে ন্যস্ত হবে, না হলে সিটি করপোরেশনের কাছে ন্যস্ত হবে। আর তা না হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বা গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত হবে। এটা সরকারের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি সংস্থার অবহেলা বা নজর না দেওয়ায় এটা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এটা দখল করেছে, ভেঙে ফেলেছে, নষ্ট করেছে। আমরা আর নষ্ট করতে দিবো না। পুরোটা নিয়েই এটা পূর্ণ সংস্কার ও সংরক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেবো।’

এ ব্যাপারে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘একক ভবন হিসেবে বাংলাদেশে বৃহত্তম মুঘল স্থাপনা বড় কাটরা ও ছোট কাটরা আমাদের জাতীয় সম্পদ, ঐতিহাসিক সম্পদ। এটা নষ্ট বা বিনষ্ট করা উচিৎ না। আধুনিকায়নের নামে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা ঠিক হবে না। বড় কাটরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষার জন্য স্থপতি ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় রক্ষণবেক্ষণের কাজ বিশেষজ্ঞ কমিটিকে দেওয়া যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কমিটি মনে করে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের বড় কাটরা ও ছোট কাটরা পরিদর্শন একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। বড় কাটরা ও ছোট কাটরা পরিদর্শনকালে মেয়র যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা উচিৎ।’

‘ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে এবং রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লা ও সড়কের নামকরণের ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়ে যৌথ গবেষণার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে শুধু ৪০০ বছরের নয়, ঢাকার হাজার বছরের ইতিহাস উন্মোচিত হবে’, যোগ করেন তিনি।

স্থাপত্য ইতিহাসবিদ ও ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির শিলালিপি বিষয়ক প্রকাশিতব্য গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক ও এশীয় দেশগুলোর স্থপতিদের সংগঠন আর্ক এশিয়ার সভাপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন হয় না, হতে পারে না। বড় কাটরার উত্তর  গেটের ওয়াকফ সংক্রান্ত শিলালিপিটি সাক্ষ্য দিচ্ছে, বড় কাটরা কোনোভাবেই ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তি নয়। শিলালিপিতে ভবনটি ওয়াকফ করার কথা উল্লেখ থাকায় বড় কাটরার ব্যক্তিমালিকানার দাবি এবং দখল করে রাখা অবৈধ। বড় কাটরা থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে জাতীয় ইতিহাসের নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ এই স্থাপনাটি অবিলম্বে মুক্ত করা উচিৎ।’

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বড় কাটরা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। কিন্তু জায়গাটির মালিকানা বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেই। অধিদপ্তরের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজের জন্য বড় কাটরায় গেলে সেখানে অবস্থানরতরা তাদেরকে বাধা দেন, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। অধিদপ্তর বড় কাটরার জমি অধিগ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল ২০০৯ সালে। কিন্তু উদ্যোগটি সফল হয়নি। আমরা আবারো বড় কাটরার জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘বড় কাটরা সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজের সক্ষমতা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আছে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ওয়াকফ প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণসহ সংশ্লিষ্টদের সহায়তা।’