- ড. মাহবুব হাসান
- ১৯ আগস্ট ২০২২
এই খেলা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকেই মন্ত্রিত্ব না পেয়ে অনেকেই বিক্ষুব্ধ, আবার যারা দলে পদ-পদবি পাননি তারাও ফুঁসে চলেছেন। যুবলীগেও একই রকম ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। আর ছাত্রলীগ তো অনেক আগে থেকেই প্রমাণ করে চলেছে তাদের ক্ষমতার রাজনৈতিক ও পেশির দাপট। মারামারি ও খুনোখুনিতে তাদের অবদানে সরকারপ্রধান এতটাই বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাদের উপদেষ্টা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু তার সেই গোস্যা যেভাবেই হোক ছাত্রলীগের নেতারা সামাল দিয়ে জননেত্রীকে ছাত্রদের অভিভাবকত্বে পুনর্বহাল করেছে। এভাবেই ছাত্র নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের রাজনৈতিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে। এমনকি গত ১৪-১৫ বছরের রাজনৈতিক সরকারের সুবিধা ভোগে দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর স্বার্থ রাজনীতির চেয়ে বেশি হাসিল হয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এসব সাফল্যের কারণেই আওয়ামী নেতৃত্ব ও সরকার চালকরা ছাত্রলীগকে বাহবা জানাতে ভুল করেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ঢুকেছিল একদিন। সে সময়ই ছাত্রলীগ তাদের পিটিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছে। এই অন্যায় ও অবৈধ সন্ত্রাসী কাজের জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের কেন্দ্রীয় অফিসে ডেকে নিয়ে বাহবা জানিয়েছেন। এরকম বাহবা জানানো আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অংশ। আমরা প্রতিপক্ষকে মেরে-কেটে দমন করতে পারলে কেবল খুশিই হই না, রাজনৈতিকভাবে কোল পেতে দিয়ে তাদের আরো ভয়াবহ দুষ্কর্ম করতে উৎসাহ জোগাই। এভাবেই আমাদের ছাত্ররাজনীতি সমৃদ্ধ হয়েছে। এই সমৃদ্ধি যে প্রকৃত রাজনীতি নয়, সেটা মাদার অর্গানাইজেশন জানেন ও সম্যক উপলব্ধি করেন, কিন্তু এই রাজনৈতিক লিগেসি থেকে বেরুতে পারে না। কারণ, তারা ৫০ বছরের ঐতিহ্যকে কিভাবে অস্বীকার করবেন? আমরা তো ঐতিহ্যপন্থী রাজনৈতিক সমাজ, আমাদের একটি টানা রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। সেই পাকিস্তানি আমল থেকে আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি ওই অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ভোলার দুজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যার অপরাধে সরকার কি সেই হত্যাকারী পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে? তাদের কি বদলি করে অন্য কোথাও পদায়ন করা হয়েছে? যে রাইফেল ও গুলি দিয়ে হত্যা করা হলো, সেই বুলেট ও রাইফেল তো কেনা হয়েছে জনগণের অর্থে। বর্তমান সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন করেছে, মিটিং মিছিল করে দাবি জানিয়েছে, তখনো কিন্তু ওই একই পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে, হাত-পা ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে, নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে, সংবিধানে বর্ণিত অধিকার হরণ করেছে, তখনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সেই হত্যাকারী পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো রকম আইনি বিচারের ব্যবস্থা করেনি। ওই কাজটি করলে আজকে ভোলায় পুলিশ সাধারণ প্রতিবাদকারীর ওপর গুলি চালাত না। কারণ তখন সে বুঝত সরকারের অন্যায় নির্দেশের ফল হবে বিচারে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন জেল।
আর আজকে বরগুনায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা কমিটি নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে যে বিরোধ, তার জের বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীর শোকার্ত পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে যেভাবে পিটিয়েছে, তাকে অন্যায় ও অপরাধ বলেই গণ্য করা যায়। কিন্তু ওই অপরাধের জন্য পুলিশের জেলা পর্যায়ের এক অফিসারকে প্রত্যাহার করে নিলেই কি পিটুনি খাওয়া ছাত্রদের পিঠের জ্বালা নিভে যাবে? বদলি করে নিয়ে যাওয়াটা তো অপরাধের বিচার করা নয়। বিচারিক আদালতেই তার বা তাদের বিচার হওয়া উচিত।
ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার যে ঔপনিবেশিক শিক্ষা, সেটাই তো আমরা লিগেসি হিসেবে পেয়েছি। সেই ডাণ্ডার ঐতিহ্যই আমাদের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চরিত্রের, মজ্জাগত। আমরা যে রাজনৈতিক চেতনাগতভাবে স্বাধীন হতে পারিনি, এটা তারই নমুনা। আমরা মানসিকভাবে পরাধীনই কেবল নই, শিক্ষাগত ও প্রশিক্ষণগতভাবেও পরাধীন। এই অন্ধ ও বধিরতার টানেল থেকে বেরুতে হবে জাতিকে। কিন্তু কিভাবে?
২. গণতন্ত্র সেই পথ। পশ্চিমা ধনবাদী বা পুঁজিবাদী গণতন্ত্র আপাতত আমাদের ডিরেইলড রাজনীতি ও প্রশাসনিক ধারাকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে পারে। ক. আমরা লক্ষ্য করেছি, দেশের কোনো দলেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা নেই। বিশেষ করে যারা নিজেদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বলে দাবি করেন, যারা দাবি করেন যে তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, তারা যে জনগণের ম্যান্ডেট পাননি, কিন্তু ক্ষমতায় আছেন- গণতন্ত্র নেই বলেই তারা এটা বলেন এবং লজ্জা বা শরম পান না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকার গণতন্ত্রের খোলস পরে অনুসারীদের মোহাবিষ্ট করে রাখে। কিন্তু সেই ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব আজ আর নেই। গণতন্ত্রের অনুসারীদের মধ্যে কিছুটা শরম-লেহাজ থাকতে হয়। ওই শরম তার রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান।
খ. দলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা থাকলে নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতা থাকত দলীয় স্তরে ভোটাভুটির মাধ্যমে। গণতন্ত্রহীনতার কারণেই প্রান্তিক উপজেলা ও ইউনিয়ন স্তরেও নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রæপিং ও হানাহানির ঘটনা অহরহই ঘটছে। এরকম পরিবেশ পরিস্থিতি তো কেন্দ্রীয় পর্যায়েও আছে, সেটা কে না জানে। এই নেতা হওয়ার বাসনার পেছনে আছে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। নেতা হতে পারলেই কেল্লাফতে। যেকোনোভাবে ক্ষমতার দাপটে তার কীর্তিমান নেতৃত্বের হুঙ্কার ও ধান্ধাবাজির কাজ চলতে থাকে। এটাও একধরনের অন্যায়, দুর্নীতি। এমনিতেই আমরা জাতীয় চরিত্রে মানসিকভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। নীতি-নৈতিকতার ছায়াও নেই ছাত্রনেতা ও জাতীয় নেতাদের মধ্যে। তারা সবসময় একটি ভয়ের ভেতরে বাস করেন, কখন না জানি নেত্রী বা ম্যাডাম তাকে দল থেকে বের করে দেন। ফলে রাজনীতি এগোয় না বরং স্বার্থকেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে দলের ভেতরে উপদল, সাব-উপদল গড়ে তোলে প্রতিপক্ষকে ল্যাং মারার জন্য। বরগুনা ছাত্রলীগের বিরোধ ওই নেতৃত্ব নিয়ে। কেন্দ্র যে কমিটি চাপিয়ে দিয়েছিল, তা অন্যপক্ষ মানে না। তারই রেজাল্ট সেদিনের ঘটনা। কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দিয়ে নেতা বানানোর যে রাজনৈতিক খেলা, সেটাই মূলত হানাহানির কারণ। এই পথ পরিত্যাগ করে আসতে হবে।
সরকার, প্রশাসন ও রাজনীতি- এই তিনের মধ্যে একটি গণমানসিক সমন্বয় সাধন জরুরি। সরকারকেই তা কায়েম করতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক সরকার নিজেকে যেমন গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তেমনি তারাই প্রথম ও প্রধান দায়। আরো একটি কথা বলি, বরগুনায় যদি ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগের মারামারি না হতো তাহলে এএসপি মহররমকে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হতো না। বরং তাকে বাহবা দিয়ে বলা হতো তুমি যোগ্য অফিসার, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী দমনে তুমি অনন্য ভূমিকা পালন করেছ।