একজন সংশপ্তক: খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন

  • সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল
  •  ১৫ মার্চ ২০২৩, ২০:০৭
একজন সংশপ্তক: খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন – ছবি : সংগৃহীত

শৈশব, দুরন্ত কৈশোর আর তেজোদ্দীপ্ত যৌবনের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল ৮০ বছরের একজন মানুষের সমগ্র সত্তায়। কি এক জাদুকরী ব্যক্তিত্ব! তার সাথে রাগ করা যায় কিন্তু অশ্রদ্ধা করা যাবে না। ঘৃণার তো প্রশ্নই আসে না। অথচ খুব সহজে যে কেউ বুঝতে পারবেন তাকে। কার সাথে তিনি আন্তরিক, রাগী কখন কার সাথে। নীতি ও বিশ্বাসবোধের ভিত্তি কতটা দুঃসাহসী এবং অনমনীয় করতে পারে একজন মানুষকে, তার বিরল দৃষ্টান্ত তিনি। রাজনীতিতে এলপিআরে যাওয়া এক নিভৃতচারী আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার নিকট এবং দূর অতীতের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তিনি। যথার্থই একজন সংশপ্তক।

হ্যাঁ, মরহুম খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের কথা বলছি। কত বিশেষণ তার, দীর্ঘ জীবনের বহুভুজি অবদানে। ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, আইনজীবী, সংসদ সদস্য, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, গণতান্ত্রিক চেতনায় নিরন্তর যোদ্ধা, সমাজসেবক, সাচ্চা জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক…ইত্যাদি। কিন্তু সরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একান্ত পরিচিতি আমরা কজনই বা জানি। আর জানলেও তা কতটা? যেটুকু জেনেছি তাতে মনে হয়েছে খোন্দকার দেলোয়ারের হৃদয় একটি বিশাল সমুদ্র। তিনি যেন একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞানাগার। বিশাল সমুদ্রের সহস্র গর্জনে মাতোয়ারা সত্যের সাহায্যে পরিপূর্ণ বিস্ময়কর এক অন্তহীন জলরাশি। কেউ ছাত্র হতে চাইলে তিনি পরম মমতাময় একজন শিক্ষক পেতেন, রাজনীতি শিখতে চাইলে তিনি অকৃপণ হাতের ভাণ্ডার নিতে পারতেন, হতাশায় নুয়ে পড়া কেউ কাছে গিয়ে নিষ্কলুষ স্বীকারোক্তি দিলে আশার সঞ্জীবনী সুধা নিয়ে ফিরতে পারতেন। কিন্তু কখনো রাজনীতি করার মানসিকতায় কেউ কাছে গেলে তিনি নিশ্চিত রাগী অনমনীয় একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন। অন্য যেকোনো নেতার চেয়ে খোন্দকার সাহেব রাজনীতিবিদদের আয়নার ছবিটি বেশি পরিষ্কার করে দেখতে পেতেন। যত বেশি তার কাছে গেছি তত বেশি মনে হয়েছে এক বিশাল অনাবিষ্কৃত খনির সামান্যটুকুই আহরণ করতে পেরেছি। সারাক্ষণ যিনি বিশ্বাস করতেন, মানব জীবনে সুসময়-দুঃসময় বলতে কিছু নেই। কাজে লাগাতে পারলে পুরো জীবনকালই যথার্থ সময়। তাকে কখনো মনে হতো অভিভাবক, কখনো পথপ্রদর্শক, কখনো বন্ধু, কখনো আত্ম-অভিমানী এক শিশু। মানব চরিত্রের সব বৈশিষ্ট্যের এক অপূর্ব ছন্দময় মিশেল ছিল তার সত্তার ক্যানভাসে। মাত্র চার বছরের মহাসচিবের দায়িত্ব পালনকালে তিনি এলেন, কাজ করলেন, জয় করলেন- এটুকু বলে না থামলে মহাকাব্য লিখতে হবে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে।

মানুষটির খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে ২০০১ থেকে ২০১১-এর তার শেষকৃত্য পর্যন্ত।

২০০১-এর চারদল্লীয় জোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংসদে একদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর আমি উদাহরণ হিসেবে বলেছিলাম, আইন ভঙ্গের দায়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার মন্ত্রী-পুত্রকেও ছাড় দেননি, নিজ দলের সংসদ সদস্যকে ছাড় দেননি, সংসদের চিফ হুইপের পুত্রকেও রেহাই দেননি। অধিবেশনের বিরতিকালে অত্যন্ত হাসিমুখে দেলোয়ার ভাই আমার নাম ধরে বললেন- তুমিও আমাকে এস্কেপ গোট বানালে! ভালো। আমি লজ্জা পেয়েছিলাম কিন্তু কষ্ট পাইনি। কারণ উনি কষ্ট পাওয়ার মতো করে বলেননি।

ন্যাম ভবনের ফ্ল্যাট বরাদ্দকাল্লীন ‘বরাদ্দ কমিটি’র প্রধান হিসেবে তার কাছে এক হাজার ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট চেয়েছিলাম। হাসিমুখে দরখাস্তটি হাতে নিয়ে বললেন, তুমি তো কোনো পদার্থই না। একাধিকবার এমপি যুবদলের সেক্রেটারি আর ঢাকা শহরে নিজের একটি বাসা নেই! একটুও ইন্ধন মনে হয়নি ওনার কথায়; বরং তৃপ্তি পাওয়ার উপাদান খুঁজে পেয়েছিলাম কথার সুরে এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার আগে একবার একটি জটিল সমস্যার স্পষ্ট ও দৃঢ় সমাধানের পরামর্শ দিলেন। জনাব তারেক রহমান ও দাউদ ইব্রাহিমকে নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে সব দৈনিকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলো। তৎকাল্লীন যুগ্ম মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান ফোনে সব অঙ্গ সংগঠনকে বললেন ‘নিন্দা প্রতিবাদ’ পাঠাতে পত্রিকায়। আমি যুবদলের তৎকাল্লীন সভাপতি ও আমার যৌথ প্রতিবাদ লিখে পাঠালে রাতে কয়েকজন সাংবাদিক জানালেন, যুবদল সভাপতি তার নাম ছাপাতে নিষেধ করেছেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের কাছে চিন্তিত মনে দ্রুত গিয়ে হাজির হয়ে পরামর্শ চাইলে বিনা দ্বিধায় বললেন, সাহস থাকলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তোমার একার নাম ছাপাতে বলো। আমি তাই করলাম- পরদিন পত্রিকাগুলোতে আমার একার বরাতে ‘নিন্দা প্রতিবাদ’ ছাপানো হলো। এ ঘটনার কয়েকদিন পর তিনি আমাকে ডেকে সতর্ক করলেন- তুমি একটু সাবধানে চলাফেরা করো। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও আমাকে একই পরামর্শ দিলেন।

শহীদ জিয়ার মাজারে সংস্কারপন্থী কয়েক নেতা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহের সাথে আমিও আসামি হলাম। আমার বাড়িঘর তল্লাশি শুরু হলো। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থাকাল্লীন প্রথম রাজনৈতিক মামলা ছিল সেটি এবং বহুল আলোচিতও বটে। দেলোয়ার ভাই আমাকে সাহস দিতেন।

জরুরি অবস্থা জারির কিছু দিন পর দেশনেত্রী আমাকে চারজন সিনিয়র নেতার কাছে কিছু মেসেজ দিয়ে পাঠালেন এবং আলোচনার ফল পরদিন রাতে তাকে জানাতে বললেন। চারজনের মধ্যে খোন্দকার দেলোয়ার একজন ছিলেন। আমি পুরো মিশন শেষ করতে গিয়ে দেখলাম অনেক ভাগ্যবান অনেক প্রাপ্তির অধিকারীদের পালানো কিংবা সমঝোতামূলক মানসিকতা। একমাত্র খোন্দকার দেলোয়ার সেদিন সাহস দিয়েছিলেন এই বলে- ‘একটু ধৈর্য ধরো, ঈমান ঠিক রেখে কাজ করলে আর সৎ সাহস দেখাতে পারলে স্বৈরাচার পালাতে বাধ্য হবে। শহীদ জিয়া আর বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা ও দৃঢ়তা সম্পর্কে এই অসভ্যরা জানে না। সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় বছর লাগবে সব ঠিক হতে। বিএনপি ষড়যন্ত্রের শিকার এর আগেও হয়েছে। এবারো এটি সাময়িক।’

আমাদের সাবেক মন্ত্রী (সিনিয়র) নেতা, এমপিরা অনেকে তখন জেল-জরিমানায় একটু বিচলিত, আমি নিজেও। যাই হোক, ম্যাডামকে সার সংক্ষেপ জানালাম। ম্যাডাম শুধু বললেন, তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তাকে দিয়ে হবে, তাই না? আমি হ্যাঁ সূচক মতামত দিলাম। জরুরি বিধির ১৬(২) ধারায় আমার গ্রেফতার, রিমান্ড শুরু হওয়ার আগে খোন্দকার দেলোয়ার সাহেব একাধিকবার ন্যাম ভবনে বসে আমাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, তুমি খুব সতর্কভাবে চলাফেরা করো, তোমার বিপদ হবে কিন্তু ঘরের ভেতরের ইন্ধনে।

যখন দেশনেত্রী কারাগারে, প্রিয় নেতা তারেক রহমান পঙ্গু প্রায় অবস্থায় কারাগারে বন্দী, আরাফাত রহমান মৃতপ্রায় কারাগারে বন্দী, সিনিয়র নেতারা হয় কারাগারে না হয় পলাতক, ঔদ্ধত্য বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার মৃতপ্রায়, চারিদিকে ঘনঘোর অন্ধকার, তখন শুধু একটিই বাতিঘর ছিল সামনে। সেই বাতিঘর হিমালয়ের মত দৃঢ়, অবিচল, সব আঘাত সওয়ার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। বেগম খালেদা জিয়ার আমানত রক্ষার প্রয়োজনে জীবন দিতে তৈরি এক মহিরুহ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তার পাশাপাশি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহসহ আরো কিছু সিনিয়র-জুনিয়র নেতা ছিলেন।

তবে নিজ পুত্রকে নির্দয় টর্চার সেলে আর্তচিৎকাররত অবস্থায় গোয়েন্দা দফতর থেকে ফোন করে জন্মদাতা পিতাকে তা শুনিয়ে দুর্বল করে তার বিশ্বাস ও দৃঢ়তা থেকে সরানোর যে ফ্যাসিবাদী অপচেষ্টা- তার মর্মযাতনা, অসহনীয় যন্ত্রণা শুধু জন্মদাতা মমতাময় পিতা ছাড়া আর কারো পক্ষে পরিপূর্ণ অনুভব করা সম্ভব নয়। একমাত্র খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সে দুঃসহ যন্ত্রণা উপেক্ষা করে পেরেছিলেন পিতৃত্বের ওপর নেতৃত্বকে স্থান দিতে। যেটি সচরাচর অকল্পনীয়। এর পরও ক্রমাগত হুমকি, ভীতি, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বারডেম হাসপাতাল থেকে তিনি কৌশলগত দুঃসাহসী আত্মগোপন না করলে সেদিন বিএনপি ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখি হতো। এরকম ঘন ঘন দুঃসাহসী যুদ্ধ জয় করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সক্ষম হয়েছিলেন বৃহত্তর যুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব দেশনেত্রীর হাতে সফল ও সুন্দরভাবে তুলে দিতে। আর সে জন্য তিনি সংশপ্তক।

ফুরফুরে মেজাজে থাকলে অনেক সময় প্রাণখোলা দুষ্টুমি করতেন তিনি। আবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনায় নির্দ্বিধায় মনের ভাব প্রকাশ করতেন। একাধিক হাসপাতালে বিভিন্ন সময় তাকে দেখতে গেলে দোয়া চাইতেন ও দোয়া করতেন। আজ খুব মনে পড়ে- ‘অনেকেই পচে গেছে, তুমি পচোনা, এই স্টাইলটি ধরে রেখো। ভবিষ্যৎ ভালো হবে’- বলেছিলেন তিনি। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের গ্রামের বাড়িতে একদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার একান্ত সংস্পর্শে কাটিয়েছি। লুঙ্গি পরিহিত গেঞ্জি গায়ে লাঠি হাতে দৃঢ় পদক্ষেপে সোজা হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্প, শৈশবে নদীতে সাঁতার কাটা, হাডুডু খেলা, বন্ধুদের গল্প, শিক্ষকতা, আইন পেশা, বহু স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তিনি। তার বাড়ির আঙিনায় বহু ফলদ গাছ, পুকুর, মাছ দেখিয়েছেন। তার নিজের প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, বাগান দেখিয়েছেন। তার সাথে দুপুরের খাবার খেলাম, ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক আলোচনা, মসজিদে নামাজ পড়া, অনেক দোয়া পেয়েছি তার কাছ থেকে আমি।

যুবদলের ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশ হলো নারায়ণগঞ্জে। মহাসচিব হিসেবে ঢাকার বাইরে বিএনপির গোটা পরিবারের কোনো বড় সমাবেশে এটিই সম্ভাবত তার প্রথম ও শেষ উপস্থিতি। দীর্ঘ সময় সমাবেশে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেন। মুক্তকণ্ঠে তিনি স্বীকৃতি দিলেন ঢাকার বাইরে এত বিশাল ও এত সুশৃঙ্খল সমাবেশ তিনি আর দেখেননি। বর্তমান যুবদল কমিটির প্রতি এটি ছিল তার প্রকাশ্য প্রশংসা ও স্বীকৃতি। বিএনপি আয়োজিত মরহুম খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের স্মরণে জাতীয় শোকসভায় আমি প্রস্তাব করেছিলাম কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নির্দিষ্ট যে চেয়ারটিতে তিনি বসতেন সেটি সংরক্ষিত রাখা হোক এবং তার সম্মানে একটি সম্মাননা চেয়ার প্রবর্তন করা হোক। বিএনপিতে নির্মোহ থেকে ঈমানদারির সাথে যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দায়িত্ব পালন তথা নেতৃত্ব দানে সফল হবেন তাদের ‘খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সম্মাননা চেয়ার’-এ ক্রমানুসারে বসার সুযোগ দেয়া হবে। আমার মতে, এতে তার কর্মের মূল্যায়নের প্রতি সম্মান চিরকাল থাকবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব প্রেরণা পাবে সঠিক নির্মোহ, সাহসী দায়িত্ব পালনে। মরহুমের ব্যবহৃত চেয়ারটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহাসচিবের কক্ষে সসম্মানে সংরক্ষিত আছে। খুব ভালো লাগে দেখলে।

এখন আরো ভালো লাগবে পরবর্তী প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হতে দেখলে, প্রতীক্ষায় থাকলাম।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মরহুম খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে জান্নাতবাসী করুন। তার রেখে যাওয়া কর্মপ্রেরণা ও আদর্শে উজ্জীবিত করুক আমাদের সবাইকে।

লেখক : যুগ্মমহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)