ঋণ করে ঘি খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই

  • খন্দকার হাসনাত করিম
  •  ২৬ জুলাই ২০২২, ১৯:৪৬

ঋণ করে ঘি খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। – ছবি : সংগৃহীত

রবি ঠাকুরের উপেন বড় মনোকষ্ট নিয়ে বলেছিল- ‘শুধু বিঘে দুই, ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে। বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন, ও জমি লইব কিনে।’ ঋণ দায়ে মানুষ যে কিভাবে দেউলিয়া হয় রবি ঠাকুরের উপেন তা চোখের জলে জানান দিয়ে গেছে। আজ সেই একই ঋণদায়ে পথে বসার উপক্রম করেছে লেবানন ও শ্রীলঙ্কা। ঋণে ঋণে জর্জরিত দেশ দু’টিতে দুর্নীতিরও সর্বগ্রাসী বসত। ফলে ঋণদায়, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি এক জোট হয়ে লেবাননের পর শ্রীলঙ্কাকেও ‘কুরুক্ষেত্রে’ পরিণত করেছে। বলা চলে, লেবাননের দুর্গতিরই যেন আজ পুনরাবৃত্তি ঘটছে শ্রীলঙ্কায়। মার্কিন ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপি এখন বিশ্বের উচ্চতম হারসম্পন্ন। অর্থাৎ রুপির মান সর্বকালের নিচে। ২০২০ সালে একই ঘটনা ঘটে লেবাননে। লেবাননকে মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়। লেবাননের এই “Unprecedented Sovereign Default” দেশটির কোমর ভেঙে দেয়। লেবাননের মতো শ্রীলঙ্কাও গৃহযুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ। তদুপরি দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত সংস্কারের অকার্যকারিতায় হঠাৎই যেন দেশটির অর্থনৈতিক ‘হার্ট অ্যাটাক’ ঘটল।

লেবাননের বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় দেশটির মোট বার্ষিক দেশজ উৎপাদনের ১৫০% গুণ। লেবাননের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অযোগ্যতা দেশটিকে লাটে তোলে। শ্রীলঙ্কার অবস্থাও ঠিক সেরকমই। শ্রীলঙ্কাও এখন ‘ইম্পোর্ট’ বিল দিতে পারছে না। বাংলাদেশের সেখানে সরকারের ঋণ বা সার্বভৌম ঋণ এক লাখ ৯ হাজার ৩৪৪ বিলিয়ন ডলার। তফাৎ হলো বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার মজুদ এখনো সন্তোষজনক; শ্রীলঙ্কা যেখানে দেউলিয়া। ঋণী হতে দোষ নেই, যদি ঋণ পরিশোধের সঙ্গতি থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সার্বভৌম ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে দুই কোটি ৮০ লাখ ৪৭ হাজার ২৮৬ মিলিয়ন এবং এক কোটি ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৫৮ মিলিয়ন ডলার। ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব দেশ- সবাই নিজ দেশের ভেতর থেকে বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ধার করে চলে। তবে ‘ঋণদায়’ এবং ‘ঋণ বিপর্যয়’ এক কথা নয়।

ঋণ ব্যবস্থাপনা টেকসই বা সন্তোষজনক কি না, তা নিরূপণেরও ব্যবস্থা আছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান সূচক হলো ঋণ ও ‘জিডিপি’র অনুপাত। যাদের বা যেসব দেশের ঋণ-জিডিপির আনুপাতিক বেশকম ব্যাপক তাদেরই ঋণখেলাপি হওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। এই অনুপাতে তাদেরই ঋণখেলাপি হওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। এই অনুপাত সূচকের পরই আসে দেশটির স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের পরিমাণ ও উপার্জন ধারা। খোদ যুক্তরাষ্ট্র বা জাপান সরকারও নিজস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (যেমন ফেডারেল রিজার্ভ বা ব্যাংক অব জাপান) কাছ থেকে সার্বভৌম ঋণ নিয়ে থাকে। তবে তাদের সরকারের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা অনেক। লেবানন, শ্রীলঙ্কা বা সুদানের সেই ক্ষমতা না থাকায় তারা বিশ্ব ব্যাংক বা আইএমএফের মতো দাদনদাতার কাছে ধার খেয়ে বসে থাকে। শ্রীলঙ্কা কম সুদেই ধার নিয়েছে; তবে অর্থের পরিমাণ বিশাল।

ঋণ পরিশোধের আগেই তাদের আর্থিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম করে। সেই বিনিয়োগে তারা এমন সব উচ্চাভিলাষী ভারী অবকাঠামো গড়েছে, যা থেকে উপার্জন আসা সুদূর পরাহত এবং পরিশোধ করতে করতে ধারের টাকা সুদাসলে এত বেশি হয়ে যাবে যে, পরিশোধের ইচ্ছা থাকলেও সংস্থান বা সঙ্গতি থাকবে না।

বাংলাদেশের মেগা-প্রকল্পগুলোর কথা এ জন্যই সর্বমহলে আলোচনায় উঠে আসে। এই যে এত বিশাল বাজেট হলো, কৃষক কী পেল? কৃষিতে ভর্তুকি না বাড়ালে জিনিসপত্রের দাম কমবে কিভাবে? জ্বালানিতে ভর্তুকি না দিলে পরিবহন ব্যয় বাড়বে। তাহলে উপায়? খবরের কাগজেই হিসাব কষে দেখানো হয়েছে রাজধানীর একটি সাধারণ আয়ের ছোট পরিবারেরও মাাসিক খাদ্যদ্রব্যের জন্য ব্যয় ২১ হাজার টাকা বা কিছু বেশি। ক’জন মানুষের আয় ২১ হাজার টাকা? তাছাড়া মানুষ কি কেবল ভাত তরকারিই খায়?

ঘরভাড়া, লেখাপড়া, ওষুধপত্র, চিকিৎসা, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ-ইউটিলিটিজ বিল পরিশোধ, ঋণ পরিশোধ, এগুলো আসবে কোত্থেকে? সঞ্চয় বা বীমার কথা না হয় বাদই দেয়া গেল।

২০০৭ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা স্রেফ ধার করেই চলেছে। ১৪ বছরে সেই অজস্র ঋণ পরিশোধের ‘জিডিপি’ : বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের’ অনুপাত আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধ বাবদ ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার বরাদ্দ রেখেছে। এটি তুলনামূলক বিচারে স্বস্তিদায়ক তবে দুর্নীতি, দুঃশাসন, জনগণের ওপর করভার চাপানো এবং অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি, অর্থপাচার চলতে থাকলে সাফল্যের সূচকগুলো মুখথুবড়ে না পড়ার কোনো নিশ্চয়তা থাকবে কি? অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখে ড. মনজুর আলম খান পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে সমন্বিত গড় সুদের হার ১ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ ঋণের ক্ষেত্রে ৯.৭ শতাংশ এবং মোট কর্জের ক্ষেত্রে ৫.৮ শতাংশ হারে পড়ছে। শ্রীলঙ্কার বিদেশী ঋণের সুদের হার বাংলাদেশের তুলনায় চারগুণ বেশি।

বাংলাদেশের সরকার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে যে ধার করেছে, তার গড় ঋণ পরিশোধ সময়সীমা ১০.৪ বছর; শ্রীলঙ্কার এই সময়সীমা বাংলাদেশের তুলনায় ৬.৩৪ শতাংশ বেশি। তাহলে ধীরে সুস্থে আয়েশের সাথে ঋণভার লাঘবের প্রসঙ্গটি বাস্তবতার সাথে মেলে না। এখন শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে পারে চীন বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যৌথভাবে বা এককভাবে হলেও স্বতন্ত্র হিসেবে।

দীর্ঘদিন কৃত্রিম শ্বাস গ্রহণ করে বেঁচে থাকা রোগীর ব্যাপারে ডাক্তার যেমন হাল ছেড়ে দেন, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফও তেমনি শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিতে চলেছে। লেবাননের তুলনায় শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেছে। দেশে হানাহানি অশান্তি হলে ঋণদাতারা লাভবান হয়; সরকারগুলো বিপদে পড়ে। আমাদের দেশে তাই গণতান্ত্রিক শাসন ধারা সবারই শিরোধার্য করে নেয়া উচিত। এবারের বাজেট নির্বাচনী বছরের বাজেট। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়া বা ব্যাপক অর্থে অংশগ্রহণমূলক হওয়া দরকার।

তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া মানেই কিন্তু আদৌ সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত দাবির শামিল বা সমার্থক নয়।
আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণতা কমবেশি থাকতে পারে। এই পরিপূর্ণতার পেছনে আর যে ‘ফ্যাক্টরগুলো’ ভ‚মিকা রাখুক না কেন তার ভিত্তিভ‚মি হওয়া উচিত মানুষের দুঃখ, অনটন, অভাব, প্রশমিত করা।

জনগণের ‘নির্বাচিত’ সরকার দাবিকারীদের মোটেই উচিত নয় বণিকদের সুরক্ষা ও সাধারণ মানুষের জন্য আগ্রাসী এবং নিবর্তনমূলক ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হওয়া। অর্থনীতির সাথে রাজনীতির সম্পর্ক হলো ভায়রা ভাইয়ের মতো স্পর্শকাতর সম্পর্ক। এ সম্পর্ক উপরে উপরে খুবই মোলায়েম; তবে সম্পর্ক ঠিক না রাখতে পারলে সাপে-নেউলে! সুস্থ ঋণ ব্যবস্থাপনায় ভবিষ্যতের অঙ্ক বর্তমানে কষতে হলে ঋণের সুস্থতা ও ঋণ বিমারের হেতু ঠাহর করতে হবে। ঋণের দায়ভার কাঁধে নেয়া খুব কঠিন বিষয় নয়। আমরা নিজেরা সেই ডায়াগনসিস করতে পারলে ‘আইএমএফ’-এর গতানুগতিক প্রেসক্রিপশন মেনে নেব কেন? আইএমএফের ঋণকৌশল হলো রবি ঠাকুরের দরিদ্র গৃহস্থ উপেনের বসতবাড়ি দখলে জমিদার বাবুর অভিলাষের মতো।

তাই কর্জ করার আগে কর্জ পরিশোধের কৌশলপট তৈরি করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বা ঋণ পরিশোধের কাঠামোগত সমাধান তো আর শেয়ারবাজারের অনিশ্চিত ফলাফলের মতো বা নিশ্চিত বিপর্যয় নয়। আগে দেখতে হবে, যে বাবদ ঋণ নিচ্ছি, তা কতখানি বাস্তবসম্মত ও অপরিহার্য। কর্জ করে ঘি খাওয়ার কোনো দরকার নেই। সাধ্য হলে ভোজ্যতেল খাবো, নয়তো পানিতে ডিম, আলু সিদ্ধ করে আলুভর্তা খেয়ে দিন গুজার করব। বিদেশী দাদনে খেলাপি হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। সেই অবকাশ রাখেনি মহাযুদ্ধপরবর্তীকালে সম্পাদিত ‘ব্রেটন উড’ চুক্তি, যে চুক্তিরই ফসল বিশ্ব ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।