রাশিয়া যদি ইউক্রেনে হামলার পথে আগায়, তাহলে বাইডেন প্রশাসন দেশটিকে মার্কিন বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট পণ্য, বাণিজ্যিক ব্যবহারের ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার, সেমিকন্ডাক্টর ও উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পারে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে।
এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে রাশিয়ায় নির্দিষ্ট কিছু পণ্য পাঠানোর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সনদ নিতে হয়। এ তালিকায় নতুন কিছু পণ্য যোগ করে সেগুলোর বিপরীতে সনদ না দেওয়ার কথা ভাবছে বাইডেন প্রশাসন।
রাশিয়ার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু উদ্যোগের পরিকল্পনা করছে, যার মধ্যে এটি একটি। নিষেধাজ্ঞার আওতায় লেজার প্রযুক্তি, টেলিকম সরঞ্জাম ও নৌপরিবহন সংক্রান্ত পণ্য অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, যদি পুতিন আরও অগ্রসর হন, তাহলে আমরা আরও এগিয়ে গিয়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেব, যার বিস্তারিত আমরা এখনো প্রকাশ করিনি।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ খুবই কার্যকর হবে, কারণ আমরা এমন সব প্রযুক্তির কথা বলছি, যেগুলো রাশিয়ার অর্থনীতি বিস্তারের জন্য আবশ্যক উপকরণ।
‘যদি রাশিয়া হামলার পরিকল্পনায় অগ্রসর হয়, তাহলে (এর মোকাবিলায়) যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বেশ কিছু সংখ্যক দেশ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত আছে’, যোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই কর্মকর্তা।
কী কী নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে হোয়াইট হাউস ও এর বাণিজ্য বিভাগ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছে দেশটির বাণিজ্য বিভাগ।
এ উদ্যোগগুলোকে সামষ্টিকভাবে ‘নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ’ বলা হচ্ছে। এ সপ্তাহের শেষ নাগাদ এর রূপ আবারো পরিবর্তিত হতে পারে। হোয়াইট হাউসের কিছু কর্মকর্তা রাশিয়ার সাধারণ বেসামরিক জনগণকে নিষেধাজ্ঞার রুদ্র রোষ থেকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
গত মাসে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান পিটার হ্যারেল জানান, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য হবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে রাশিয়ার শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া।
তিনি আরও জানান, মার্কিন প্রশাসন রুশ প্রযুক্তি ও শিল্প খাতকে বিঘ্নিত করতে আগ্রহী।
তবে রাশিয়ার সাধারণ জনগণকে সমস্যায় ফেলা তাদের লক্ষ্য নয়, নিশ্চিত করেন হ্যারেল।
এ ছাড়াও, বাইডেন প্রশাসন মস্কোকে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের আওতায় রাখতে চায়। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েনের কারণেই মূলত এ শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত শনিবার বাইডেন প্রশাসন জানায়, বিধিনিষেধ প্যাকেজ চালু হলে রাশিয়ার মূল ব্যাংকগুলো থেকে মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে লেনদেনের অনুরোধ আসলেও তা পালন করা হবে না।
এ যাবত সবচেয়ে কঠোর উদ্যোগ হতে পারে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ প্যাকেজ। এর আগে, ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের টেলিকম প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। এর আওতায়, যেসব প্রতিষ্ঠান মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য দেশে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা দিচ্ছেন, তাদেরকেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেক সনদ নিতে হয়।
মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ও ওয়াশিংটন ভিত্তিক আইনজীবী কেভিন উলফ জানান, এটি খুবই অভিনব একটি প্রক্রিয়া এবং শুধু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে এটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর হতে পারে।
বিধিনিষেধ আরোপিত হলে বেসামরিক উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশসহ বেশ কিছু পণ্য রাশিয়ায় পাঠাতে মার্কিন সরবরাহকারীদের বিশেষ সনদ নিতে হবে। এ বাধ্যবাধকতা এ মুহূর্তে নেই। তবে ইউরোপ একই পথে হাঁটবে কিনা, তা দেখার বিষয়।
ইতোমধ্যে গতকাল জাপান জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য জি৭ দেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপের জন্য প্রস্তুত।
একইদিনে বাইডেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দুটি বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কিছু অভিজাত রুশ ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
এর আগে, সোমবার পুতিনের পূর্ব ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাইডেন অঙ্গীকার করেন, এ অঞ্চলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বন্ধ করা হবে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও রুশ ব্যাংক ও কোটিপতি নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
মার্কিন প্রশাসন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ প্যাকেজে কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছে। অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুব সহজেই প্রশাসন সনদের আবেদন নাকচ করে দিতে পারবে। এ অস্ত্রকে তারা কাজে লাগাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
এ ছাড়াও, যেসব রুশ প্রতিষ্ঠানকে সামরিক বাহিনীর কাছে পণ্য ও সেবাদাতা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তাদেরকে একটি কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। এদের মধ্যে কিছু উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ফলে এ প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সনদ না নিয়ে রাশিয়াকে কোনো প্রযুক্তি পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না।
পরিশেষে ওয়াশিংটন এফডিপিআর আইন নামে পরিচিত এ আইনের আরও সম্প্রসারণ করে রুশ সেনাবাহিনীকে পণ্য ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে এরকম যেকোনো প্রতিষ্ঠানকেই বিধিনিষেধের আওতায় আনতে পারে। বস্তুত পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একটি মাত্র মার্কিন পণ্য বা প্রযুক্তির ব্যবহার থাকলেও প্রতিষ্ঠানের কাছে সনদ চাইতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
বাণিজ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে রাশিয়ায় মার্কিন রপ্তানির পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ছিল। ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিধিনিষেধ কার্যকর আছে। তবে এফডিপিআর আইনের ব্যবহারে বিধিনিষেধ প্যাকেজের আওতা ও কার্যকারিতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে।
তবে এ যাবত বিভিন্নভাবে রাশিয়ার অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করেছে মার্কিন প্রশাসন, যার কোনোটিই সেভাবে সফল হয়নি।
আগামী কয়েকদিন সবার দৃষ্টি থাকবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর। এবার কী করবেন পুতিন, এটাই এখন চায়ের কাপে ঝড় তোলার মূল ইস্যু।