বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুযায়ী, নৌপথটি ধরে চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন ১০০-১২০টি লাইটার জাহাজ সারা দেশের নানা ঘাটে পণ্য নিয়ে যায়। একই পথ ধরে ফেরত আসে ১০০-১২০টি লাইটার জাহাজ। সবচেয়ে বেশি পরিবহন হয় সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার, চুনাপাথর, জিপসাম ইত্যাদি। এ ছাড়া সব মেগা প্রকল্পের সরঞ্জাম, পাথর, কয়লা, সার, জ্বালানি তেল, ডাল, গম, চিনিসহ ভোগ্যপণ্যের বড় অংশও এ পথে পরিবহন হয়।
এই নৌপথের অন্যতম ব্যবহারকারী প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশের আমদানি পণ্যের ৮০ শতাংশ এই নৌপথে বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। কিন্তু নৌপথটি কখনো সংস্কার করা হয়েছে, এমন কথা শোনা যায়নি। অথচ বন্দর দিয়ে যখন পণ্য আমদানি করা হয়, তখন ‘রিভার ডিউজ’ খাতে মাশুল নেওয়া হয়। যে সংস্থারই দায়িত্ব থাকুক, এই মাশুলের টাকা এই নৌপথ সংস্কার কার্যক্রমে ব্যয় করা উচিত।
ব্যবহারকারীরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে ভাসানচরের সামনে দিয়ে হাতিয়া চ্যানেল হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে পণ্য পরিবহন হয়। ভাসানচরের দক্ষিণে নিচের দিকে নৌপথটির সাগর উপকূলের প্রায় ১৫ মাইল এলাকায় পানির গভীরতা চার মিটারের কম। কিন্তু লাইটার জাহাজগুলোর ড্রাফট (পানির নিচে থাকা জাহাজের অংশ) থাকে চার থেকে সাড়ে চার মিটার। তাতে ভাটার সময় এ পথে জাহাজ চলাচল করতে পারে না। জোয়ারের সময় পানি বাড়লে নৌপথটি অতিক্রম করতে হয়। এই অংশে জাহাজ চলাচল করে পূর্ব-পশ্চিমমুখী হয়ে। আর জোয়ারের সময় স্রোত ও ঢেউ থাকে উত্তর-দক্ষিণমুখী। অর্থাৎ জাহাজ চলাচলের সময় বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে জাহাজের পেটে। তাই জাহাজের কাঠামো দুর্বল হলে বা মাস্টার অনভিজ্ঞ হলে তখন এই অংশে জাহাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাতেই ঘটে দুর্ঘটনা।
এই নৌপথে ৪১ বছর ধরে জাহাজ চালাচ্ছেন নবী আলম। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনও হয়েছে, আকাশে রোদ দেখে কর্ণফুলী থেকে পণ্য নিয়ে রওনা হয়েছি। দেড়-দুই ঘণ্টা পর ভাসানচরের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর মেঘ উঠল আকাশে। তাতেই বড় বড় ঢেউ শুরু হয়ে যায়। এমন সময় যদি জাহাজের ফিটনেস না থাকে বা জাহাজে পণ্য যদি বেশি বোঝাই করা হয়, তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন।’
৩ জুলাই ভাসানচরের ১০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে আমির শাহ নামের একটি বালুবাহী অবৈধ নৌযান ডুবে যায়। ছোট এই নৌযানের অবস্থান শনাক্ত করার আগেই ডুবন্ত নৌযানটির সঙ্গে
ধাক্কা লেগে আরও দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। তবে জাহাজ দুটি তীরের কাছাকাছি নিয়ে রক্ষা করেন জাহাজের দুই মাস্টার।
এরপর একই স্থানে গত শনিবার এমভি ফুলতলা-১ নামের যশোরের নোয়াপাড়াগামী মটর ডালবাহী একটি জাহাজ ডুবে যায়। লাল বয়া দিয়ে স্থানটি চিহ্নিত করার পরও গত মঙ্গলবার এমভি হ্যাং গ্যাং-১ নামের আরেকটি জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডুবে যায়। জাহাজটিতে পদ্মা সেতুতে ব্যবহারের জন্য ১৩ কোটি টাকার লোহার অ্যাঙ্গেল ছিল। সব দুর্ঘটনায় নাবিকেরা আশপাশের জাহাজে উঠে রক্ষা পান।
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ‘এমভি হ্যাং গ্যাং-১’ জাহাজের মাস্টার আমিন আল শেখ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফুলতলা জাহাজটি যেখানে ডুবেছে, সে জায়গাটি অতিক্রম করে সামনে যাওয়ার পর ঢেউয়ের মুখে আমাদের জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। জাহাজটি রক্ষা করতে নোঙর ফেলে দিই। কিন্তু নোঙর সরে এসে ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।’
এ বছর এ নিয়ে এই এলাকায় পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কয়েক বছর ধরে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে এই এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সাগর উপকূলের এই নৌপথ ঝুঁকিপূর্ণ বলে এই পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পাইলট নেওয়া বাধ্যতামূলক। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০টি জাহাজ কিংবা কখনো একসঙ্গে ১৫০টি জাহাজ পণ্য নিয়ে এই নৌপথ অতিক্রম করলেও সংস্থাটিতে পাইলট রয়েছেন ৩৭ জন। তাই বুকিং দেওয়ার পরও পাইলট পাওয়া যায় না বলে জাহাজের মাস্টাররা জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর পণ্যবাহী যে জাহাজটি ডুবেছে, সেটিতেও বিআইডব্লিউটিএর পাইলট ছিলেন না। এ ছাড়া ডুবে যাওয়া এমভি ফুলতলা-১ জাহাজটির কাঠামো খুবই দুর্বল ছিল বলে একাধিক জাহাজ মাস্টার জানিয়েছেন।
দুই বছর ধরে সাগর উপকূলে চলাচলের অনুপযোগী বালুবাহী নৌযানের মতো অনুমোদনহীন জাহাজও চলছে এই পথে। অনুমোদনহীন হওয়ায় এসব জাহাজ ডুবে গেলেও সেই খোঁজ জানা যায় না। মালিকের হদিস না মেলায় এসব নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। আবার খননকাজও হচ্ছে না এ নৌপথে। আবার জোয়ারের নির্ধারিত সময়ে চলাচলের পরামর্শ মানছেন না অনেক জাহাজ মাস্টার। তাতে দিন দিন দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে এ পথে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহাজের মাস্টাররা সচেতন হলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। পাইলটের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি এই নৌপথে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বড় আকারের খননকাজের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আগামী শুষ্ক মৌসুমে খননকাজ শুরু হতে পারে।’