- হারুন-আর-রশিদ
- ১৩ জুন ২০২১
২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি। সব রাজনৈতিক দল একমঞ্চে এসে বলতে পারিনি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি। এ বিষয়ে বিভ্রান্তির আর কোনো অবকাশ নেই। বিশেষ করে দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের কাছে তুলে ধরেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের একক দাবিদার সেজেছে, অর্থাৎ নিজেরাই সব আর কারো কোনো ভ‚মিকা নেই। এভাবেই একটি বিতর্কিত ইস্যু দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জিইয়ে রেখেছে। ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। পৃথিবীতে বহু দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। হো চি মিনের ভিয়েতনাম, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবাসহ আরো বহু দেশ লড়াই করে স্বদেশকে হানাদারমুক্ত করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ নেই। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে উপমহাদেশ শত্রুমুক্ত করেছিলো এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীই। কিন্তু দোষারোপের রাজনীতির চর্চা তখন ছিল না।
বাংলাদেশে বিগত পাঁচ দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক দূষণ ছড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় পর্যায়ে একটি সংলাপের আয়োজন করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি। মুক্তিযুদ্ধে কার কি ভ‚মিকা ছিল- বিশেষ করে সাড়ে সাত কোটি মানুষেরই বা কি ভ‚মিকা ছিল তা নিয়েও বক্তব্য থাকবে। কিছু রাজনৈতিক দলের হাবভাব দেখে মনে হয়, এককভাবেই তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের একক কৃতিত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবদানকে খাটো করে দেখা হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের যদি সমর্থন না থাকত তাহলে এত অল্প সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এই অতি সত্যি কথাটি অস্বীকার করার অর্থ গোটা জাতিকে অপমান করার শামিল। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত জাতি প্রত্যাশা করে। এ ব্যাপারে সর্বদলীয় একটি সংলাপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা গ্যাজেট আকারে রাষ্ট্রীয়ভাবে নথিভুক্ত করতে হবে এবং সকল গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করতে হবে। আমরা এমনও দেখেছি, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন দলীয় স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ে আবার কমতেও দেখা যায়। দলীয় চরিত্রকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের অনিয়ম বিগত ৫০ বছরে আমরা হতে দেখেছি। কৃষক শ্রমিক এবং মেহনতি মানুষ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেও সার্টিফিকেট পাননি। আবার অনেকেই যুদ্ধ না করেই মুক্তিযুদ্ধের সনদপ্রাপ্ত । বর্তমান ৫০ ও ৬০ বছরে বহু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পেয়েছেন- যা পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। ’৭১-এর প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধের জীবন যুদ্ধ’ গ্রন্থে এসব ঘটনা আমি তুলে ধরেছি। ১০ ফেব্রুয়ারির ২০২১ একটি সভায় জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেছেন, আমরা সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সিপাহশালার সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে বীরত্বপূর্ণ কোনো খেতাব দিতে পারিনি। যারা দেশমাতৃকার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন এবং স্বাধীনতা অর্জনে বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব অর্জন করেছেন তাদের খেতাব বা পদক বাতিল করা মুক্তিযুদ্ধকে গৌরবান্বিত করে না। সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় খেতাব বীর উত্তম বাতিলের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি (তথ্য সূত্র জাতীয় দৈনিক ১১.০২.২০২১)।
বিভিন্ন সভা সমিতিতে দেশের বড় দুটো রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধকে যখন নিজেদের একক অর্জন হিসেবে তুলে ধরে তখনই বিরোধ তুঙ্গে ওঠে এবং সমাজে পরবর্তী সময়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ফলে জাতির মধ্যে বিভক্তি আরো বিস্তৃতি লাভ করে।
জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে, সকল রাজনৈতিক দলকে সঙ্কীর্ণ মনোভাব পরিত্যাগ করে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এ রকম একটি বার্তা গণমাধ্যমে প্রচার করা অতীব জরুরি বলে আমরা মনে করি। অমি বহু মত ও আদর্শের মানুষের সাথে আলাপ করে জেনেছি ও বুঝেছি তারা বিষয়টি নিয়ে একটি সুন্দর সমাধান কামনা করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে ঝগড়া বিবাদ নেই। আমাদের দেশে যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের বিষয়টি নিয়ে সম্মিলিতভাবে রাজনীতিকদের উপদেশ দেয়া উচিত। বলা উচিত, এবার ক্ষান্ত হন। আসুন সবাই মিলে দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে ভাবি।
এটাই হোক জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বা ব্রত। কিভাবে দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে। কিভাবে দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সবাই বাঙালি বা বাংলাদেশী এই মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করলে বহু আগেই এ দেশ সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া হয়ে যেত। আজ সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু গড় আয় ৫২ হাজার ইউএস ডলার। এবং মালদ্বীপের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ২৪ হাজার ইউএস ডলার। আর আমাদের মাথাপিছু গড় আয় মাত্র দুই হাজার ইউএস ডলার। আমরা ৫০ বছরে যতটুকু এগিয়েছি তা সম্ভাবনার চেয়ে কম। ২০ বছরে মালদ্বীপ ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর যতটুকু এগিয়েছে আমরা ৫০ বছরেও তা পারিনি- শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলাদলি, খুন এবং রাহাজানির কারণে। আমাদের দেশে যে সব গবেষক নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করবেন তারা বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারবেন বলে আমরা মনে করি। লেখক ও বুদ্ধিজীবীদেরও তাদের লেখায় স্বচ্ছতার প্রমাণ দিতে হবে, অন্যথায় তাদের লেখায় নিরপেক্ষতা প্রকাশ পাবে না। নিজের পকেট ভারী করার চিন্তা চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই জাতি একটি সঠিক ইতিহাসের সন্ধান পাবে। বিগত ৫ দশক পর্যন্ত বিভ্রান্তির কবলে পড়ে যে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশ পিছিয়ে গেছে সেটা আর হতে দেয়া যায় না।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় দুটো সমস্যা একটি হলো যানজট, দ্বিতীয়টি বায়ুদূষণ, এ দুইটি কারণে দেশের অর্থনীতির যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এ দুটো বিষয় নিয়ে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। আমরা একের পর এক দালান কোঠা, রাস্তাঘাট এবং সেতুর মতো বড় বড় স্থাপনা বানিয়ে বলছি দেশ উন্নত হচ্ছে। কিন্তু সমাজটা ভেতরে ভেতরে রসাতলে যাচ্ছে। এক দশক আগেও এত ধর্ষণ দেশে সংঘটিত হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন সকল অপরাধকে ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হেফাজতে খুন হলে দেশের ভাবমূর্তি মর্যাদা কখনো বাড়ে না। কিন্তু উল্লিখিত অপরাধসমূহ দেশে এখন বেশি ঘটছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমরা যতটা সোচ্চার তার কিয়দংশও সোচ্চার নই দেশের অপরাধ নিয়ে। দেশে সৎ লোকের অভাব নেই কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। সমাজকে অন্ধকার পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। একটি আলোকিত বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
সামাজিক রাষ্ট্রিক নানা অসঙ্গতিতে আমরা জর্জরিত। এসব নিয়ে সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করা প্রতিটি সচেতন মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যথায় বিবেকবান মানুষ নিজ নিজ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে বলে আমরা মনে করি। যারা বয়সে প্রবীণ তারা সবাই কমবেশি জানেন ১৯৭১ সালে দেশে কী ঘটেছিল। প্রবীণ মানুষের উচিত সত্য ইতিহাসটাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। ইতিহাসসচেতন হওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প খোলা নেই। যদি মিথ্যাকে মিথ্যা, সত্যকে সত্য বলার সাহস না থাকে তাহলে আমরা সমাজের বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। একটি রাষ্ট্রের সাথে এক তরফা বাণিজ্য নীতির প্রসার ঘটছে, যা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে চিন্তাভাবনা। ফেসবুকে তরুণরাই বলছে দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি- কারণ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র সেটা এখন নেই।
ভারতের সাথে আমাদের সম-অধিকার সমমর্যাদায় নেই। বিগত এক দশকে ভারতকে যেসব স্বার্থের প্রশ্নে ছাড় দেয়া হয়েছে তা নজিরবিহীন। বিগত ৭০ বছরেও অন্য কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে এক পক্ষীয় স্বার্থ হাসিল করতে পারেনি ভারত। অথচ ভারত যখন যেভাবে যা চেয়েছে বাংলাদেশ তাই দিয়েছে। বিনিময়ে কিছুই পায়নি। আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাটুকু দিতে রাজি নয় দেশটি। মানুষ আশা করেছিল ভারতের সাথে সাড়ে চার দশকের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর ন্যায়ভিত্তিক সুরাহা হবে। সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা, মাদক চোরাচালান, বাণিজ্য বৈষম্য ইত্যাদি ইস্যুগুলোর বিষয় ভারত তেমন আমলে নিচ্ছে না। তিস্তা চুক্তির ইস্যুটি ১৯৮৩ সাল থেকে কেবল আশ্বাসের মধ্যে রেখে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কথা বলে তারা সব স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সম্পর্ক কাম্য হতে পারে না।
বাংলাদেশ যদি তার শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করে তাহলে আমাদের ভোগান্তি আরো বাড়বে। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলব এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করব তাহলেই আমরা জয়ী হবো। ট্রানজিটে মাথায় হাত ব্যবসায়ীদের। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ‘ট্রায়াল রানে’ ভারতের পণ্য ভারতের পরিবহন। আখাউড়া করিডোর দিয়ে সাত রাজ্যে একতরফা যাচ্ছে ভারতীয় মালামাল। একই আয়োজন ফেনী সেতু হয়ে রামগড় স্থলবন্দরে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বনাশ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলি, কিন্তু দেশ রসাতলে যাচ্ছে সে ব্যাপারেও আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামত তুলে ধরতে পারিনি। এ দুঃখ ঢাকি কিভাবে!
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক।
E.m: [email protected]