কোয়াড-টিকার ভালো-মন্দ বিচার
- গৌতম দাস
- ১৫ মে ২০২১
চীন না আমেরিকা- আমাদের জন্য কে ভালো- এ নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ, লাভালাভ অথবা ভালো-মন্দ বিচারবোধ থাকতে পারে। কিন্তু এটি ব্যক্তিগত বা সাবজেকটিভ বোধবিচার। আজকের আলোচনার বিষয়টির বিচার নৈর্ব্যক্তিক বা অবজেকটিভ হতে হবে। তাতে এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটির সহজ সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
করোনার টিকা শেষ পর্যন্ত গরিব-বড়লোকের টিকা হয়েই হাজির হয়ে গেল। আবার একই সাথে তা গ্লোবালি এক ভুয়া এম্পায়ার আর উপযুক্ত এম্পায়ারের দাবি হিসেবে হাজির হলো।
গরিব-বড়লোকের টিকা বলতে সর্বসাকুল্যে দুনিয়ায় ব্যবহৃত টিকাগুলো হলো এক দিকে ফাইজার, মডার্না আর জনসন; অন্য দিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা, স্পুটনিক, কোভ্যাকসিন প্রভৃতি। এর মধ্যে প্রথম তিনটি- মানে ফাইজার, মডার্না, জনসন হলো ‘বড়লোকের টিকা’। কারণ এর দাম অনেক বেশি আর এর চেয়েও বড় কথা হলো এর সংরক্ষণের তাপমাত্রা রক্ষা করা খুবই কঠিন। দাম ২০ থেকে ৩৩ ডলারের মধ্যে। আর সংরক্ষণ তাপমাত্রা (-১৫) থেকে (-৮০) ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। গরিব গোত্রের টিকাগুলোর প্রায় সবই ৪ ডলারের নিচে আর সংরক্ষণ তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বাসায় আমরা যে ধরনের কমন ফ্রিজ ব্যবহার করি (ডিপফ্রিজ নয়) সেটিই গরিবের ভ্যাকসিনগুলো সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট। আর বড়লোকের ভ্যাকসিন আমাদের মতো দেশে যেখানে গরমের সময় তাপমাত্রা +৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা, সেখানে সংরক্ষণ কঠিন। তাই বড়লোকের ভ্যাকসিন আমরা বিনা পয়সায় পেলেও তা ঢাকাতেই ব্যবহার প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। (ভ্যাকসিন বিষয়ে তথ্যগুলো বিবিসির ১০ এপ্রিলের আর ১৪ জানুয়ারির দু’টি রিপোর্ট থেকে নেয়া)
–
আমাদের মতো দেশকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা, স্পুটনিক, কোভ্যাকসিন- গরিবদের এসব টিকার মধ্যেই থাকতে হবে। এর মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকা যুক্তরাজ্যে আবিষ্কার করা হলেও এর ফর্মুলা ভারতে এনে তৈরির ফলে এর সস্তা ভার্সন ‘কোভিশিল্ড’ পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশকে বিক্রি করেছিল ভারত এবং এ জন্য তারা আগাম বিনিয়োগ হিসেবে টাকা নিয়েও এখন আর টিকা দিচ্ছে না। দেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা চীনের তৈরি। দুটোই হু-এর নোটিশ বোর্ডে ‘৭৮-৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর’ দেখা যায় যার মধ্যে সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা পরে ব্রাজিলে কমে গিয়ে ৫০.৪ শতাংশ হয়েছিল। তবে ব্লুমবার্গ ইন্দোনেশিয়ায় ফল ৯৪-৯৮ শতাংশ, চিলিতে ৬৭ শতাংশ কার্যকারিতার কথা জানায়। আর সিনোফার্মা হু-এর তালিকায় ৭৯ শতাংশ কার্যকর। আবার রাশিয়ান স্পুটনিক এখনো ৯১ শতাংশ কার্যকর বলে উল্লেখ রয়েছে।
খারাপ খবর হলো, ভারতের অপর টিকা কোভ্যাকসিন ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর দেখালেও এটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ আছে বিবিসির রিপোর্টে।
তার মানে দাঁড়াল বাংলাদেশের জন্য ‘পাওয়া সম্ভব’ ও ‘উপযুক্ত’ ভ্যাকসিন বলতে বাকি থাকল চীনা সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা (এটি বেশি উপযুক্ত) আর রাশিয়ার স্পুটনিক।
আরো কথা আছে। তা কিনতে আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে কি না। এ ছাড়া যদি নিজে উৎপাদন করে নিতে হয় তা হলে কী হবে?
অ্যাম্পায়ার ধারণাটা এ প্রসঙ্গে বোঝা জরুরি। ইংরেজিতে এম্পায়ার বলে একটা শব্দ আছে যার মূল অর্থ এক বিরাট ভূখণ্ড বা কয়েকটি দেশজুড়ে ভূখণ্ড যা কোনো একক শাসকের অধীনে পরিচালিত। বাংলায় এটিকেই আমরা ‘সাম্রাজ্য’ শব্দ দিয়ে চিনি। তবে এ শব্দ দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্য (১২৯৯-১৯১৮) থেকে শুরু করে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্য (১৭২১-১৯১৭), ব্রিটিশ সাম্রাজ্য (১৬০০-১৯৪৫) প্রভৃতি চিহ্নিত করার পাশাপাশি অনেকে বিশেষত কমিউনিস্টরা আজকের আমেরিকাকে (১৯৪২-চলমান) ‘সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা’ বলে থাকেন। সাম্রাজ্য শব্দের সবখানেই কমন বৈশিষ্ট্য বা মানে হলো কয়েকটি দেশজুড়ে বা বিরাট ভূখণ্ড, যা পরিচালিত হয় একক শাসন কর্তৃত্বে। তবে ১৯৪২ সালের পর থেকে ‘সাম্রাজ্য’ বলতে ধারণায় বদল আসতে থাকে। অন্তত সরাসরি অন্য দেশ থেকে আসা শাসক উপস্থিত থেকে শাসন করা বোঝানো বন্ধ হতে থাকে।
১৯৪২ সালের আগের শাসনগুলো ছিল মূলত কলোনি বা দখলি শাসন আর ওদেশ থেকে লুট করে ওদেশের অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত সম্পদ শাসকের দেশে পাচার করা বোঝাত। ১৯৪২ সালের পর থেকে বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই সুযোগই আর বাস্তবে থাকেনি। কারণ কলোনি বা দখলি শাসন আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
তবে ১৯৪৫ সালের পরে মূলত প্রতিটি দেশ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ধরে নিয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে দুনিয়াজুড়ে এক বাণিজ্যবিনিময় সম্পর্ক শুরু হয়, যেটি একেবারেই নতুন এক গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার। এটি আমেরিকার নেতৃত্বে চালু হয়েছিল এবং এখনো আছে প্রায় ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে, যাতে আমেরিকার আধিপত্য এখন শেষের দিকে। কারণ আমেরিকার হারানো প্রভাবের জায়গা দখল করার উপযুক্ত হয়ে উঠে আসছে চীন।
কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরের আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারের মধ্যে গরিব দেশগুলো ‘কলোনিমুক্ত’ অর্থে স্বাধীন হয়ে যায় বটে কিন্তু নিজ নিজ অর্থনীতি কার্যকরভাবে চালানোর উপযুক্ত অর্থে স্বাধীনভাবে তারা টিকে থাকতে পারছিল না। এর মূল কারণ আগের দুই শ’ বছর ধরে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এমন সম্পদ লুট আর পাচার হয়েছে যে তার কিছু অংশ কোনো শর্তে আবার ফিরিয়ে না আনতে পারলে এসব স্বাধীন দেশ ‘না খেয়ে মরবে’। আর এ কাজেই বিরাট ভূমিকা রেখে এসেছে আমেরিকা। তার এ ভূমিকাটি মন্দের ভালো বলা যায়। তবে এটি গরিব দেশকে সাহায্য করতে, তার একটি ভায়াবল অর্থনীতির জন্য করা বিনিয়োগ ঠিক নয়। এটি উল্টো, মূলত আমেরিকার হাতে জমে যাওয়া বিনিয়োগহীন বিপুল সম্পদের হিল্লে করার জন্য, গরিব দেশে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে বের করা হয়েছিল। আর সেটি করতে গিয়ে আগে গরিব দেশে প্রায় না সুদে বা অনুদানে (আসলও ফেরত দিতে হয় না যেখানে) অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল; যাতে আমাদের অর্থনীতি যত সচল হবে, ততই আমরা ন্যূনতম চার পার্সেন্টের উপরে সুদ দিয়ে আরো বড় বড় বিনিয়োগ নেয়ার যোগ্য হই এবং তাদের সরাসরি ব্যবসা বিনিয়োগ করতে দিতে পারি এমন যোগ্য অর্থনীতির দেশ হই। এভাবে সারা দুনিয়াজুড়ে গ্লোবাল বাণিজ্যবিনিময়, দুনিয়ার আরো কোণে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অর্থে আমেরিকার এ ভূমিকাটি ‘মন্দের ভালো’।
কারণ আমাদের অর্থনীতি ক্রমেই ভালো হওয়ার কিছু সম্ভাবনা এখানে আছে। কমিউনিস্টদের শোষণতত্ত্ব অনুসারে আমেরিকা যে শোষক, এটি অবশ্যই তাতে ভুলে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমরা কী সে জন্য আমেরিকাকে গালমন্দ করে না খেয়ে বসে থাকব? নাকি এই গ্লোবাল অর্থনীতির ভেতরেই আমার জন্য যেসব তুলনামূলক সুবিধা জেগে উঠতে দেখা যাবে, সেগুলোর সুযোগ নিয়ে স্ট্রাগল করে উঠে আসার চেষ্টা করব? এই হলো সেই লড়াই। আর অবশ্যই আমেরিকা সম্পর্কে কমিউনিস্টদের শোষণতত্ত্ব অস্বীকার না করে বা না ভুলেই তা করা সম্ভব।
আমাদের মতো দেশের অর্থনীতিতে আমেরিকার (তার নিজের স্বার্থে) সাহায্য আমরা পাচ্ছি বা আমেরিকা সাহায্য করছে- এটিই আমেরিকার ‘ইতিবাচক এম্পায়ার ভূমিকা’। যেমন ধরা যাক, আমাদের দেশে ১৯৮৮ সালের বন্যা। আমেরিকা প্রায় না সুদে বা অনুদানে অবকাঠামো খাতে আরো ঋণ-বিনিয়োগ না করলে আমরা হয়তো উঠে আসতেই পারতাম না বা কষ্ট হতো অথবা ঘুরে দাঁড়াতে দেরি হতো। আবার আমেরিকার দিক থেকে ওই নতুন অবকাঠামো খাতে ঋণ-বিনিয়োগটি সে সময় না করলে তাদেরই আগের দেয়া কোনো ঋণ-বিনিয়োগ আমরা ফেরত দেয়ার যোগ্য থাকতাম না হয়তো। তাই এটি ছিল আমাদের আগে তাদেরই মৌলিক স্বার্থ।
এই হলো সেই এম্পায়ারেরই সামগ্রিক নেতিবাচক সত্ত্বেও কিছু ইতিবাচক ভূমিকা, তবে সেটিও ওদের স্বার্থেই। এটিই গত প্রায় ৭৫ বছরের আমেরিকার কিছু ইতিবাচক ভূমিকা। কিন্তু গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নেতৃত্বে যখন পালাবদল ঘটে আর তাতে নতুন যে নেতা আসেন তাকেই এই দান-অনুদানে খরচের দায় নিতে হয়। অর্থাৎ ইতিবাচক এম্পায়ার রোল নিতে হয়। চীন এখন সে ভূমিকা নিচ্ছে ক্রমেই।
ঠিক যেমন শুরুতে রাজাও খাজনা, ট্যাক্স, সেলামি বা পুণ্যাহসহ বিভিন্ন নামে চাঁদা তোলেন। কিন্তু প্রজাদের জন্য এর কিছুই খরচ করেন না। কিন্তু কোনো সাম্রাজ্যের সম্রাট আরো বেশি চাঁদা তোলেন হয়তো। কিন্তু ওর বিরাট অংশ তিনি সিভিল ইউটিলিটি মানে পাবলিকের জন্য রাস্তাঘাট, নিরাপত্তা বা পানির ব্যবস্থা নির্মাণে ব্যয় করেন। এ জন্য এম্পায়ার রাজার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য- তারা দু’জনই জোর করে বসা শাসন ক্ষমতা হলেও এর মধ্যে মাত্রার পার্থক্য রয়েছে।
সারকথা হলো, পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা বলে একটি ব্যাপার আছে। গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা আমেরিকা এত দিন সে দায় ও ভূমিকা পালন করেছে, অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছে আরো সুবিধা পাওয়ার জন্য। এখন গ্লোবাল নেতাগিরি ঢলে পড়লে নেতার সবার আগে যে সামর্থ্যে টান পড়ে তা হলো- এ ‘পজিটিভ এম্পায়ারের খরচ করার ভূমিকা।’ আর ঠিক ততটাই যেন নতুন বা আসন্ন গ্লোবাল নেতাও ওই ভূমিকাটা পালনের যোগ্য হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ চীন সেই ‘পজিটিভ এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা’ নেয়ার অনেক যোগ্য এখন!
তাহলে? দুনিয়া এখন কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবলে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। কে কত দিন আর কিভাবে বাঁচে তা অজানা। গ্লোবাল অর্থনীতি ক্রমেই দেবে গিয়ে ঢলে পড়ছে। গ্লোবাল অবকাঠামো ব্যাংকগুলো তা ঠেকাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েই যাচ্ছে। সবারই একই লক্ষ্য রিকভারি- মানে পরিস্থিতি সামলে আবার জেগে ওঠার চেষ্টা। অর্থাৎ ভাইরাসের উপরে আধিপত্য বিস্তার করা, অন্তত কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা খাড়া করা। সোজা কথায়, ব্যাপক হারে উপযুক্ত টিকা বিতরণ হতে পারে একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু গাফিলতি, অযোগ্যতা, পরিকল্পনায় মারাত্মক ত্রুটির কারণে টিকাকরণে যতই দেরি হচ্ছে ভাইরাস ততই নিজেকে আরেক রূপ বা ভ্যারিয়েন্টে হাজির করার সুযোগে দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। অর্থাৎ দ্রুত ও একসাথে সবাইকে (জনগণের অন্তত ৭০ ভাগ) টিকা দিয়ে শেষ করাই একমাত্র জেতার পথ।
আর এখানেই গ্লোবাল নতুন বা পুরনো নেতার একটি ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়ার আছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার তা আসলে একটি পরিমাপক, কে দুনিয়ার যোগ্য নেতা, আর কার দিন ফুরিয়েছে। কারণ প্রচুর পরিকল্পনার ব্যাপার এখানে আছে। আগে বিনিয়োগের প্রয়োজন। যেমন গবেষণায় বিনিয়োগের ব্যাপার তো আছেই। সেই সাথে এরপর ওই লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন এবং সুষ্ঠুভাবে টিকা বিতরণে বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটির একটি ব্যাপার আছে। এখন ওপেন কোশ্চেন করা যাক, এ কাজে গ্লোবাল নতুন বা পুরনো নেতার একটি ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়াতে কে বেশি যোগ্য?
প্রথমত, আগের ডোনাল্ড ট্রাম্প তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে স্বীকারই করেননি যে এটি একটা মহামারী ও সমস্যা। মাত্র এ বছরের শুরুতে জো বাইডেন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় আসার পরে এটি আমেরিকানদের জন্য প্রথম ও উপযুক্ত মনোযোগ পায়। বলাবাহুল্য গ্লোবাল রোল দূরে থাক আমেরিকা নিজ জনগণের প্রতিই ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং ভাইরাসকে দুনিয়ায় বিস্তার লাভ করতে যেন পরোক্ষে সাহায্য করেছে।
এরপর বাইডেন কথিত কোয়াডের মিটিং ডাকলেন। সদস্যরা সবাই বিশেষ করে ভারত লাফিয়ে উঠে এখানে প্রধান নায়কের ভাব ধরে। চীনের বিপরীতে ভারত যেন গ্লোবাল নতুন নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়ার বেশি যোগ্য- খামোখা এই অমূলক হামবড়া ভাব নেয়। বাইডেন পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করছিলেন, তিনি মূলত দ্রুত কেবল আমেরিকান নাগরিকদের টিকাকরণের জন্যই এসেছিলেন যাতে এ খাতে জাপানি বাড়তি বিনিয়োগে ভারতের টিকা উৎপাদনের সমতা তিনি আমেরিকানদের জন্য কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু ততই চীনকে পরাজিত দেখানো আর বাস্তবে হোক না হোক চীনের চেয়ে ভারতকে যোগ্য দেখানোর জন্যই দিল্লি চাপাচাপি শুরু করে। আর ভারত এর এক মুখরোচক নাম দেয়- ‘টিকা কূটনীতি’ যা অবাস্তব তো বটেই, প্রয়োজনীয়ও ছিল না। শেষে বাইডেন মিথ্যা হলেও কোয়াডের হয়ে এশিয়াকে ‘টিকাদাতা’ হিসেবে হাজির হওয়ার বানোয়াট কথা দিতে রাজি হয়ে ওই সভা শেষ করেন।
আজকের বাস্তবতা হলো আমেরিকা ভারতের টিকা পায়নি বা নেয়নি। তবে বাইডেন অন্যান্য উৎস থেকে টিকার সংগ্রহ বাড়াতে সম হন। আর এ দিকে ভারত আমাদের দেশের বেক্সিকোর মাধ্যমে ভারতীয় টিকা পেয়ে যাচ্ছে সাথে নগদ লাভও হচ্ছে, এই মিথ্যা বাস্তবতা খাড়া করেছে। এতে আমাদের চীনা টিকা ও লাইসেন্স পাওয়া ভণ্ডুল করে দিতে তারা সমর্থ হয়। কারণ আমরা সময়মতো সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছি। আর এখন ভারতের জন্য কঠিন বাস্তবতা হলো, বিদেশের কাউকেই তার টিকা দেয়ার সামর্থ্য নেই। তার পরও ভারতের নিজ জনগোষ্ঠীর সবাইকে টিকা প্রায় দুই বছরে দিতে পারবে কি না সন্দেহ। তার মানে নিজ জনগোষ্ঠীকেই টিকাকরণ করতে সামর্থ্য নেই ভারতের। তাই ভারত এরই মধ্যে বাইরে থেকে টিকা আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তা হলে আমেরিকা ও বাংলাদেশসহ সারা এশিয়াকে টিকা কূটনীতিতে ছেয়ে ফেলার যে হুঙ্কার এই ভারত এটি কেন দিয়েছিল? এতেই প্রমাণিত হয়, গ্লোবাল নতুন বা পুরনো নেতার একটি ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়ার কাজটি ভারত বুঝে বলে আমাদের মনে করার কারণ নেই।
তা হলে ওই পরিস্থিতিতে টিকা বা টাকা ফেরত কোনোটাই না পেয়ে বাংলাদেশের কোথায় যাওয়ার বাকি ছিল কি? আমেরিকার কাছে?
আগেই বলেছি, টিকা উৎপাদন গরিব-বড়লোক বলে ভাগ হয়ে আছে। আমেরিকায় উৎপাদিত টিকা বিনা পয়সায় দিলেও আমাদের কাজে লাগানো কঠিন। তবু আমাদের প্রায় এক ডোজ নেয়া ১৩ লাখ গ্রহীতা বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। কারণ ভারত তাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়নি; কখনো দেবে, সে সম্ভাবনাও নেই। আবার অন্য উৎস থেকে আমেরিকার হাতে প্রায় পাঁচ কোটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা মানে আমাদের মতো একই টিকা থাকার কথা। সেখান থেকে মাত্র ওই ১৩ লাখ ডোজ আমরা চেয়েছিলাম, কিন্তু আমেরিকাও কোনো সাড়া দেয়নি।
তা হলে এখন ‘চীন ভরসা’ ছাড়া আমাদের টিকা পাওয়ার উপায় কী? এটিই সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা। আর এই দুরবস্থায় আমাদের ফেলেছে ভারত ও তার হামবড়া ভাব! অতএব টিকা পেতে হলে আমাদের আগের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য চীনের কাছে গিয়ে ‘স্যরি’ বলে আবার তাকে রাজি করানো ছাড়া উপায় কী? বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটিসহ সব কিছুতেই আমাদের ঘাটতি আছে। আর ঠিক বিপরীতে চীনের সেই এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা নেয়ার সামর্থ্য আছে। এটিই বাস্তবতা।
অনেকের মনে হতে পারে, আমরা স্পুটনিক টিকা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। এটিও বাস্তবতার খবর না নিয়ে বলা। রাশিয়ার কাউকে টিকা উৎপাদন করে দেয়ার সমতা নেই। তাদের কারখানা ‘ওভার অকুপায়েড’। এ ছাড়া দিতে পারলেও সে টিকার দাম পড়বে ১৫ ডলারেরও বেশি; কারণ তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। এ ছাড়া কৌশলগত দিক থেকে চীন না করে দিলে সে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত রাশিয়া আর নেবে না। তাদের কৌশলগত সম্পর্ক এ রকমই। আর বাস্তবতা হলো, লাইসেন্সের নিশ্চয়তার প্রসঙ্গে, চীনের হাতে (সরকারি নিয়ন্ত্রণে চীনা প্রাইভেট কোম্পানি) বাংলাদেশে উৎপাদনের জন্য রাশিয়া সহজেই লাইসেন্স দিতে রাজি হবে। নইলে নয়। কাজেই আগামী চার মাস নিয়মিত চীনে তৈরি করা টিকার সাপ্লাই পাওয়া আর ওই চার মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নিজেদের অন্তত দু-তিনটি প্রাইভেট কোম্পানিকে টিকা উৎপাদনে যোগ্য করে দিয়ে তাদের দিয়ে নিজ উৎপাদন ইত্যাদিতে চীনকে রাজি করতে পারলেই টিকা দ্রুত পাওয়া সম্ভব।
সোজা কথা চীনের এই গ্লোবাল এম্পায়ার ভূমিকাটাই আমাদের জন্য কাম্য ও মুখ্য। এখন চীন যদি আমাদের কাছে বিনিময়ে নিশ্চয়তা চায় যে, আগের মতো আমাদের আবার পা পিছলাবে না। ভারত বা আমেরিকার কাছে লোভে ফাঁসব না আমরা- চীন সেই গ্যারান্টি যদি চায় তা হলে কী হবে? সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে চীন সে নিশ্চয়তা আমাদের কাছে চাইতেই পারে। এটি তার অধিকার।
এখন প্রথমত বিচার করুন আমাদেরকে চীনের কাছে ফিরে হাত জোড় করে অনুরোধ করার ভূমিকায় দাঁড় করাল কে? ভারতের ভুয়া আশ্বাস ও প্রফিটের শেয়ারের লোভ। আর সেই সাথে কোয়াড, টিকা কূটনীতি এসব ফাঁকা বোলচাল। অথচ গ্লোবাল নেতার একটি ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়া- এ মুরোদ আমেরিকাসহ কোয়াডের কারোই আমরা দেখলাম না!
শুধু কল্পনা করুন, ঈদের পরের ঢাকায় কোভিডে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা যদি বেড়ে যায়, সেই সাথে ভারতীয় ধরনের ভাইরাস যদি ছড়িয়ে যায়? এ দিকে দেশে ইতোমধ্যে টিকা পাওয়া লোকের সংখ্যা মাত্র দু-তিন পার্সেন্টের মতো, তখন আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? আমাদের অতি উৎসাহী প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকান লোকজন আমেরিকার কাছে নালিশ নিয়ে গিয়েছিলেন, ‘কোয়াড’ এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে বলে চীন মন্তব্য করেছে। আর এতে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া হলো ‘চীনের রাষ্ট্রদূত যে মন্তব্য করেছেন, তার ওপর নজর আছে যুক্তরাষ্ট্রের’। এখানেই শেষ। তা হলে আমরা টিকা পাবো কী করে? সেটি কি আমেরিকা বা ভারত অথবা এই অতি উৎসাহী প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের আছে? এ নিয়ে তাদের বক্তব্য কী? আমরা শুনি না।
ব্যাপারটা হলো, বাংলাদেশ চীনের কাছে ফিরে টিকা চাইতে যাচ্ছে এমনই খারাপ অবস্থায়, যখন চীনের কাছে আমাদের কোনো পজিটিভ ইমেজ নেই। কারণ আমরা চীনের আগের অফারের অবজ্ঞা, অপব্যবহার করেছি কোনো সদুত্তর ছাড়াই। কাজেই চীন আমাদের আগের আচরণের বিরুদ্ধে এবার নিশ্চয়তা চাইতেই পারে!
আর এ ঘটনাকে বিবিসি রিপোর্ট করেছে, ‘এ ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা কাবে যুক্ত হওয়াটা ভালো নয়। বাংলাদেশ এতে যুক্ত হলে তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে।’ আর প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকান লবিস্টরা এটিকে ব্যাখ্যা করছেন ‘চীনা হুমকি’ হিসেবে। অথচ বিবিসির রিপোর্টে ‘হুমকি’ বলে কোনো শব্দই নেই। এর মানে এটি লবিস্টদের ব্যবহৃত নিজস্ব শব্দ ও ব্যাখ্যা।
কেউ কেউ লিখছেন, তারা বিস্মিত হয়েছেন। আর আমরা তাদের আচরণ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। তারা টিকা পাওয়ার কোনো পাল্টা উৎস বা প্রপোজাল কি দিয়েছেন? একমাত্র অবজেকটিভ চোখেই কোয়াড, টিকা পাওয়া ইত্যাদির ভালো-মন্দ বিচার করার মতো যদি আমাদের অবশিষ্ট কিছু যোগ্যতা থাকে, তবেই হয়তো আমরা এ যাত্রায় পার পেতে পারি!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]