- গোলাম মাওলা রনি
- ২৯ এপ্রিল ২০২১
জীবনে এমন একটা সময় ছিল যখন কবি হওয়ার জন্য রীতিমতো হা-পিত্যেস করতাম। বড় বড় কবির কবিতা মুখস্থ করতাম- কবিদের জীবনী পড়তাম এবং নিজের মধ্যে কবি কবি ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য গ্রামবাংলার ঝোপঝাড়-পাটক্ষেত কিংবা নদীর পাড়ের নির্জনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। আমার এই কবি হওয়ার বাসনা শুরু হয়েছিল সেই ছয়-সাত বছর থেকে এবং অবিরত ছিল ২০১৩ সাল অবধি। এরপর আমি আর কবি হতে চাইনি এবং কোনো কবিতা পড়িনি। কবিত্ব লাভের সুদীর্ঘ চেষ্টার ফলে আমার অন্যান্য প্রতিভা বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং কতগুলো নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পর নিজের অজান্তে এক ধরনের হাহাকার নিয়ে নিজের সাথে জেদ করে ২০১৩ সালে দুই লাইন কবিতা লিখে ফেলেছিলাম। ওই কবিতার যন্ত্রণায় আমি শ্রীঘর দর্শনের সুযোগ পেয়েছিলাম এবং সত্যিকার কবিদের মতো ভোগবাদী সমাজের লোভ লালসা ত্যাগ করে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় চলে আসতে পেরেছিলাম।
কবিতা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত পাঁচালী আপনাদেরকে বলার উদ্দেশ্য হলো, সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ঘটনাবলি। সৈয়দ শামসুল হকের একটি কবিতার কারণে আমি প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ ঘুমাতে পারিনি। সৈয়দ হকের নূরলদীনের সারা জীবন কবিতাটি আমি প্রয়াত আলী জাকেরের কণ্ঠে শুনে রীতিমতো অভিভ‚ত হয়ে পড়ি। একই কবিতা বহুজনের কণ্ঠে সহস্রবার শুনেছি। কিন্তু আলী জাকেরের মৃত্যুর পর যখন তার বিভিন্ন শিল্পকর্ম সামাজিক মাধ্যমে ভাসছিল তখন হঠাৎ করেই তার আবৃত্তি করা কবিতাটি আমার নজরে আসে। কবিতাটি শুনতে শুনতে যখন আমি চলমান সময়ের চিত্রপট, মানুষের চাপা আর্তনাদ এবং রাতের আকাশের চাঁদ-তারা-ছায়াপথের কথা ভাবি তখন স্থির থাকতে পারি না। বিশেষ করে মুনিয়া নামক অতি সুন্দরী এক কিশোরীর নির্মম মৃত্যুর পর এক রাতে দেখি আকাশে মস্তবড় চাঁদ জোসনা ছড়াচ্ছে। যে রাতে মুনিয়া মরল তার পরের দিন সারা বাংলাদেশে সূর্যের উত্তাপ ছিল প্রায় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কবিতায় বর্ণিত নষ্ট বীজ এবং নষ্ট সংসার শব্দমালার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং মুনিয়ার মৃত্যুর কার্যকারণ যখন মেলানোর চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন চাঁদের আলো আমার কাছে যে কতটা বিষাক্ত বলে অনুভ‚ত হচ্ছিল তা আপনাদের কাছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মুনিয়া নামক কিশোরী যেভাবে এবং যে প্রেক্ষাপটে মারা গেল এবং তার মৃত্যুর পর দেশবাসীকে এমন কিছু শুনতে এবং দেখতে হচ্ছে যাতে মনে হয়, এই নষ্ট পরিবেশে পূর্ণিমার চাঁদের আলো একেবারেই বেমানান।
আমাদের দেশে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই বিচারহীনতার এমন সব ভয়াল নজির তৈরি হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের সর্বত্র অপরাধ প্রবণতা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। আমাদের দেশে কোনো সঙ্ঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা রাষ্ট্রীয় অর্থে কেনা চিনি-লবণ-ঢেউটিন অথবা কম্বল চুরি করেনি। আমাদের দেশে কোনো চোর-ডাকাত বা সন্ত্রাসীরা ক্রসফায়ার-গুম-প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে উল্লাস নৃত্য করেনি। কোনো রাজাকার-আলবদর বা পাকিস্তানি হানাদার ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোট র্যাগিং, বিনাভোটের পাতানো নির্বাচন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার দৃশ্য পয়দা করেনি। আমাদের দেশে সেই আদিকাল থেকে বর্গিরা, মীর জাফররা, লর্ড ক্লাইভরা, ইংরেজ অথবা পাকিস্তানিরা দেশের কেন্দ্রীয় রাজভাণ্ডার লুট করেনি। ফলে বাংলাদেশের গত এক শ’ বছরের ইতিহাসে অপরাধ এবং অপরাধী সম্পর্কে জনমনে যে ধারণা ছিল তা এখন সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গেছে।
সৈয়দ হকের কবিতার মতো যদি কোনো দেশের মাটি-বাতাস-পানি নষ্ট হয়ে যায় তবে সেখানে নষ্ট ফসল পয়দা হবে। আবার নষ্ট ফসলের দ্বারা যে বীজ উৎপন্ন হয় তাও নষ্ট এবং বিষাক্ত হয়ে থাকে। বিষাক্ত বীজের উৎপন্ন ফসল যারা ভক্ষণ করে তারাও নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে নষ্টের পরিধি যখন সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রকে গ্রাস করে তখন আকাশের লক্ষ তারা এবং পূর্ণিমার চাঁদের আলো নষ্টামি থেকে জনজীবনকে রক্ষা করতে পারে না। অর্থাৎ নষ্ট সমাজে বিধাতার আশীর্বাদও বিফলে পর্যবসিত হয়।
আমাদের জাতীয় নষ্টামির শুরুটা হয়েছে বিচারহীনতা থেকে। আমরা যেমন সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে দেখিনি তেমনি কুমিল্লার একটি সংরক্ষিত এলাকায় খুন হওয়া তরুণী তনুর হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা তদন্ত প্রতিবেদনও দেখিনি। আমরা যেভাবে সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বেখবর, তেমনি চৌধুরী আলম-ইলিয়াস আলী প্রমুখের গুম হওয়া সম্পর্কে কোনো খবর জানি না। আমাদের কাছে যদি কেউ হেফাজতের শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারীর প্রাণহানির সংখ্যা সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে চায় তবে আমরা সেগুলো শোনার মতো সৎ সাহস রাখি না।
খুন-খারাবি, চুরি-চামারি, প্রতারণা এবং অবৈধ ক্ষমতার মোহ সেই অনাদিকাল থেকেই সারা দুনিয়াতে ছিল। কিন্তু এসব কুকর্ম যখন ঘৃণিত না হয়ে সমাজ সংসারের প্রশংসিত হয় এবং কুকর্মকারীরা তাদের কৃতকর্মের জন্য যখন পুরস্কৃত হতে থাকে ঠিক তখনই ধরে নেয়া হয় যে, ভ‚খণ্ড নষ্ট হয়ে গেছে এবং ভ‚মির সেই নষ্টামিতে প্রকৃতি ও পরিবেশের সব কিছু লণ্ডভণ্ড না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু স্বাভাবিক হয় না।
আমাদের দেশে নষ্টামি কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা বোঝার জন্য ঢাকার একটি পাঁচতারা হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট ভাড়া করে পাপিয়া নামের ক্ষমতাসীন দলের এক মহিলা পান্ডী যে মধুকুঞ্জ খুলে বসেছিল সেই কুঞ্জের ভ্রমররূপী খদ্দেরদের তালিকা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য, বিলাসিতা, অবাধ অপকর্ম করার দুঃসাহস ইত্যাদি পর্যালোচনা করলেও পরিস্থিতি আন্দাজ করা যাবে। দুরাচার ব্যবসায়ী, নীতিহীন এবং অভব্য ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী, অপরাধী প্রকৃতির রাজনীতিবিদ এবং লোভী স্বার্থপর সুযোগ সন্ধানী এবং ভীরু জনগণ যখন যুগপৎভাবে নষ্টামি শুরু করে তখন শত সহস্র চাঁদের আলো দিয়েও সেই নোংরামি দূর করা যায় না।
আমাদের নদ-নদী-ক্ষেত এবং বীজ কতটা নষ্ট হয়ে গেছে তা মুনিয়ার মারা যাওয়ার ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। এই মৃত্যু নিয়ে রাজপথে নারীবাদীরা বিচার চেয়ে মিছিল বের করেনি। বুদ্ধিজীবীরা আঙ্গুল উঁচিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে গাল ফুলিয়ে বড় বড় কথা বলেনি। অপরাধী ধরার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা মামুনুল হক নামীয় হেফাজত নেতার তৃতীয় স্ত্রীর বিয়ের দলিল খুঁজতে যেভাবে ঘাম ঝরিয়েছে তার ফলে তাদের জন্য যখন একটু অবকাশ জরুরি হয়ে পড়েছে ঠিক তখন মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশের সুরুতহাল রিপোর্ট নিখুঁতভাবে করাটা সত্যিই কষ্টকর। মুনিয়ার মৃত্যুর জন্য যাদের দায়ী করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লেও ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো কিন্তু সেভাবে নড়ছে না যেভাবে মামুনুলকে গ্রেফতারের জন্য নড়াচড়া করেছিল।
আমরা আজকের আলোচনার একেবারে প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। আলোচনার শুরুতে আমার কবি হবার কসরৎ এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে বলছিলাম। যদি কবি হতে পারতাম তবে কবি শঙ্খ ঘোষের মতো মুনিয়াকে নিয়ে একটি কবিতা লিখতাম। সেই কবিতায় মৃত্যুর আগে মুনিয়ার মনের অনুভ‚তি, চোখের অশ্রæজল এবং হৃদয়ের আকুতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। মুনিয়ার অভিমান, না বলা কথা এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা কিভাবে ফাঁসির দড়িতে এসে মিশল তাও আমার কাব্যপ্রতিভা দিয়ে ফুটিয়ে তুলতাম। সুদূর কুমিল্লা থেকে কিশোরী মুনিয়াকে কোন চক্র কিভাবে এবং কেন উপহার হিসেবে কৌশলে অভিযুক্ত আসামির মনোরঞ্জনের জন্য নিয়ে এসেছিল তা নিয়েও পদ্মাবতী স্টাইলে কিছু কবিতা লিখে ফেলতাম।
যারা মুনিয়াকে ভোগ করেছে এবং ভোগের পর ছুড়ে ফেলে দিয়েছে তাদের মানসিক বিকৃতি বুঝানোর জন্য আমি কবিতার ভাষায় দুই চারটি ছন্দ রচনা করতাম। মুনিয়ার সংগ্রাম, বেঁচে থাকার আকুতি এবং তার অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য আমি কবি দেবব্রত সিংহের কবিতা তেজের মতো করে কিছু একটা রচনা করতাম। মুনিয়া কি আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে তাও আমার কাব্যপ্রতিভা ঠিকই খুঁজে বের করত যেভাবে রবীন্দ্রনাথ তার কর্ণকুন্তী সংবাদ কবিতায় অর্জুন জননী কুন্তী এবং মহাবীর কর্ণর কথোপকথন রচনা করেছেন। যদি মুনিয়াকে হত্যা করা হয়ে থাকে তবে হত্যাকারীর কৌশল, হত্যার উদ্দেশ্য এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহসের ইতিবৃত্ত নিয়েও কবিতা রচনা করতাম। যেহেতু আমার কাব্যপ্রতিভা নেই তাই মুনিয়ার বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এই নিবন্ধের ইতি টানা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য