ফরহাদ মজহার
‘মাফিয়া’, ‘মাফিয়াতন্ত্র’, ‘মাফিয়া স্টেইট’ ইত্যাদি নানান পরিভাষা আল জাজিরার প্রতিবেদনের পর আমাদের কানে আসছে। পরিভাষাগুলোর মানে কী? এগুলো কি স্রেফ নিন্দা প্রকাশক বুলি, নাকি তারা সিরিয়াস রাজনৈতিক বর্গ (Category)? এই বর্গগুলোর গভীরে না গিয়ে ভাসা ভাসা উপরিতিলের উত্তেজনা দিয়ে কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কোন বদল আমরা ঘটাতে পারব? সকলকে বিনয়ের সঙ্গে ভাবতে বলব।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি মিডিয়া সংঘবদ্ধ ভাবে আল জাজিরার বিরুদ্ধে প্রচার করছে। মজার দিক হোল, আল-জাজিরার প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে তর্ক নয়, বরং তর্ক হচ্ছে আল জাজিরা কতো খারাপ তা নিয়ে। যেমন আল জাজিরা কতো দেশে দেখানো হয় না, নিষিদ্ধ, ইত্যাদি। অনেকে আবার বলছে, কাতার কতো খারাপ দেশ, অতএব আল জাজিরাও নিশ্চয়ই খারাপ হবে। এইসব।
কিছু চেনা টেলিভিশন শাপলা চত্বর নিয়ে তাদের মিথ্যা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে আল জাজিরার ভূমিকা আমাদের ফের মনে করিয়ে দিচ্ছে। খারাপ কি? ভালোই হচ্ছে। যেহেতু সেই সময় আল জাজিরার প্রতিবেদন শাপলা চত্ত্বরের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়ার ইসলাম বিদ্বেষী প্রপাগাণ্ডার জবাব হিশাবে কাজ করেছে, তাই পুরানা কথা তোলার মানে নিজের ময়লা নিজে ঘাঁটা। মিডিয়ার এইসব কাণ্ডের ফলে আল জাজিরার প্রতিবেদন আরো ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।
পাশাপাশি মিডিয়াগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। যে মাফিয়া গোষ্ঠির স্বার্থ তারা এতোদিন রক্ষা করে এসেছে, সেই গোষ্ঠি তাদের আগামি দিনেও রক্ষা করতে পারবে কিনা, জানি না। তবে তাদের প্রচারের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা নিশ্চিত যে এবারও তারা পার পেয়ে যাবে। বিদ্যমান ব্যবস্থাই, অর্থাৎ ক্ষমতার বর্তমান ভারসাম্যই বহাল থাকবে।
তবে এই তুলকালাম কাণ্ডের মধ্যে জাতিসঙ্ঘের একজন মুখপাত্র বলেছেন, নজরদারির যে ইসরায়েলি টেকনলজি বাংলাদেশ হাঙ্গেরি থেকে কিনেছে,পিস মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর এইরকম কোন টেকনলজি ব্যবহৃত হয় নি বা হয় না: “Such equipment has not been deployed with Bangladeshi contingents in United Nations peacekeeping operations,”। আল জাজিরারা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘ এ কথা পরিষ্কার বলল। আল জাজিরারা প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বাংলাদেশ বলেছেঃ “প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে” নজরদারির ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছে, আল জাজিরা যা উল্লেখ করেছে। জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্রের এই বক্তব্যের পরে পুরা ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক স্তরে চলে গিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি যথারীতি বলেছেন, “দুর্নীতির এই অভিযোগ খুবই সিরিয়াস বিষয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা অবশ্যই তদন্ত করে দেখতে হবে”।
আমি গণক নই, তাই জানি না এ সবের নীট ফল কি হবে। আন্তর্জাতিক বাস্তবতা এখনও অপরিচ্ছন্ন, কারন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে ফ্রেমের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে পরাশক্তিগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে কোন বড় ধরণের হেরফের ঘটে নি। বাংলাদেশের আভ্যনন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে সবই নির্ভর করবে সাধারণ মানুষের সচেতনতার ওপর। কিন্তু নিছক সচেতনতা অবস্থার রূপান্তর ঘটায় না। তাই বলা উচিত, নির্ভর করবে সব কিছু বোঝার পর জনগণের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ধরণ এবং সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের চরিত্রের ওপর। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থা বদলের জন্য সঠিক নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের সক্ষমতা আমাদের আছে কিনা সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
অগ্রগামি রাজনৈতিক চিন্তার লক্ষণ বাংলাদেশে নাই বললেই চলে। বলছি কারন খুবই গোড়ার প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা নাই। যেমন বর্তমান মাফিয়া কবলিত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের রাজনৈতিক লড়াইয়ের ধরণ কেমন হবে? কি ধরণের আদর্শ, বয়ান,নীতি বা কৌশল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে? ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক, রাজনৈতিক ও ব্যবহারিক প্রশ্ন।
ব্যাপারগুলো নিয়ে গভীর ভাবে ভাবুন ও বিচার করে দেখুন। যেমন ‘মাফিয়া’ ব্যাপারটা আসলে কী?, “মাফিয়াতন্ত্র’ কি? কিম্বা ‘মাফিয়া স্টেইট’ বা ‘মাফিয়া রাষ্ট্র’ কথাটারও বা মানে কী? এইসব নিয়ে খুব একটা আলোচনা নাই। ট্যাগ মেরে আমরা মনে করি,সব বুঝে গিয়েছি! ব্যাপারটা এতো সিধা নয়।
সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাবার পর নতুন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য প্রপাগান্ডার ভাষা হিশাবে ‘মাফিয়া স্টেইট’ কথাটা পাশ্চাত্যে চালু হয়েছে। এটি কোন পরিণত রাজনৈতিক পরিভাষা নয়। কিন্তু নিউ লিবারেল বিশ্বব্যবস্থায় ‘মাফিয়া স্টেইট’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারনা। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্রিমিনাল বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য এই প্রকার ধারণা ও বর্গ আমাদের দরকার। আধুনিক রাষ্ট্র পত্তনের গোড়া থেকেই মাফিয়া বা অপরাধী চক্র নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছে। বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ শক্তিকে দমন করবার ক্ষেত্রে মাফিয়া চক্রের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর কেতাবাদি গবেষণা আছে। জনগণের প্রতিটি সংগ্রামী আন্দোলন দমন করবার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন শ্রেণী মাফিয়া বা অপরাধী চক্রদের ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশেও তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।
ইন্টারেস্টিং দিক হোল, কিভাবে ‘মাফিয়া’কে কালচারালি বা সাংস্কৃতিক ভাবে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। আমরা একসময় দেখলাম,‘গড ফাদার’ উপন্যাস ও সিনেমা মাফিয়াদেরই মূলত মহিমান্বিত করেছে। মাফিয়া এ কালে এক ধরণের ট্রাজিক হিরো বা ‘বীর’ হিশাবে হাজির। সিনেমা, টিভি-সিরিয়াল বা নাটকে তো অবশ্যই। তরুণদের চেতনায় ‘মাফিয়া’ কতোটা মহিমান্বিত হয়ে বিরাজ করছে সেটা বুঝব নেটফ্লিক্সের ‘নারকোস’ সিরিজ/সিনেমার প্রধান চরিত্র এস্কোবারের জনপ্রিয়তা দেখে। ফেইসবুকের প্রফাইল ছবি হিশাবে বাংলাদেশের তরুণদের বেশ বড় একটা অংশকে আমি এস্কোবারের ছবি ব্যবহার করতে দেখেছি। এর মনস্তাত্ব্বিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
এটা পরিষ্কার আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মাফিয়া বা অপরাধী চক্রের সম্বন্ধ বিচারের দিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান যারপরনাই পিছিয়ে রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মাফিয়া বা অপরাধী চক্র সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে,যদিও পাশ্চাত্য এই সত্য চিরকাল আমাদের কাছে আড়াল করে রাখে এবং রাখতে সক্ষমও হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা পাশ্চাত্যের অতি নিম্ন স্তরের অনুকরণের অধিক কিছু না। আমাদের বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম।
আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়া পত্তনের শুরু থেকে এবং পাশাপাশি মাফিয়া বা অপরাধী চক্রের ভূমিকা যেমন ছিল তার সঙ্গে বর্তমান নিউ-লিবারেলে বা কাছাখোলা অবাধ বাজার ব্যবস্থায় মাফিয়া গোষ্ঠির ভূমিকা এক রকম নয়। গুণগত তফাত রয়েছে। দুই হাজার আট সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর মাফিয়া পুঁজির ভূমিকা আরও শক্তিশালী এবং বিশ্বব্যাপী সবল হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির ‘ফাইন্যন্সিয়ালাইজেশান’ তার একটা কারণ,একই সঙ্গে কমিউনিকেশানের ডিজিটাইলেজেশানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কালো টাকা সাফ করা তুলনামূলক ভাবে আগের চেয়ে সহজ। মূহূর্তে কোটি কোটি ডলার পাচার করাও সহজ।
মাফিয়া বা অপরাধী চক্রের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগসাজশ থাকা নতুন কিছু না। যারা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ‘গড ফাদার’ দেখেছেন, সেই সম্পর্ক আবার বুঝতে চাইলে তারা আবার ‘গডফাদার’ দেখুন। সহজেই বুঝবেন। যারা দেখেন নি, দেখে নিন। এই ছকে বলিউডও মেলা ছবি বানিয়েছে। ধনিদের রাজনৈতিক দল সব সময়ই মাফিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকেই ক্ষমতা চর্চা করে। আমেরিকান মাফিয়াদের ইতিহাস নিয়েও ভাল বই আছে,পড়ে দেখতে পারেন।
এটা ভাল যে আল জাজিরারা বিরুদ্ধে বাংলাদেশী মিডিয়া গুলোর অপপ্রচার কোন ফল দিচ্ছে না। এই দকটা অন্তত পরিষ্কার। সাধারণ মানুষ এই সকল মিডিয়ার ওপর আরও ক্ষিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু শেষমেষ ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাব কিনা বলা যাচ্ছে না।
আল জাজিরার প্রতিবেদনটি প্রচারের সময়টা বেছে নেওয়া,আমার খুব পছন্দ হয়েছে। যেমন,মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় এবং ডেমোক্রাটদের ক্ষমতায় আসার পর প্রচার। অনুমান হচ্ছে রিপাব্লিকান দল ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শক্তি্র পেছন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকে বা থাকবে, এই ধরণের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টে কোন ফল হবে না। এই ধরনের প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কোন ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। অতএব মার্কিন নির্বাচন এবং জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে।
যদি আল জাজিরা আসলেই এটা করে থাকে তাহলে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বাংলাদেশের পরাশক্তিগুলো এক এগারোর পর থেকে কী ধরণে মাফিয়া রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পেছনে মদদ দিয়েছে সেটা এখন আগের চেয়েও পরিষ্কার। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে আমরা এখন মাফিয়া গোষ্ঠি বা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র থেকে আর আলাদা করতে পারছি না।
কিন্তু তারপরও ‘মাফিয়া’,‘মাফিয়াতন্ত্র’ কিম্বা ‘মাফিয়া স্টেইট’ বা অপরাধী চক্রের অধীনস্থ রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণা আমাদের কাছে খুবই অস্পষ্ট। এই সব নিয়ে অনেক কার্যকর আলোচনার করবার বুদ্ধিবৃত্তিক হিম্মত আমাদের দ্রুত অর্জন করা জরুরী।