- মইনুল হোসেন
- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আলজাজিরার মিথ্যা তথ্য সম্প্রচারের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করতে যাচ্ছে- তাই সঙ্গত কারণে সরকার যে রেগে আছে এবং সন্ত্রস্ত রয়েছে সেটি বেশ বোঝা যাচ্ছে। আলজাজিরার এই প্রচারণায় যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্নে হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আলজাজিরার প্রচারণা ভিত্তিহীন, মিথ্যা দাবি করেছে। জাতিসঙ্ঘ ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত আছে বলে জানিয়েছে এবং প্রত্যাশা করা হয়েছে যে, আমাদের কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তদন্ত করে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্রও এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অন্য দিকে, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একধাপ এগিয়ে বলেছেন, যদি জাতিসঙ্ঘ ব্যাপারটি তদন্ত করে তবে তাতেও আপত্তি নেই। বলিষ্ঠ মন্তব্য সন্দেহ নেই।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎসে থাকা লোকদের অনুগত রাখা অথবা পেশাজীবীদের দলীয় অ্যাক্টিভিস্ট বানিয়ে দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত করার দিন শেষ করতে হবে। আনুগত্য কেনাবেচা করা বন্ধ রাখতে হবে। আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে পুলিশ এমনকি সামরিক বাহিনীকে সরকারের ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এ ধরনের চিন্তাভাবনা একেবারেই অচল এবং অবমাননাকর। এভাবে স্বৈরশাসন জনগণের বিপরীতে শক্তি অর্জন করে।
বাংলাদেশে আমরা যৌথভাবে দুর্নীতি করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। এখানে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা আমাদেরকে বলার জন্য আলজাজিরা বা বাইরের কারো প্রয়োজন নেই। দুর্নীতির কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। লুটপাটের কথা সরকারও স্বীকার করে। অসুবিধা হলো বড় বড় দুর্নীতিপরায়ণদের নাম প্রকাশ নিয়ে।
এটাও অজানা কিছু নয় যে, বড় বড় দুর্নীতির সাথে ভয়ঙ্কর নৃশংসতা হাত ধরাধরি করে চলছে। আমাদের গণমাধ্যমেই হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করার কথা প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাগুলো কিভাবে সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে তাও সরকারের অজানা নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার সবাইকে সতর্ক করছে। কিন্তু দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। নিখোঁজ, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর জাতীয় সংবাদপত্রে বা প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ কম হয়নি। কেবল ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নামধাম উল্লেখ করা হচ্ছে না। কারণ সত্যি সত্যি চারিদিকে ভীতিপ্রদ অবস্থা বিরাজ করছে।
মানুষদের ভয়ে থাকতে হচ্ছে কখন গুম হয়ে যাবে, কখন পুলিশের দেয়া মিথ্যা মামলায় পড়ে জেলে যেতে হবে। ড্রাগস, বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা বেড়েই চলেছে। শত শত বেকার যুবক ইয়াবা লেনদেনের সাথে জড়িত থাকা সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলার চাপ সামলাতে কোর্টগুলো হিমশিম খাচ্ছে। বেকার যুবকদের মানবিক দিকগুলো দেখার কারো অবকাশ নেই। অনেক মৌলিক অধিকারের কথা শাসনতন্ত্রে লেখা আছে। মানবাধিকার কমিশন আছে। কিন্তু মানবাধিকার প্রয়োগের প্রশ্নেই যত অনীহা। পুলিশ মামলা গ্রহণ করলেই হলো। কোর্টের হাত-পা বাঁধা পড়ল। জজ বিচারকরাই জানেন কিভাবে মিথ্যা মামলার দৌরাত্ম্য মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। হাইকোর্টের এক বিচারপতি কোর্টেই বলে ফেললেন স্পিড মানি ছাড়া কিছুই চলে না।
আমরা এ কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি যে, এসবের জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। কারণ সরকারি ব্যবস্থাটাই টিকে আছে সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি করার সুযোগের জন্য। কার্যত, ক্ষমতাধরদের একটা গ্রুপ একযোগে দুর্নীতি করে চলেছে।
দেশ ও জাতির জন্য এটা লজ্জার বিষয় যে, বাড়তি সুবিধা ভোগ করার জন্য শিক্ষিতজনরা কত সহজভাবে দলীয় অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে দুর্নীতির পূজারী হচ্ছেন। দেশের কথা ভাবছেন না। দেশ যে সবদিক থেকেই অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে তা ভাবা হচ্ছে না। জাতির মূল্যবান প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে। জনগণের অসহায় অবস্থা যেন আমরা সবাই মেনে নিচ্ছি। অথচ সুস্থ সমাজ গঠনের প্রয়োজনে পরিবর্তন আসতেই হবে।
দেশের প্রকৃত মালিক যে জনগণ এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হতে হবে তবে তার জন্য গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করে তুলতে হবে। নিকৃষ্ট ধরনের স্বৈরশাসনের অধীনে প্রহসনমূলক নির্বাচন নতুন কিছু নয়।
সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার জন্য যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখনই সেই সরকারের অংশীদার ও সুবিধাভোগী শিক্ষিত লোকের অংশবিশেষ জাতির সাথে বেঈমানি করে যাচ্ছে। আমাদের তাই এমন একটা ব্যবস্থা গড়তে হবে যা ক্ষমতায় থাকার জন্য এ ধরনের দুর্বৃত্ত ও অপরাধীচক্রের ওপর নির্ভর করবে না।
আমাদের নির্ভর করতে হবে শিক্ষিত সেসব নর-নারীর ওপর যাদের রয়েছে শক্ত মেরুদণ্ড এবং দেশের জনগণের প্রতি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মন-মানসিকতা। তারা এমন একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যেখানে নির্বিঘ্নে দুর্নীতি ও শোষণ করার সুযোগ থাকবে না। তারা এমন গণতন্ত্রের পথ বেছে নেবেন যার জন্য আমাদের এই দেশটির মানুষ যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। যারা নিজেদেরকে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষ শক্তি হিসেবে দেখেন তারা মানুষের অন্যায়-অবিচারের বিরোধী শক্তি না হয়ে পারেন না। দুঃখজনক হলেও তারা নীরব ও নিষ্ক্রিয়।
নির্বাচনবিহীন সরকার হলে বিজয় হয় আমলাতন্ত্রের। সে ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং আমলাতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা শাসন পরিচালনার সামগ্রিক ধারণাকে গ্রাস করে ফেলে। রাষ্ট্রীয় শক্তিই তাদের কাছে বড় শক্তি- মানুষ নয়।
আমরা তো সেরকম ছিলাম না। অপরিচিত রাজনীতি আমাদের রাজনৈতিক নিয়ম-নীতি ও মূল্যবোধ সবকিছু বদলে দিয়েছে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে রাজনীতি করার অধিকার সবার থাকবে, এ কথা তো অস্বীকার করা হচ্ছে না। কিন্তু পেশাজীবীরা রাজনীতিবিদ নন, তাই পেশার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। তাদের লেজুড়বৃত্তির কারণে আমাদের সুশাসনের সবগুলো প্রতিষ্ঠান এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। আর এই ক্ষতিটা হয়েছে রাজনীতিকীকরণের কারণে, পেশাজীবীদের বড় অংশই আর পেশাজীবী থাকছেন না, তারা দলীয় কর্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
জনগণবিচ্ছিন্ন শাসনব্যবস্থার কারণে সবাই ক্ষমতাসচেতন কিন্তু জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের তাগিদ খুব কমই অনুভব করেন। ফলে জনগণকে সবার কাছে অসহায় থাকতে হচ্ছে।
স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে হলে এই ভেঙেপড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার। আর এসব বিষয়ের জন্যই আমরা লড়াই করেছিলাম।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাহত করার জন্য আইনের তোয়াক্কা করতে হয় না। সংবাদপত্র থাকে মানুষের কথা বলার অধিকার হিসেবে। দেশে প্রেস কাউন্সিল আইন আছে সংবাদপত্রের ভুল-ত্রুটির কারণে সাংবাদিকদের যাতে সহজে জেলে যেতে না হয়। তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নেবে প্রেস কাউন্সিল। মানহানির মামলার নামে দণ্ডবিধির ব্যবহার করা হচ্ছে। একই মানহানির জন্য দণ্ডবিধি এবং সদ্য প্রণীত ডিজিটাল আইনের প্রয়োগ হচ্ছে। প্রেস কাউন্সিল আইন এখন অচল। প্রেস কমিশনের অস্তিত্ব থাকা-না-থাকা অবস্থায় আছে। দণ্ডবিধিতেই আছে যে, জনস্বার্থে লেখা কোনো কিছু বিদ্বেষপ্রসূত না হলে মানহানির মামলা হবে না। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা আছে, প্রতিবাদ না দিলে বলা যাবে না প্রকাশিত সংবাদের জন্য মানহানির মামলা হবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দণ্ডবিধিতে মানহানির মামলা জামিনযোগ্য। ডিজিটাল আইন করে তা বাতিল করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। আইনের সঠিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। মামলা করেছে, মামলা চলবে।
দলীয় রাজনীতির অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার কারণে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু করতে পারছেন না। যে জন্য জনগণ বিদেশী সংবাদমাধ্যমে যথা- আলজাজিরা, বিবিসি বা সিএনএনে যা-ই বলুক সেটিকেই লুফে নিচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধি দিয়ে সরকার চালালে যা হয় তা-ই হচ্ছে।
ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষিত লোকরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন তবে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব। বিবেকহীন একশ্রেণীর শিক্ষিত লোকের দাসসুলভ মনোবৃত্তির কারণে এই দেশটি মান-মর্যাদা নিয়ে স্বাধীন মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি আর পেশিশক্তির কাছে অসহায় থাকা কোনো সভ্য জাতির পরিস্থিতি হতে পারে না।