- মেহজাবিন বানু
- ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৯:৪৪
মিয়ানমার বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের একটি। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে বহু প্রজন্মের সম্পর্ক। মিয়ানমারের ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সামরিকীকরণ হওয়া সত্ত্বেও ২৭১ কিলোমিটারের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাংলাদেশের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের শুরু ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যখন মিয়ানমার, ষষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মতো বেশ কয়েকটি অমীমাংসিত সমস্যার কারণে দৃশ্যপটে প্রতিকূল পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক সবসময় প্রত্যাশিত বন্ধুত্বপূর্ণ হয়নি।
প্রতিরক্ষা কূটনীতি
একবিংশ শতাব্দীতে সামরিক কূটনীতি যুদ্ধ এবং শান্তির ঐতিহ্যগত ধারণার চেয়েও বেশি কিছু। অন্যান্য দেশের সাথে মিয়ানমারের সামরিক সম্পর্ক দেশটির দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে (Tatmadaw) বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এমন বেশ কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে দুই দেশ একসাথে কাজ করতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সম্পর্কের উন্নতি। ঘটনার নতুন মোড়কে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সাক্ষাৎ করেছে। দুই পক্ষ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে যেকোনো অভিযান পরিচালনার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, কারণ সেখানে সীমান্তরক্ষীরা দেশীয় বিরোধীদের সাথে লড়াই করছে। আকাশসীমা লঙ্ঘন ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে গোলা নিক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এসব ঘটনার জন্য মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা বাংলাদেশে তাদের প্রতিপক্ষের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
স্পেশাল অপারেশন ব্যুরোর কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফোন মায়াটের নেতৃত্বে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল গত বছর ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের সাথে সেনা সদর দফতরে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষের সময় মিয়ানমার কর্তৃক বাংলাদেশ সীমান্ত লঙ্ঘনের ফলে উত্তেজনা শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য সহযোগিতা করার আহ্বান জানান এবং দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার উপায়, পাশাপাশি সহযোগিতামূলক আলোচনা, প্রশিক্ষণ বিনিময়, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে আলোচনা করেন। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। তারা জানায়, নিজ দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা কাজ করছে।
ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সামরিক প্রতিনিধি দল বিনিময় করেছে, যা দুই দেশের জন্য তাদের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের পথ প্রশস্ত করতে পারে। কিছু সাধারণ উদ্বেগ মোকাবেলা করার জন্য উভয় পক্ষই তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা ভাগ করে নিতে পারে। দুই সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ বিনিময় অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে উপকৃত করতে পারে। সম্মিলিত সামরিক মহড়া, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা অভিযান (UNPKO) প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহযোগিতা, সেই সাথে বিনিময় কর্মসূচি, সিনিয়র-স্তরের পরিদর্শন, চিকিৎসা সহযোগিতা, ক্রীড়া ইভেন্ট এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রশিক্ষণ সম্ভাব্য সহযোগিতার খাতের কিছু উদাহরণ।
দুই রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগের পথ প্রশস্ত করতে পারে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে উন্নত সামরিক সম্পর্ক মসৃণ করতে এবং রোহিঙ্গা সঙ্কট, সামুদ্রিক বিরোধ এবং সীমান্ত-সম্পর্কিত আন্তঃসীমান্ত অপরাধের মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উভয় বাহিনীরই নিয়মিত সফর, প্রশিক্ষণ এবং যৌথ মহড়া বিনিময় করা উচিত। এগুলো অবিশ্বাস হ্রাস এবং বিশ্বাস ও বোঝাপড়ার প্রচারে সহায়তা করবে।
এটি এ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট সমাধানে সহায়তা করতে পারে। পরিবেশগত ফ্রন্টে Tatmadaw এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, অপারেশন ও প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিবেশগত অবক্ষয়ের ঝুঁকি কমাতে সহযোগিতা করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার এক সাথে কাজ করতে পারে। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস এটির সেরা চিত্র। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ উভয় দেশের উপক‚লরেখায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে। পরিবেশ বিপর্যয় ও ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়েরই কাজ করার বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে।
দুই দেশের সম্পর্ক বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তের দুই পাশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সংলাপের ভিত্তিতে। ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হওয়ার এবং সংশ্লিষ্ট দু’টি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হলো দু’টি সার্বভৌম দেশের জনগণের মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যখন আলোচ্য দেশগুলো পরস্পরের প্রতিবেশী হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে অবশ্যই একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সম্পর্ক থাকতে হবে। উভয় সামরিক বাহিনী মূলত একে অপরের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে পারে।
সম্ভাব্য পারস্পরিক সুবিধা
ভারত ছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন একমাত্র দেশ মিয়ানমার। এটি বাংলাদেশকে কৌশলগত সুবিধা দেয়ার সম্ভাবনা উন্মোচন করে। এটি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক রুটের স্থলভিত্তিক বিকল্পের সূচনা পয়েন্ট হতে পারে। এ ধরনের একটি সড়ক সংযোগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ যেমন- থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রাখে।
প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে মিয়ানমারও অনেক প্রতিশ্রুতিপূর্ণ একটি দেশ। মিয়ানমারের বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- গ্যাস, তেল ও পাথরের পরিমাণ বিশাল এবং বাংলাদেশ সেগুলো থেকে যথেষ্ট উপকৃত হতে পারে। ফলে জাতীয় নিরাপত্তার মতোই মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের স্বার্থে বেশি জরুরি।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই মারাত্মক জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির কারণ হতে পারে। তাই বৃহত্তর আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মাধ্যমে সামরিকভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে দুই দেশ সহযোগিতা করতে পারে এবং একসাথে কাজ করতে পারে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিদ্যমান সামরিক ও বাণিজ্যিক সংযোগের অধিকতর উন্নয়ন করা, যা এখন অনেকটাই নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
তবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে সামরিক কূটনীতি সৎ প্রতিবেশী মনোভাবের সাথে সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের মতো গুরুতর সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারে।
অভিন্ন বিপদ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিমসটেকের দু’টি প্রধান উদ্বেগ, যা উভয় সদস্য সরকারগুলোর পক্ষেই তাদের নিজস্বভাবে মোকাবেলা করা অসম্ভব।
সময়ের সাথে সাথে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ধরনও পাল্টেছে। ডিজিটাল যুগে সাইবার ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সার্বভৌম মহাকাশে এ ধরনের লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী গোয়েন্দা আদান-প্রদান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়, যা দুই দেশের সামরিক দক্ষতাকে একত্রিত করে সহজ করা যেতে পারে।
আন্তঃসীমান্ত অস্ত্র ব্যবসা, সেই সাথে বেআইনি মানব ও মাদকপাচার এই এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব হতে পারে। অধিকন্তু, উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলগুলো পূর্ববর্তী অচলাবস্থাগুলো কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে উৎসাহিত করবে এবং জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মোতায়েনকে সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ দেবে।
অবশেষে, বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হলে মিয়ানমারের উপকার হবে। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক শান্তি, সম্প্রীতি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক স্বার্থ বৃদ্ধি ও পুরো অঞ্চলে (দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) অন্যান্য সুবিধা দিতে পারে।