
ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত পৃথক ৪টি মূর্তির ছবি।
ঢাকা নগরী হিসাবে গড়ে উঠার ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। মুঘল আমলের নান্দনিক সৌন্দর্যে তৈরি অনেক মসজিদ এখনো ঢাকায় মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। মুসলমান ধর্মীয় সংস্কৃতির আলোকে প্রাচীন আমল থেকেই মসজিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এই শহরে। এক পর্যায়ে ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ঢাকা। তবে ‘মসজিদের শহর’ ঢাকায় গত এক দশকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির সংখ্যাও। মসজিদের শহরে বিভিন্ন পয়েন্টে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি তৈরীর প্রতিযোগিতা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।
রাজধানীর দোলাইপাড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্থাপিত একটি মূর্তি স্থাপনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদে দোলাইপাড় চত্বরে ইতোমধ্যে তৌহিদী জনতা ঐক্য পরিষদ নামক একটি সংগঠনের উদ্যোগে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতা বক্তব্য রাখেন।
তারা বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের বদলে আল্লাহর ৯৯ নাম অঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হোক।
মাওলানা আহমদ আব্দুল কাইয়ূমের পরিচালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই।
ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন, আল্লামা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, দলের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী, নারায়ণগঞ্জ ডিআইটি জামে মসজিদের খতীব মাওলানা শাহ আব্দুল আউয়াল, মেরাজনগর বড় মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা রশিদ আহমদ, মুফতি মনিরুজ্জামান, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সিরাজী, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান প্রমুখ।
সমাবেশে মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, দেশের গরীব মানুষ খেতে পাচ্ছে না, চিকিৎসা পাচ্ছে না। এ অবস্থায় জনগণের টাকায় ভাস্কর্যের নামে মূর্তি নির্মাণ করতে দেয়া হবে না। মূর্তি নির্মাণের চক্রান্ত রুখে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, মনে রাখবেন এদেশ কারো বাপ-দাদার দেশ নয়। যদি মূর্তি নির্মাণ করতে চান মন্দিরে গিয়ে নির্মাণ করুন। শরীয়ত-বিরোধী কাজের জন্য আমরা রক্ত দিতে চাই না, তবে রক্ত দেয়া শুরু হলে রক্ত বন্ধ হবে না। মূর্তি নির্মাণ করা হলে তা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়া হবে।
আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা ভুল পথে হাঁটছেন। ফেরাউন নমরূদের পথ ছেড়ে ইসলামের পথে ফিরে আসুন। সকল মূর্তি অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত মুসলমানরা ঘরে ফিরে যাবে না।
আল্লামা রশিদ আহমদ বলেন, মসজিদের নগরীকে মূর্তির নগরী বানানো জনগণ মেনে নিবে না। এদেশের মুসলমানরা শিরকমুক্ত এবং বিদ’আত মুক্ত পরিবেশে বাঁচতে চায়। দোলাইরপাড়ে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি না বানিয়ে আল্লাহর ৯৯ নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করুন।
মাওলানা আব্দুল আউয়াল বলেন, বঙ্গবন্ধুর কবরে আযাব হোক এটা আমরা চাই না। জেদ্দা-মক্কা সড়কে পবিত্র কুরআন রেহাল সম্বলিত সম্মানজনক গেইটের আলোকে দোলাইরপাড়ে কুরআনের গেইট করুন।
মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে মদিনার সনদের আদলে দেশ চালাবেন। কিন্ত মদিনার সনদে কোনো মূর্তি ভাস্কর্য নেই। আপনি কোন মদিনার সনদ অনুসরণ করে মসজিদের শহরে মূর্তি বানাতে চাইছেন জনগণ জানতে চায়।
মুফতি নূর হোসাইন নূরানী বলেন, মূর্তি কীভাবে ভাঙ্গতে হয় নবীপ্রেমিক মুসলমানরা জানেন। মূর্তির সাথে বাংলাদেশের মুসলমানরা কোনোদিন আপোস করবে না। দোলাইপাড়ে মূর্তি বানানো হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়া হবে।
মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, মূর্তি পৌত্তলিক সংস্কৃতি। জনগণ ঈমানের দাবিতে মাঠে নেমে এসেছে। এটা কোনো সরকার বিরোধী আন্দোলন নয়। লেলিনের মূর্তি রাশিয়ার জনগণ টেনে নামিয়েছে। মূর্তি নির্মাণ করে ঈমানদারদের হৃদয়ে আঘাত দিয়ে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করবেন না।
মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, মসজিদের শহর ঢাকাকে মূর্তির শহর বানাতে দেয়া হবে না।
শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ময়মনসিংহে উলঙ্গ মহিলার মূর্তি স্থাপন করে সরকারের ভাব-মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে। যেখানেই মূর্তি তৈরি করা হবে সেখানেই প্রতিহত করা হবে ইনশাআল্লাহ।
দলটির মহানগর ও কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তারা বলেন, সারাদেশের সড়কের মোরে মোওে যেসব মূর্তি বসানো হয়েছে সেই সব মূর্তি সরানোর জন্য আন্দোলন করা হবে। বাংলাদেশ মসজিদের দেশ, আউলিয়ার দেশ, মাদ্রাসার দেশ। এদেশে কোনো মূর্তি থাকতে দেয়া হবে না।
শুধু ঢাকাই নয়, সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্যের নামে জনগণের টাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি স্থাপন করার এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যটি তৈরি করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), যার নাম রাখা হয়েছে বজ্রকণ্ঠ।
চলতি বছরের জুলাই মাসে নগরীর হালিশহরের বড়পুল মোড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তিটি উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। বজ্রকণ্ঠ নামের মূর্তিটি নির্মাণ ও স্থাপন কাজে চসিকের ব্যয় হয়েছে ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সারা দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের যত মূর্তি গড়া হয়েছে, এটি এ যাবতকালে সবচেয়ে বড় বলে গর্ব করছেন চসিক মেয়র। মূর্তিটির উচ্চতা সাড়ে ২২ ফুট, বেজসহ (বেদি) পুরো ভাস্কর্যের উচ্চতা ২৬ ফুট।
এর এক বছর আগে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো। এটা তৈরীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো ভাস্কর্য শিল্পী মৃণাল হককে, যিনি এখন প্রয়াত। মূর্তিটি ১০০ ফুট উঁচু করার কথা ছিলো।
চুয়াডাঙ্গার ডিজাইনের প্রায় হুবহু একটি মূর্তি অবশ্য ২০১৬ সালেই ময়মনসিংহে নির্মাণ করার শুরু করেছিলেন ময়মনসিংহ-৩ আসনের মরহুম সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান ফকির। নিজ ব্যয়ে এই মূর্তির কাজ তিনি শুরু করেছিলেন। এর নির্মাণকাজের ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
মসজিদের দেশে মূর্তি তৈরীর কাজ ৯০ শতাংশ শেষ করেই মারা যান সেই সংসদ সদস্য।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকার পাড়া মহল্লায় পর্যন্ত এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা ইচ্ছামতো শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি স্থাপন করছেন।
এছাড়া ময়মনসিংহে টিচার্স ট্রেইনিং একাডেমির সামনে এক নারীর উলঙ্গ মূর্তি ও হাইকোর্টে গ্রীক দেবী থেমিসের মূর্তিও সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে স্থাপন করা হয়েছে।
এতোদিন এসব নিয়ে চুপ থাকলেও এখন অনেকটা প্রকাশ্যেই প্রতিবাদ করা শুরু করেছেন বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতারা। শুক্রবার খেলাফত যুব মজলিসের এক অনুষ্ঠানে আল্লাহা মামুনুল হক সরকারের প্রতি মূর্তি সংস্কৃতির ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। মূর্তি-সংস্কৃতি বন্ধ না হলে ফের শাপলা চত্বরে সমাবেশের হুমকিও দেন তিনি।