লাবলু আনসার ও ওয়াহেদ হোসেনী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
20 Aug 2020
ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে অভিবাসীদের উত্থানের অনন্য প্রতীক হিসেবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের নাম যখন সর্বত্র অত্যন্ত গৌরবের সাথে উচ্চারিত হচ্ছে, তেমনি সময়ে বাংলাদেশি-আমেরিকান এম ওসমান সিদ্দিকের লেখা ‘লিপস অব ফেইথ’ বইটিও মার্কিন মুল্লুকে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।
স্বপ্ন বাস্তবায়নে অভিবাসীদের সাফল্যের কাহিনী সংবলিত এই গ্রন্থে মূলত: মেধাবি-উদ্যমী-প্রত্যয়ী ওসমান সিদ্দিকের জীবনী বিবৃত হলেও তার মধ্যদিয়ে আমেরিকার উদারতারও প্রকাশ পেয়েছে। মানবিকতার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে জুলাইতে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরাও বহুজাতিক এ সমাজে উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন-ওসমান সিদ্দিক (৭০) সে উদাহরণ হয়ে অনাগত দিনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে একেবারেই অপরিচিত একটি সমাজেও নিজের আসন প্রোথিত করা সম্ভব প্রচন্ড আগ্রহ থাকলে-এটিও নতুন প্রজন্মের জন্যে পাথেয় হয়ে থাকবে ‘লিপস অব ফেইথ’ গ্রন্থের মাধ্যমে।
‘লিপস অব ফেইথ’, অর্থাৎ বিশ্বাসের অগ্রগতি বা বিশ্বাসের উত্থান অথবা ‘অবিচল আস্থায় এগিয়ে চলা’ নামক ইংরেজিতে লেখা এ গ্রন্থটিকে পাঠক সমাজে উপস্থাপন করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের অন্যতম ক্লিনটন ওসমান সিদ্দিককে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফিজি, রিপাবলিক অব নাউরো, দ্য কিংডম অব টঙ্গো এবং টোভালোতে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়েছিলেন ২০ বছর আগে। সততা, নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালনে ওসমান সিদ্দিক বাঙালির এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছেন। আর এভাবেই ওসমান সিদ্দিকের জীবন-কাহিনী আমেরিকার প্রকৃত ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। কারণ, এদেশটি গড়েছেন অভিবাসীরাই।
আমেরিকায় অভিবাসীদের সফলতার কাহিনী নতুন কোন ঘটনা নয়। এই নিয়ে ভুরিভুরি উৎসাহব্যঞ্জক বই বাজারে আছে। তবে অন্য বইয়ের সঙ্গে এই বইয়ের ভিন্নতা রয়েছে। এটা আসলে ‘পাশের বাড়ির ছেলের গল্প’ বলেই মনে হয় পাঠকদের কাছে। কারণ বইটির লেখক রাষ্ট্রদূত এম ওসমান সিদ্দিক কমিউনিটির সমাজ-সচেতন সবার চেনাজানা, একই পরিবেশে বড় হওয়া একজন মানুষ।
বইটা পড়তে পড়তে প্রবাসীদের পেছনের দিনের কথা, আমেরিকার কথা, বাংলাদেশের কথা স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। অন্য গ্রন্থের চেয়ে আলাদা হবার আরেকটি কারণ হলো আমেরিকার সম্ভাবনা দিয়ে শুরু এবং সম্ভাবনা দিয়েই শেষ। কিন্তু এটি ঠিক সে ধরনের নয়। বইটি এসে ঠেকেছে বাস্তবের কালো ছায়ার একেবারে মুখোমুখি। আমেরিকার সমস্যা, মানবতার সমস্যা, গণতন্ত্রের সমস্যা, পরিবেশ সমস্যা লেখককে ভাবিয়ে তুলেছে বটে, তবে খাঁটি আমেরিকান হিসাবে, হতাশ না হয়ে, তিনি আবার নতুন সূর্যোদয়ের আশা নিয়ে বিদায় নিয়েছেন এই বলে, ‘সমস্যা যত প্রকটই হউক, দিন শেষে বিজয় আসবেই‘।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ভূমিকা লেখা বইটিতে বেশ নাটকীয় উপস্থাপনা রয়েছে। মর্তে স্বর্গ হিসেবে পরিচিত ফিজি-তে আমেরিকার দূতাবাস। তখন সেখানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী, ছোট খাট শ্যামবর্ণ এম ওসমান সিদ্দিক। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসা প্রতিরক্ষা সচিব (ডিফেন্স এটাশে) কর্নেল সাহেব গোড়ালিতে গোড়ালি ঠুকে মিলিটারি কায়দায় স্যলুট করে বললেন, “জনাব রাষ্ট্রদূত, বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে।” এশিয়া আফ্রিকার ছোটছোট দেশগুলোতে, যেখানে শাসনতন্ত্র, গণতন্ত্র তেমন পোক্ত নয়, সে সব দেশে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তখন সেই সব দেশে কূটনৈতিক তৎপরতা বিশেষ করে আমেরিকান কূটনৈতিক তৎপরতা খুব বেড়ে যায়।
এম ওসমান সিদ্দিক
ফিজি বংশোদ্ভুত এবং ভারতীয় বংশোদ্ভুত নাগরিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা মনোমালিন্যে আধা সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ঘটে। বাংলাদেশি-আমেরিকান এই রাষ্ট্রদূতের কূটনৈতিক নৈপুণ্যতার গুণে অভ্যুত্থানের সমাধা হয়। লেখক তার বইয়ে সে সময়কার দুটি মজার ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
একটা হলো, অভ্যুত্থানকারীরা সেখানকার গণপরিষদে একজন আমেরিকানসহ প্রায় বিশ জন বিদেশি সাংবাদিককে জিম্মি হিসেবে আটক করে। আমেরিকান দূতাবাসে মহাচিন্তা, কী হবে এই ভেবে। এক পর্যায়ে দূতাবাস থেকে অভ্যুত্থানকারী নেতাদের সরাসরি ফোন করে বলা হলো, ‘তোমরা যদি সাংবাদিকদের ২০ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে না দাও তবে তোমাদের ওপর মহাপ্রলয় ঘটে যাবে’। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আমেরিকান দূতাবাসে পরে এই নিয়ে খুব হাসাহসি হয়। কেননা ‘মহাপ্রলয়’ ঘটানোর মত তাদের কোন সরঞ্জামই ছিল না। অন্য ঘটনাটি হল- আমেরিকান দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারিকে উদ্ধার। অভ্যুত্থান তখন তুঙ্গে। দূতাবাসের সবার পরিবার ও অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পদধারির সবাইকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন সময়ে একদিন রাতে রাষ্ট্রদূত কান্নাভরা আকুতিপূর্ণ টেলিফোন পেলেন তার থার্ড সেক্রেটারির কাছে থেকে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে মাত্র পাশ করা এই প্রথম চাকরিতে ঢোকা ২৪ বছরের তরুণী সমুদ্রধারে চমৎকার একটা বাংলোতে একা থাকেন। তিনি অশ্রুসিক্তকণ্ঠে রাষ্ট্রদূতকে বললেন, “আমার বাড়ির দুপাশে সরকারি ও বিদ্রোহীরা গোলাগুলি করছে। যেকোনও মুহূর্তে আমার বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে। রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে তখন বন্দুকধারী এক পাহারাদার ছাড়া আর কেউ নেই। ড্রাইভার বাড়ি চলে গেছেন। রাষ্ট্রদূত বন্দুকধারী পাহারাদারকে নিয়ে সারা ফিজি দেশে একটিমাত্র আর্মড গাড়িতে উঠে বসলেন। রাষ্ট্রদূতের ট্রেনিংয়ের সময় (ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে) তাকে বিপদে-আপদে কিভাবে গাড়ী চালাতে হয় তার ট্রেনিং দেওয়া হয়। রাষ্ট্রদূত মনে মনে ভাবলেন যে, সে ট্রেনিং কতটুকু শিখেছি, আজ তার পরীক্ষা। যখন রাষ্ট্রদূতের গাড়ি থার্ড সেক্রেটারির বাড়িতে পৌঁছাল, তখনও গোলাগুলি চলছে। বাড়িতে একটাও আলো নেই। ডাকাডাকি করে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রাষ্ট্রদূত ভাবছেন কী করা যায়, এমন সময় হঠাৎ করেই একটা ঝোপের ভেতর থেকে থার্ড সেক্রেটারি বেরিয়ে এসে বললেন ‘এই যে আমি এখানে’। তার সারা শরীরে কাদা মাটি মাখা। গাড়ি ছুটে চলল রাষ্ট্রদূতের বাড়ির দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাষ্ট্রদূত মনে মনে ভাবলেন- ‘নাহ, ট্রেনিংটা ভালই রপ্ত করেছি।’ এই বইটা যদি কোনদিন সিনেমা হয়, তবে উদ্ধার কাজের দৃশ্যটা বেশ চমকপ্রদ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অভিবাসীরা অপরিচিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ের চলার অহর্নিশ প্রয়াসের পাশাপাশি জীবিকার জন্যে নিরন্তর সংগ্রাম, একপর্যায়ে সাফল্যলাভ এবং নতুন এই দেশটির জন্যে আত্মনিয়োগের ধারাবিবরণীর এই গ্রন্থের লেখক রাষ্ট্রদূত এম ওসমান সিদ্দিক বাংলাদেশের খ্যাতনামা একটি পরিবারের সদস্য।
তার পিতা ওসমান গনি বাংলাদেশের অতি সাধারণ এক গ্রামে (কিশোরগঞ্জ), সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নিয়ে শুধু নিজের মেধার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে তিনি তাঞ্জানিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের দ্বায়িত্ব পালন করেন।
লেখক তার এ গ্রন্থে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সাথে উল্লেখ করেছেন, “আমার পরিবারে ঘটা একটা ঘটনা পৃথিবীর আর কোন পরিবারে ঘটছে কিনা বলতে পারি না। একই পরিবারের তিন ব্যক্তি ( পিতা ও দুই পুত্র) তাদের গাড়িতে তিনটি স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়েছেন। আমার বাবা ওসমান গনি তাঞ্জানিয়ায় তদানিন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে তার গাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ান, আমার বড়ভাই ডক্টর ওসমান ফারুক বাংলাদেশের মন্ত্রী হিসেবে তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। আর অন্য পুত্র ওসমান সিদ্দিক ফিজিতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার গাড়িতে আমেরিকান পতাকা ওড়ান।”
স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রা বিবৃতকালে এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে সিনেমায় ব্লু হাওয়াই দেখার স্বপ্ন নিয়ে নিউ ইয়র্কের হারলেমে নেমে তার সে ‘স্বপ্ন ভঙ্গ’ হয়ে যায়।’
এরপর লেখাপড়া শেষ করে সেই নিউ ইয়র্কে ফিরে অভিজাত হোটেলে ( ওয়াল্ডোর্ফ এস্টোরিয়া) উঠে ম্লানপ্রায় স্বপ্ন পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আর বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে হানিমুনে যান হাওয়াইয়ে সত্যিকারের ব্লুু হাওয়াই দেখতে। সত্যিকারের ব্লু হাওয়াই শুধু আনন্দ ও হৈ হুল্লুড়ের দেশ নয়, সে কথা লেখক আমেরিকা এসেই বুঝতে পারেন এবং হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন যখন তার স্কুলে এলভিস প্রেসলি আসেন গান করতে।
তিনি গান শুনতে যেতে পারেননি। তার প্রিয় গায়কের অনুষ্ঠানে যাওয়ার ১৫ ডলারের টিকিট কেনার সামর্থ্য তার ছিল না। পরে বুদ্ধি খাটিয়ে, পরিশ্রম করে, অর্থ উপার্জন করে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে যন্ত্রপাতি ভাড়া করে, বিমানে করে নিয়ে এসে ফিজিতে আনন্দ অনুষ্ঠান করতে এই ইমিগ্র্যান্টের কোনও অসুবিধা হয়নি। বুদ্ধিমান, দৃষ্টিখোলা, পরিশ্রমী এ ব্যবসায়ী অভিবাসী নিজের অজান্তেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছেন। ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেডে প্রথম চাকরি করতে গেলে তার বস তাকে বলেন, “ওসমান, একশটা টেলিফোন করলে ৯৮ জনই উত্তর দেবে না, বাকি দুজনের মধ্যে হয়তো একজন তোমার ক্লায়েন্ট হবে।” সে কথা মনে রেখেই ওসমান সিদ্দিক প্রথমে চাকরি ও পরে ব্যবসায় নামেন। কখনই হতাশ হননি। যখনি অসফলতা এসেছে, আবার নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন। ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্ট রাখার তার নীতি ব্যবসায় নামা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্যে উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
ওসমান সিদ্দিক ট্র্যাভেল কোম্পানি খুলে বড় বড় কোম্পানিগুলোকে রাজি করিয়ে ব্যবসা ধরতে লাগলেন। এ সময় তার একটা বড় শিক্ষা হয়। ব্যবসা পেলেই হবে না, ব্যবসা ধরে রাখতে হবে। এক সময় তিনি ‘বুজ এলেন’ কোম্পানির ব্যবসা পেলেন। কন্ট্রাক্ট সই করার সময় ‘বুজ এলেন’ কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, “দেখ ওসমান, দুবছর পরে যখন তোমার কন্ট্রাক্ট বাদ দিয়ে দেব তখন মন খারাপ করোনা, কেননা তত দিনে তোমার সেবার মান কমে যাবে।”
কিন্তু ইমিগ্র্যান্ট ওসমান তার ব্যবসার উচ্চমানের নৈতিকতায় এমনি অনড় ছিলেন যে, দুই বছর কেন, ‘বুজ এলেন’ ৯ বছর তার ক্লায়েন্ট হয়ে রইলো। তার উচ্চ মানের নৈতিকতা যেকোনও ব্যবসায়ীর কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সফল ব্যবসায়ী ওসমান সিদ্দিকের শুধু অর্থ উপার্জনই জীবনের লক্ষ্য ছিল না। ইন্ডিয়ানাতে ছাত্র জীবন থেকেই তিনি আমেরিকান হতে চেয়েছিলেন। আমেরিকান রাজনীতিতে জড়িত হতে চেয়েছিলেন। ব্যবসায়ী হিসেবে আবেদন জানিয়ে ওসমান যেদিন আমেরিকান নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণ করেন (১৯৮৫ সালের ১৭ অক্টোবর), সেই দিনে তার হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বর্ণনা করেন এইভাবে, “আই ওয়াজ স্ট্রাক বাই দ্য পাওয়ার অব দিস অউথ, রেসপন্সিবিলিটি দ্যাট ওয়াজ বিয়িং কনফারড আপঅন মী… হাউ ম্যানি আমেরিকান্স,বার্থেড হিয়ার, হো টুক দেয়্যার সিটিজেনশিপ ফর গ্র্যান্টেড, আন্ডারস্টুড দিজ অবলিগেশন্স।”
পরিশ্রমী এই যুবকের পরিচয় ঘটে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে বেশ চমকপ্রদভাবে। এক ফান্ড রেইজিং ডিনারে। সেই যে শুরু…। ধীরে ধীরে মার্কিন রাজনীতির বড় ময়দানের নামীদামী বড় বড় খেলোয়াড়, ক্লিনটন, কেনেডি, হিলারি, বাইডেন, ওবামাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, পরিচয়, অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠতে থাকে।
রাজনীতির একটা বড় শক্তিশালী সম্পদ হচ্ছে ‘ফান্ড রেইজিং’ ক্ষমতা। ওসমান সিদ্দিক সে ক্ষেত্রেও একজন শক্তিশালী খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। তিনি এখন প্রোডাকটিভ আমেরিকান সিটিজেন।
স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আর জামাতার সাথে এম ওসমান সিদ্দিক। ছবি-বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
ওসমানের সঙ্গে জর্জটাউন ও প্যারিস থেকে পড়াশোনা করা, ইতালিয়ান ক্যাথলিক অভিবাসীর কন্যা ক্যাথেরিনের দেখা হওয়ার পর থেকেই তাকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। বাঙালি মুসলমান ছেলে, ক্যাথলিক ইতালিয়ান মেয়ে- একটু সমস্যা হবে বৈকি। তবে ওদের ভাগ্য ভালো। দুই তরফের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন উদার হওয়ায় এবং দুইজনেরই স্বভাব চরিত্র অপর পক্ষের কাছে গ্রহণীয় হওয়ায় বিয়েতে কোনও বাধা সৃষ্টি হয়নি। তবে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় দুইবার।
মুসলিম নিয়মে বিয়ে পড়ান ওয়াশিংটন ইসলামিক সেন্টারের ইমাম ডক্টর মোজাম্মেল সিদ্দীকি এবং পরের দিন নিউ জার্সির এক চার্চে ক্যাথলিক নিয়মে বিয়ে পড়ান ফাদার মাইকেল তোরো।
ওসমান ও ক্যাথেরিনের জীবনে দুই ধর্মেরই প্রভাব খুব জোড়ালো। ওসমান যখন রাষ্ট্রদূতের শপথ নিতে যাচ্ছেন তখন ক্যাথেরিনকে বলেন, “তোমার বাইবেলটা নিয়েছ?” অবাক হয়ে ক্যাথেরিন বলেন, “বাইবেল? আমিতো শপথ নিচ্ছি না।”
ওসমান বলেন, “তোমার সার্বক্ষণিক দোয়া ছাড়া আমি তো এতদূর আসতে পারতাম না।”
ক্যাথেরিনের হাতে ধরে রাখা কোরান আর বাইবেলের উপর হাত রেখে মুসলমান ওসমান সিদ্দিক আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের শপথ গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালের ১৭ অগাস্ট। ধর্ম নিয়ে আর একটা কথা লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ওসমান সিদ্দিককে ফিজিতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন ১৯৯৮ সালের ১২ জুন। ইউএস সিনেটের অনুমোদন পায় ১৯৯৯ সালের ৫ অগাস্ট। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এটি সেই দেশের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। সেটাই কূটনৈতিক নিয়ম। সে অনুমোদন আর আসে না। এই গড়িমসির কারণ কি ক্লিনটন তা জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, ওই দেশের ভারতীয় বংশোদ্ভুত হিন্দু প্রধানমন্ত্রী মহেন্দ্র চৌধুরী মুসলিম রাষ্ট্রদূত গ্রহণ করতে ইতস্তত করছেন।
শুনে মহাখেপা ক্লিনটন বললেন, “ওদের বলে দাও, ওরা যদি এই আমেরিকানকে গ্রহণ করতে না চায় তবে আমার শাসনামলে ওরা আর কোন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পাবে না।” সুড়সুড় করে অনুমোদন চলে এলো। ওসমান তার ধর্ম উদারতার কথা বলেছেন তার রাষ্ট্রদূত থাকা সময়ের একটা ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে। ফিজিতে এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এসেছেন। হঠাৎ কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। শেষে একজন এসে বলল ওরা হিন্দু প্রথানুযায়ী অতিথির মাথায় টিপ দিয়ে অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছে। মুসলমান হিসেবে আপনি যদি সেটা পছন্দ না করেন তবে তারা সেটা আপনার বেলায় করবে না। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বললেন, “তা কেন, আমার কোনও আপত্তি নেই।” স্মরণ করা যেতে পারে বাঙালি ওসমান সিদ্দিক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রদূত।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব অর্পণে সীমাহীন গড়িমসির মধ্যে সারা পূর্বপাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে উচ্চশিক্ষার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর চলমান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অধ্যয়নের মধ্যেই বাংলাদেশের জন্যে জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টের প্রসঙ্গও রয়েছে এ গ্রন্থে।
সিনেটর টেড কেনেডির শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর সিনেটে জুডিশিয়ারি কমিটিতে সেই যুদ্ধের সমর্থনে আবেগঘন প্রতিবেদন উপস্থাপন ছাড়াও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পরিভ্রমণের কথাও রয়েছে। লেখাপড়া শেষে ওয়াশিংটন ডিসিতে নিজের ব্যবসা চালু এবং ক্রমান্বয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ার পর টেড কেনেডি তাকে আপন করে নেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
‘লিফস অব ফেইথ’ বইটার পরিচিতি দিতে গিয়ে বইটার সব কিছু বলে দিতে চাইনা তবু পরিচিতি ইতি করার আগে দুটি কথা না বললেই নয়।
প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন সফরে বাংলাদেশ যাবেন। ফিজিতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে বললেন- “তুমিও থাকবে আমার সফর সঙ্গী হিসেবে।” ঢাকা বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন তার সফর সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। লাইনের প্রথমেই অলব্রাইট মেডেলিন, দ্বিতীয়জন রিচার্ড ডেলি, তিন নম্বরে জন পডেস্টা আর চার নম্বরে ছিলেন রাষ্ট্রদূত এম ওসমান সিদ্দিক।
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন করতে করতে তার মনের ভাব প্রকাশ করেছেন তিনি এই ভাবে-
I wonder what thoughts went through the minds of the president and the prime minister as I shook their hands. If they could have read my thoughts, they would have perceived nothing but wonderment for the circumstances in which I found myself.
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকের স্ত্রী, সন্তান আর মা-বাবার প্রতি। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “আমার স্ত্রী-আমার জীবনের ভালবাসা; সন্তানেরা-আমার জীবনের উচ্ছ্বাস; আমার অভিবাবক-যারা আমার জীবন দিয়েছেন।”
১৫ অধ্যায়ের সুপঠিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ আমেরিকার পতাকায় অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ২১৯ পাতার বইটি প্রকাশ করেছে ট্রান্সকন পাবলিশিং।
বইটি অ্যামাজন ডটকমে পাওয়া যায়। মূল্য ইউএস ২৮ দশমিক ৯৫ ডলার এবং কানাডায় ৩২ দশমিক ৯৫ ডলার। বইটির ওয়েব সাইট Osmansiddique.com.