করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সালের শুরু থেকে। কার্যপরিকল্পনা দলিলে সে রকমই উল্লেখ আছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হয়নি। তবে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সমুদ্র, স্থল ও বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের মতো বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মানসম্পন্ন ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই বন্দরগুলোতে। ২০১৪ সালে জ্বর শনাক্ত করার সাতটি থার্মাল স্ক্যানার যন্ত্র কিনেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অতি সম্প্রতি জানা গেল, এর ছয়টি নষ্ট। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনটির একটি যন্ত্র সচল আছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে ১০টি যন্ত্র চাওয়া হয়েছে। সরকার নিজেও কেনার চেষ্টা করছে।
জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষকে কোয়ারেন্টাইন করার (বিশেষ ব্যবস্থায় আলাদা রাখা) বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের মাথাতেই ছিল না। চীনের উহান থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশি ফেরত আসার পর বিষয়টি স্পষ্ট হলো। কোয়ারেন্টাইন করার মতো নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় ৩১২ জনকে হজ ক্যাম্পে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, হজ ক্যাম্পকে সব সময় কোয়ারেন্টাইন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এখন নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করে রাখার সময় এসেছে।
৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ। সাতটি থার্মাল স্ক্যানার যন্ত্র কেনা হয়েছিল, ছয়টিই নষ্ট।
মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আমরা এখন যা কিছু করছি, তা মোটাদাগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৫ সালের “আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি” অনুসরণ করেই করছি।’
দেশে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন বা অনুসরণ করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার। এ কাজে বাজেট বরাদ্দও আছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে এ ক্ষেত্রে ৭৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বাজেট পরিকল্পনা ছিল। ২০১৭,২০১৮ ও ২০১৯ সালে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৫ কোটি টাকার বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বরাদ্দের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ খরচ হয়ে গেছে। বন্দরগুলো যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনা, ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ ও টিকা কেনা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, ল্যাবরেটরি সামগ্রী কেনা বাবদ এই অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে আইইডিসিআরের পরিচালকের দপ্তর জানিয়েছে, তিন বছরে তারা ১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার টাকা পেয়েছে ‘ওয়ান হেলথ’ কর্মসূচির জন্য।
তবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য দেননি রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌসি। তিনি এই পদে যোগ দিয়েছেন গত ২৭ জানুয়ারি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি পরিচালকের পদে নতুন। কাজে যোগ দিয়েই করোনাভাইরাসের চাপে পড়েছি। কর্মসূচির বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।’ অবশ্য তাঁর নির্দেশে পরামর্শক নাসির উদ্দিন কর্ম সম্পাদনের এক পৃষ্ঠার একটি তালিকা দেন। তাতে ১৭টি কাজের কথা উল্লেখ আছে।
কী করার কথা ছিল
পরিকল্পনায় আটটি বড় কাজ করার কথা ছিল। যেমন ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্ত এলাকায় রোগের ওপর নজরদারি, আন্তসীমান্ত নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণে স্বাস্থ্যবিধি অন্তর্ভুক্ত করা, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষাগারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে জনবল গড়ে তুলতে পরিকল্পনা তৈরি করা, ঝুঁকি যোগাযোগ ও কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি, বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো, খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিরূপণ করা।
২০১৭ থেকে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত কার্যপরিকল্পনার পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা। এখন তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। তাঁর নতুন কর্মস্থলে গিয়ে দেখা করেও তিন বছরে কী কাজ হয়েছে, তা জানা যায়নি।
তিন বছরে কাজের যে তালিকা পরামর্শক নাসির উদ্দিন তৈরি করেছেন, তাতে দেখা যায়, প্রথম কাজটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কমিটি গঠন। অন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তিনটি কমিটির তিনটি সভা। এ ছাড়া আছে পরিকল্পনা তৈরি, চিকুনগুনিয়া বিষয়ে নির্দেশিকা তৈরি, জিকাবিষয়ক কৌশলপত্র তৈরি। এর পাশাপাশি শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যসেবা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। আর সীমান্তবর্তী এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা-আগরতলা সীমান্ত এলাকায় বিবির বাজার বন্দরে এই প্রতিবেদক কথা বলেন দুজন স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর স্থলবন্দরটিতে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হয়। একটি ভবনের বারান্দায় একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার দিয়ে কেন্দ্র চালাচ্ছেন একজন চিকিৎসক ও একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা। দুজনই বলেছেন, তাঁরা কাজ করছেন কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই। জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ এই এলাকায় কোনো দিন হয়নি। একই কথা জানা গেছে মোংলা সমুদ্রবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জোরালো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হলে প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা অধিকতর সহজ হয়। প্রস্তুতির জন্য পরিকল্পনা হয়তো ছিল, বরাদ্দও ছিল। সঠিকভাবে কাজ হয়নি বলে প্রস্তুতির ঘাটতি এখন নজরে পড়ছে। তবে এখন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজে নেমে পড়া জরুরি।