খেলাপির খপ্পরে অর্থনীতি

খেলাপির খপ্পরে অর্থনীতি

Daily Nayadiganta

ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ জাতীয় অর্থনীতিতে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। নানা উদ্যোগ ও খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়েও কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকাই খেলাপি। যা জাতীয় অর্থনীতির গতি মন্থর করেছে।

‘খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়তে দেয়া হবে না’ বলে অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই বক্তব্য ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ বলে পরিহাসের অংশ হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমেনি; উল্টো আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ৪৩ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সাল শেষে যেখানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি টাকা। তারপরও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই পরিসংখ্যানের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্ণনার তুলনায় অনেক বেশি।

ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিষয় হলো সুদহার। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাজারভিত্তিক ব্যবস্থায় জোর করে সুদের হার বেঁধে দিলে তা ইতিবাচক হবে না। সঙ্গত কারণেই এর আগেও সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত ভালো ফল পাওয়া যায়নি। তবে তারা এও মনে করেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে সুদের হার রয়েছে, তা দিয়ে শিল্পায়ন সহজসাধ্য হবে না। দেশের শিল্পায়ন ও প্রবৃদ্ধির স্বার্থে সুদের হার কমিয়ে আনা উচিত। কিন্তু তা করতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। কারণ, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হলে তাতে আমানতের সুদহারও কমে যাবে। এমনটি হলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবে। যা অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখবর নয়।

মূলত বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার বেশি হওয়ার পেছনে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য কারণ। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ রয়েছে সব মহল থেকেই। তবে রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমানো বাস্তবসম্মত নয়। এ জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও যথাযথ প্রয়োগ। আর সুদহার কমাতে হলে খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি কম সুদে বৃহৎ আমানত সংগ্রহের দিকে নজর দেয়া দরকার। সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান যাদের হাতে বড় অঙ্কের আমানত রয়েছে সেখানে নজর দিলেই এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা এর পুরোপুরি বিপরীতই বলতে হবে।

২০১৯ সালে দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয় বারবার আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে বিশেষ করে ঋণের সুদহার কমিয়ে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দিয়েও তার লাগাম টানতে না পারা, ঋণ খেলাপিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ, ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ছাড় এবং খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলকরণের সুযোগ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্বাভাবিক তৎপরতা দফায় দফায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাত থেকে একদিকে উদ্যোক্তাদের ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে উদ্বেগ বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনার কারণেই খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ঋণ পুনঃতফসিলও হয়েছে বেশি। বছরজুড়ে আর্থিক খাত দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেয়ায় ব্যাংকের আয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে, যা সামাল দেয়া খুব সহজসাধ্য হওয়ার কথা নয়। এ জন্য নতুন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি সক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন আরো বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা।

অর্থমন্ত্রীর খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছাড়লেও বাস্তবে তার কথার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি বরং তা আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। তা পরের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বরে আরো ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বেড়েছে। সব মিলিয়ে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

বিদায়ী অর্থবছরে ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপিদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এতে সুদহার ধরা হয় সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। আর ঋণ পরিশোধে এক বছরের বিরতিসহ ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করার নির্দেশনা আসে। আবার তারা নতুন ঋণও নিতে পারবেন এমন সুযোগও রাখা হয়। এ সুবিধার আওতায় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়মিত করার সুযোগও দেয়া হয়। কিন্তু ঋণখেলাপিরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি বরং অপব্যবহারই করা হয়েছে বেশি।

ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস’ (বিএবি) সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ এবং ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়ে দেড় বছর ধরে অনেক সুবিধা নিয়েছে। যেমন সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা রেপোর সুদহার কমানো হয়। অথচ তারা সুদহার কমাননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরের শেষ দিকে এসে উৎপাদন খাতে ৯ শতাংশ সুদ বেঁধে দেয়, যা নতুন বছরের শুরু থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

জাতীয় অর্থনীতিতে ছন্দপতনের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে প্রতি মাসেই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। গত নভেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমেছে, যা এর আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ দিকে বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, তা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। অথচ ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সোয়া পাঁচ মাসেই ঋণ নিয়ে ফেলেছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের অর্ধেকই সরকারি ব্যাংকগুলোর। বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকে পুঁজির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সিপিডি মনে করে, গুটি কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি দেশের ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যেসব সুবিবেচিত নীতিমালা দেয়া হয়েছে, তার প্রকাশ্য বরখেলাপ ঘটছে। এই বরখেলাপগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেআইনি কার্যকলাপে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানকেও এখানে যুক্ত হতে হচ্ছে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে অচলবস্থার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও অর্থনীতিতে স্মরণকালের ভয়াবহ অচলাবস্থার মধ্যেই সরকার ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে পত্রিকান্তরে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহল থেকেই একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর ব্যাংকিং কমিশন গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তথ্য ও উপাত্তের সাহায্যে সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ করে ব্যাংকিং খাতের জন্য সহযোগী এবং উপযোগী সুপারিশমালা তৈরির জন্য দাবি উত্থাপন করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। সিপিডি শুধু ব্যাংক নয়, পুঁজিবাজার এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সামগ্রিক আর্থিক খাতের জন্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কমিশনের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে।

মূলত ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে অশান্ত ও অস্থির করে তুলেছে। আর এ জন্য মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে নানা ধরনের লুটপাট। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিকে খেলাপি ঋণের খপ্পর থেকে বের করা না গেলে কোনো উদ্যোগই সফল ও সার্থক হবে না। লুটপাট বন্ধ করাও সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

[email protected]