সমাজে অপরাধপ্রবণতা ভয়াবহ

সমাজে অপরাধপ্রবণতা ভয়াবহ

প্রশাসন এখন রাজনীতি, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে যতটা ব্যস্ত ও তৎপর, ততটাই গাফেল তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা অন্যান্য বিষয় নিয়ে। নাগরিকদের স্বস্তি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য দরকার একটি অপরাধমুক্ত সমাজ। অথচ বাংলাদেশে অপরাধপ্রবণতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর এসব অপরাধ সঙ্ঘটিত হওয়ার যে খবর আমরা সংবাদপত্র ও সমাজ নিয়ে গবেষণাপত্রে পাই তার মধ্যে রয়েছে- সন্ত্রাস, সহিংসতা, গুম, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ আর কালো টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার। এসব আইন ও সমাজবিরোধী অপকর্মের হোতাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যের পেছনে যারা অভয় ও আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তারা হচ্ছেন- রাষ্ট্রক্ষমতার যত পার্শ্বচর।

তাদের তৎপরতার কারণে আজ সমাজের যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, তা থেকে পরিত্রাণ প্রতিকার পাওয়ার কোনো পথ রয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। সে কারণে হতাশা দেশের মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এমন অবস্থা সত্ত্বেও পর সমাজপতিদের গ্লানিবোধের কোনো নমুনা নজরে আসছে না। এমন দুর্বিষহ পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে এসব সমাজপতির সহযোগীরা রয়েছে, তাই তারা নীরব ও নিষ্ক্রিয়। বস্তুত এসব অপকর্ম মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকার কর্মীদের এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সীমা না থাকলেও তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ কখনোই এ দেশের প্রশাসনের কানে পৌঁছে না।

অপরাধপ্রবণতার অনেক কারণ আছে। আমাদের যে ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা তার যে বিন্যাস তাতেও অপরাধ বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ বিদ্যমান। আসলে মানুষ যে সমাজে জন্ম ও বর্ধিত হয়, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব তার ওপর পড়তে বাধ্য। যে সমাজে সুনীতি ও সদাচার বিদ্যমান থাকে, সেখানে মূল্যবোধের চর্চা হয়। ন্যায় থেকে অন্যায় পৃথক করা হয়। আমাদের সমাজে কি এমন সুষ্ঠু বিন্যাস রয়েছে? মানুষ তো অনিয়ম অব্যবস্থা দেখে আসছে জীবনের সেই শুরু থেকে। তাই তাকেই সে গ্রহণ করে নেয়, সে ক্ষেত্রে শুদ্ধতার অনুশীলন সে করবে কেমন করে? প্রথমে শুদ্ধতার অনুশীলন হয় সমাজ থেকে; তারপর এ শিক্ষা পাওয়ার কথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।

আমাদের শিক্ষালয়গুলোর বর্তমান পাঠ্যক্রমে বৈষয়িক আর ১০টা বিষয় নিয়ে পাঠদান করা হয়। কিন্তু নীতি নৈতিকতার কোনো পাঠ্যসূচি নেই এ পাঠ্যক্রমে। তাই জাগতিক ভোগবিলাস অর্জন করার পথ-পদ্ধতি সমাজের মানুষ রপ্ত করে সহজেই। কিন্তু কোন পথে কিভাবে তা অর্জন করা উচিত, সেখানে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি নীরব। আর এই মৌনতা মূলত সম্মতির লক্ষণ, অর্থাৎ যেকোনো উপায়ে সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনকে বৈধ মনে করা। এমন এক নীতিহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে আছে মানুষ। তাই কারো অধিকার খর্ব করে নিজের সমৃদ্ধি আনতে কারো এতটুকু বাধছে না। আমাদের সমাজের বিন্যাসটা এভাবে ঘটায় লোভ ও লিপ্সার প্রসার ঘটছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে অপরাধ। কিন্তু যারা এসবের সাথে জড়িত তাদের বিবেচনায় ‘অপরাধ’ বলে কিছু নেই। তারা যেভাবে যা অর্জন করছে তাকেই স্বাভাবিক বলে ভাবছে, সেখানে নীতিনৈতিকতা আর বিধিবিধানের কোনো বালাই নেই।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ্য পরিচয় হচ্ছে যোগ্য ও নীতিবান মানুষ তৈরির সূতিকাগার। এই আদর্শ ধরে রাখতে না পারলে, সেখান থেকে যে মানুষ বেরিয়ে আসে, তার সংজ্ঞা হয় ভিন্ন। আজ যে সমাজবাস্তবতা, তার সাথে ‘লাগসই’ মানুষই এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসছে। বলা বাহুল্য, এরা মূল্যবোধহীন নীতি জ্ঞানশূন্য প্রাণী। তাদের হাতেই গিয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রশাসনের দায়িত্বভার। এমন সব ব্যক্তির হাতে যখন দায়িত্ব আসে, তখন সে ক্ষেত্রে তারা তাদের বোধবিবেচনার আলোকেই কার্য সমাধা করে। তাদের দেয়া সমাধানে সমাজ যা পেয়ে থাকে, সেখানে মানবিকতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও কল্যাণচিন্তার কোনো স্পর্শ থাকে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা এ শিষ্যদেরই কেবল কাঠগড়ায় দাঁড় করালেই চলবে না। তাদের যারা শিক্ষাগুরু তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের যে কীর্তি কলাপ, তা অন্যায়ের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

যেমন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে বিরাট আর্থিক কেলেঙ্কারির বহু অভিযোগ। তার সব অনিয়ম ঢাকতে ছাত্রদের তিনি হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনকে শক্তি প্রয়োগ করে দমনের জন্য তার অনুসারী ছাত্র নামধারী পেটোয়াদের লেলিয়ে দিয়েছেন। ওরা আন্দোলনরত ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়ে প্রহার ও নির্যাতন করেছে। কী লজ্জার কথা যে, ভিসি এসব দুর্বৃত্তের সহিংসতার জন্য তাদের বাহবা দিয়ে প্রশংসা করেছেন। আরো দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এমন অপরাধ ও অনিয়মকারীদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি। অথচ উচিত হচ্ছে এর বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু এই লেখা পর্যন্ত সময়ে ভিসির ব্যাপারে কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তবে এতে কি সাধারণের মধ্যেই এই বার্তা দেয়া হচ্ছে না যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা নিছক ‘বাত কা বাত’ বা কথার কথা। পরে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা জানি না। দেরিতে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক, বিচার যদি সময়মতো না হয় তবে সেটা কার্যত না হওয়ারই নামান্তর।

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের মধ্যে অপরাধ ও দুর্নীতির কারণে কিছুদিন আগে শীর্ষ নেতৃত্বে রদবদল হয়েছে। কোনো সংগঠনের শীর্ষে যদি এমন পচন ধরে, তবে শিরা-উপশিরায় এর সংক্রমণ ঘটাটাই স্বাভাবিক। তার নজির দেখা গেছে সারা দেশে। এখন এমন শত শত খবর রয়েছে যে, এ ধরনের সংগঠনের নেতাকর্মীরা দুর্নীতি অনিয়ম ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে দেশব্যাপী এক অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এসব নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের পাল্টা অবস্থান নিয়ে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। এদের অশুভ তৎপরতার কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ। প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা ও আইনকানুনের ব্যাপারে তাদের কোনো মান্যতা নেই; তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে। ক্ষমতাসীনদের ভিত্তিমূলের হাল অবস্থা যদি এমন হয়, আর ওপর থেকে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে এরা আশকারা পেয়ে মাথায় উঠবে। আজ দেশের প্রায় সর্বত্র ক্ষমতাসীনদের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের এমন দুরাচার প্রতিহত করতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অক্ষম। গোটা দেশের যে নাজুক অবস্থা, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা সক্ষম হবেন এমন আশা করাটা কল্পনামাত্র।

ক্ষমতাসীনরা দেশের অবকাঠামোগত অগ্রগতি নিয়ে অনেক কথাই বলে থাকেন। কিন্তু মানবিক অবস্থার দুর্গতি যেখানে দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; আর সেটা সব কিছু ধসিয়ে দিতে পারে, সে বোধ তাদের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা যায় না। বর্তমান যে মানবিক বিপর্যয় তাকে রুখে দেয়া সম্ভব না হলে, সে ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অগ্রগতির চিন্তা নিছক বাতুলতামাত্র। তাই সমাজের মানবিক উন্নয়নের অপরিহার্যতা স্বীকার করে তাকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে তার লক্ষ্য এখনো সুস্পষ্ট নয়। এই অভিযানের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়েছে রাজনীতি মূল লক্ষ্য হারিয়ে তা লুটপাট ভোগের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। সুনীতি ও নৈতিকতার আদর্শ বিসর্জন দেয়া এবং মানবকল্যাণের সর্বজনীন ধারণাকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। এই অনৈতিকতার প্রভাব সমাজে পড়ে তাকে বিষিয়ে তুলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো যতটুকু নীতিবোধ জাগ্রত রয়েছে, তাও একসময় হারিয়ে যেতে পারে। সমাজ থেকে যদি নীতিবোধ হারিয়ে যায় তবে অপরাধ দুর্নীতি ও নানাবিধ স্খলনের বিষবাষ্পে সবার প্রাণ সংহার ঘটতে পারে।

নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে একটি মানবিক সমাজ গঠন করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যাপক ধারণা ও নির্দেশনা সন্নিবেশিত রয়েছে। সংবিধান সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, এ দেশে গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে সমাজ গঠিত হবে। কোনো বৈষম্য, অনাচার, কর্তৃত্ববাদিতার স্থান এ জনপদে হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন। এমন প্রশাসন যৌথভাবে জবাবদিহি করবে অপর রাষ্ট্রীয় সংগঠন আইন সভার কাছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা কেবলই কেতাবেই স্থান নিয়ে আছে। জবাবদিহিতার এই কালচার তথা সংস্কৃতির চর্চা না থাকায় অপরাধ অনিয়ম করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে। যে সরকারি প্রতিষ্ঠান অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে মানুষকে ‘নসিহত’ করবে, সেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।

অথচ এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং সে কারণেই তাকে নিয়ে আর তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যদি এমন অনুরাগ-বিরাগের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় তা হলে আইনের শাসন যাবে কোথায়? আর আইনের শাসন জারি হওয়ার ক্ষেত্রে এহেন ব্যত্যয়ের কারণেই আজকে দেশে এমন বেআইনি কার্যক্রমই সিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। অথচ যারা এ দেশের স্থপতি, তারা এই জনপদের মানুষের পরম অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সংবিধান রচনা এবং তার আলোকে এই দেশকে বিনির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আজ তাদের উত্তরসূরিরা যেভাবে এই আমানতের হেফাজত করছেন তাকে কোনোভাবেই শুদ্ধ ও সঠিক বলা যায় না।

অপরাধজনিত কারণে সমাজে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বস্তুত তা রাষ্ট্রাচারের বড় ত্রুটি হিসেবেই ধরে নিতে হবে। আজকে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে, তা আসলে প্রকৃত শাসন নয়। সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে, যাকে প্রশাসনিক ভাষায় ‘সুশাসন’ বলা হয়ে থাকে। । যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দিয়ে পরিচালিত হয়, সে রাষ্ট্রের অগ্রগতি হয় তত বেশি। সেখানে নীতি ও রাষ্ট্রীয় বিধানের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা তত বেশি পরিলক্ষিত হয়। সেই সাথে আরো লক্ষ করা যায় যে, কেউ এই নীতির লঙ্ঘন করে দুরাচারী হওয়ার সাহসী হয় না। কেননা তাতে শাস্তির ব্যবস্থাই কার্যকর হবে, কোনো প্রশ্রয় তাতে পাওয়া যাবে না।

সুশাসনের আরেকটি শর্ত হচ্ছে, সেখানে পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। রাষ্ট্র তার সৎ শুদ্ধাচারী যোগ্য কর্মীদের পুরস্কৃত করবে, পক্ষান্তরে নীতিভ্রষ্টতার জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে; যা কিনা সৎ কর্মে উৎসাহিত করবে এবং ভ্রষ্টতা থেকে দূরের থাকার প্রেরণা জোগাবে। আমাদের সংবিধান প্রশাসনকে সৎ নিষ্ঠাবান এবং দুরাচার থেকে দূরে থাকার একটি ব্যবস্থা রেখেছে। সেটা হলো ন্যায়পালের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই এই বিধানটি কার্যকর করেনি। তাই এর সরল অর্থ এটাই যে, অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো প্রশাসনই একটি পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উৎসাহী ছিল না।

[email protected]