আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওলামা লীগের সাথে তাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। শুধু অস্বীকার করাই নয়, ওলামা লীগকে তিনি বাটপাড়দের সংগঠন বলেও অভিহিত করেছেন। কাজেই এটি শুধু গলা ধরে ধাক্কা নয়- অনেকটা কানে ধরে বের করে দেয়ার মতো অবস্থা। এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় ওলামা লীগ জনাব হানিফকে ভুঁইফোড় বলে ডাকলেও তিনি এখন মোটেও ভুঁইফোড় ব্যক্তি নন। অনেকেই আদর করে ভিন্ন নামে ডাকলেও তিনি বর্তমান শাসক দলটির একজন অন্যতম মুখপাত্র। রাস্তায় বের হলে ট্রাফিক পুলিশদের নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়।
কাজেই হানিফের কথায় তিন তালাক না হলেও কম-ছে-কম এক তালাক বাইন হয়ে পড়েছে। সব কিছু দেখে অনেকেই ওলামা লীগকে আওয়ামী লীগের এপেন্ডিসাইটিস হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এপেন্ডিসাইটিস শরীরের এমন একটি অঙ্গ, যা কোনো কাজে আসে না। কিন্তু জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন ধরনের ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। ওলামা লীগকে নিয়ে এই তুলনাটিও সঠিক নহে। কারণ, ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের অত্যন্ত জরুরি একটি অঙ্গ ছিল। এখন জানা যাচ্ছে, এসব অঙ্গসংগঠনের সবার কাবিননামা নেই। এখন মনে হচ্ছে দাম্পত্য জীবনযাপন করলেও বিশেষ উদ্দেশ্যেই এই কাবিননামাটি করা হয়নি। কাবিননামা হাতে না থাকলেও নিকাহ যে হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সোয়ামির সোহাগ দেখে আগে হয়তো বা আর কাবিননামার কথা তোলা হয়নি। এখন কাজ শেষ হওয়ার পর বিনা ঝামেলায় তালাক দিতে চাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ একই ধরনের সোহাগ করে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে কাছে টেনে নিয়েছিল এ দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীকে। মূলত জামায়াতের এক ধরনের সহায়তায় ও আনুকূল্যে তারা একুশ বছর পর ক্ষমতার স্বাদটি আস্বাদন করে। যাদের সহায়তায় পুনরায় এই ক্ষমতার স্বাদটি ফিরে পায়- সেই জামায়াত নেতাদেরই এখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে একের পর এক ফাঁসি দিচ্ছে। এটিই আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এরা দরকার পড়লে যে কাউকে নিকাহ করে, সোহাগও করে কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো কাবিননামায় দস্তখত করে না। ধর্মীয় বলয়ের ওলামা লীগ থেকে ধর্মবিদ্বেষী ব্লগার, সবার বেলাতেই আওয়ামী লীগ এই পলিসি অবলম্বন করেছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করবে, কাজ শেষে ছুড়ে ফেলবে। ওলামা লীগের মতো মুক্তমনা দাবিদার ব্লগারেরাও ক্ষত স্থানে মলম লাগানোর চেষ্টা করছে।
ওলামা লীগের দীর্ঘশ্বাসটি এখন অনেকটা ‘এক বাঘের গলায় হাড় বিঁধেছিল’ গল্পের মতো হয়ে পড়েছে। গলা থেকে হাড়টি টেনে বের করতে বাঘ তখন এক বকের শরণাপন্ন হয়। বক তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে বাঘের গলা থেকে হাড়টি বের করে আনে। কাজ শেষে বক বকশিশ চায়। কিন্তু বকশিশের কথা শুনে বাঘ গর্জে ওঠে, ‘ কী, তোর সাহস তো কম না! সামান্য বক হয়ে একটা বাঘের মুখের ভেতর তুই ঠোঁট ঢুকিয়েছিস। তারপরও আমি তোকে ভক্ষণ করিনি। এটিই তো তোর জন্য সবচেয়ে বড় বকশিশ! ’
কাজেই ওলামার বেশ ও সুরত থাকার পরও আওয়ামী জমানায় মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়নি, গুম হতে হয়নি, পুলিশের পিটুনি কিংবা গুলি খেতে হয়নি, স্ত্রী-সন্তান বাড়িঘর ছেড়ে অন্য কোথাও রাতযাপন করতে হয়নি- এটিই তো ওলামা লীগের জন্য বড় বকশিশ!
এখন দেখা যেতে পারে এই বাঘের গলা থেকে ওলামা লীগ কী কী কাঁটা তুলে দিয়েছে। পৃথিবীর প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর একটি থেকে অন্যটি শুধু ভিন্নই নয়- অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরের মুখোমুখি। পারস্পরিক সহাবস্থানের প্রয়োজনে স্বয়ং ধর্মই কিছু নিয়ম বাতলে দিয়েছে- তোমার বিশ্বাস তোমার জন্য, আমার বিশ্বাস আমার জন্য। আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্ম নিয়ে এক ধরনের কপটতার আশ্রয় নেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সব ধর্ম নিয়ে এক ধরনের খিচুড়ি বানিয়ে ফেলে।
আওয়ামী লীগের এক এমপি সুন্দর উদাহরণ টেনে ব্যাপারটি আরেকটু স্পষ্ট করে জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার পুত্রবধূ কলকাতা গেলে পূজো করেন, ঢাকায় এলে নামাজ পড়েন। এসব দেখে মানুষ যখন তাদের আসল ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে তখন বিষয়টি পুরো আওয়ামী লীগের জন্য গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দেয়। বকের লম্বা ঠোঁটের মতো তখন এই ওলামা লীগ তাদের লম্বা আলখেল্লা দেখিয়ে আওয়ামী লীগের গলা থেকে সেই কাঁটাটি অপসারণ করে। বাম দিকে কাত হওয়া নৌকাটির ডান দিকে, তখন ওলামা লীগকে বসিয়ে আপরাইট বা সোজা করার চেষ্টা করা হয়।
শুধু তা-ই নয়, পরলোকগত নেতাকে একজন বড় বুজুর্গ ঘোষণা করে নামের পর ‘রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’ সংযোজনেরও প্রস্তাব ওলামা লীগ উত্থাপন করেছে। এত দিন ধর্মীয় ক্ষেত্রে অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে যে সেবা করে এসেছে, এখন দুয়েকটি সোজা কথা বলে ফেলায় সেই ওলামা লীগকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
ক্রিকেটপাগল পাকিস্তানের স্বনামধন্য ক্রিকেটার ইমরান খানের সমূহ সম্ভাবনা ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। কিন্তু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এক বিদেশিনীকে বিয়ে করায় সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে পড়ে। মুসলিম সমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যারা প্র্যাকটিসিং মুসলিম নন, তারাও খাওয়া-দাওয়া ও বিবাহ-শাদী প্রভৃতি বিষয়ে বেশ রক্ষণশীল আচরণ করেন। অনেকেই মদ খেলেও শূকর খান না। অমুসলিম মেয়ের সাথে সামান্য এদিক-সেদিক করলেও বিয়ে করতে চান না। মুসলিম বিশ্বের এই স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সবাই ওয়াকেবহাল।
মুসলিম আইনপ্রণেতাদের সর্বশেষ ইজমা ও কিয়াসকে অবজ্ঞা করে ওলামা লীগ এখানে আহলে কিতাবের রুল টেনে এনে এগুলোকেও জায়েজ করে দিয়েছেন। এর রাজনৈতিক ফলাফল বা প্রভাব সামনের দিনগুলোতে আরো স্পষ্ট হবে। তখন ওলামা লীগের প্রয়োজনীয়তা আওয়ামী লীগ আরো বেশি করে অনুভব করবে।
এই ধরনের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাটপাড়ির খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দলটি ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার চেয়ারটি কোনো কারণে সরে গেলে প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ হবে।
ইন্টারনেট, ফেসবুকের এই যুগে মানুষের মুখ ও বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সর্বশেষ বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও টিভি উপস্থাপক বিরাশি বছর বয়স্ক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে শফিক রেহমান কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ ধারণ ও প্রচার করতেই পারেন। একটি সমাজে ভিন্ন চিন্তা ও ভিন্ন মতের মানুষ থাকবেই। এটিই একটি গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য।
শফিক রেহমান যদি কোনো ভুল বা অন্যায় কথা বলে থাকেন বা লিখে থাকেন তবে তার কথার জবাব কথা দিয়ে, লেখার জবাব লেখা দিয়ে দেয়া যেত। দেশের একটি বা দু’টি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল শফিক রেহমানের কথা বা লেখা প্রচার করলে কমপক্ষে বিশটি দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সমালোচনা বা বিরুদ্ধ মতবাদের কথা প্রচারের জন্য। সরকার সমর্থক সাংবাদিক বা কলামিস্টেরও কোনো অভাব নেই। বিরাশি বছর বয়স্ক এক সাংবাদিককে রিমান্ডে নিয়ে চরম নির্যাতন নিঃসন্দেহে সরকার এবং তার স্তাবকদের জন্য একটি বড় নৈতিক পরাজয়।
জানি না এসব বোঝার মতো প্রজ্ঞাবান মানুষ আওয়ামী লীগে এখনো অবশিষ্ট রয়েছে কি না। মানুষের মন জয় করার চেয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত বা আতঙ্কগ্রস্ত করে সমর্থন আদায় আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের জন্য কখনই কল্যাণকর হতে পারে না। রাতের এই অন্ধকার কেটে গেলে দিনের আলোতে তাদের এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। তা ছাড়া মিডিয়াকে যখন শক্তি প্রয়োগ করে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয় এবং সব বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া হয় তখন নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ অনেক গুজবকেই সত্য বলে মেনে নেয়। সেসব গুজব একটি সরকারের জন্য স্বাধীন মিডিয়ার চেয়েও ক্ষতিকর হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে বর্তমান সোশাল মিডিয়ার এই যুগে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের এই প্রচেষ্টা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে পড়তে পারে। সরকার তখন ধর্মীয় বাটপাড়দের মতো সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংবাদিকতা জগতের বাটপাড়দের দৌরাত্ম্যও সম্যক উপলব্ধি করতে পারবে। তত দিনে দলের বা দেশের ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।
ভারতের প্রথিতযশা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছেন, পথ হারিয়ে অজানা গন্তব্যে বাংলাদেশ। তিনি ভারতে বসে যে ভয়ঙ্কর বিষয়টি টের পাচ্ছেন আমরা দেশে বসেও অনেকেই তা টের পাচ্ছি না। নাকে সরিষার তেল মেখে ঘুমাচ্ছি। কাজেই কোনো বিশেষ দলের স্বার্থে নয়, মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার্থেই সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। এখানে কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করলে তা শুধু বিএনপি-জামায়াতকেই অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলবে না, আওয়ামী লীগসহ পুরো দেশকেই তলিয়ে দেবে। কাজেই ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সব বাটপাড়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য বিবেকবান সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ দেশের নগণ্য একজন বাসিন্দা হিসেবে সবার প্রতি আবেদন, প্লিজ ওয়েক আপ, মাই কান্ট্রিমেন! প্লিজ ওয়েক আপ।