ফরহাদ মজহার
১. ভাষা ও শব্দ ব্যবহার রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার না। বাংলাদেশের রাজনীতির একটা ইতিহাস আছে। সেখানে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ কথাটার ব্যবহার সমাজে যে বিভাজন তৈরি হয় তার কুফল অনেক সুদূরপ্রসারী। অন্যদিকে বাংলাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ফ্যাসিস্ট শক্তি পরিগঠন এবং বাংলাদেশকে দিল্লীর আধিপত্যের অধীনস্থ করবার তত্ত্ব হিশাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের লড়াই ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই। এই পরিস্থিতিকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ব্যবহার করে আড়াল করা যাবে না।
‘রাজাকারের বাচ্চা’ নামক ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয় তার দ্বারা বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের সন্তানদের কি চোখে আমরা দেখি সেটা বোঝা যায়। রাজাকারের বাচ্চা তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশের তরুণ সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক দিকে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত ও শিক্ষিত হেলমেট ও হাতুড়ি লীগ আর বিপরীতে আছে রাজাকারদের নাতি-নাতনি ও পোতা-পুতনি । তারা, বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত হেলমেট ও হাতুড়ি লীগের কাজ হচ্ছে রাজাকারের নাতি-নাতনি ও পোতা-পুতনিদের সমূলে নির্মূল করা। এই ভাবেই যে যুদ্ধ ক্ষেত্র সাজানো হয়েছে তা ভয়াবহ ও ভয়ংকর। এখন একশন চলবে, চলছে। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বিবৃতিজীবীরা যথারীতি রাজাকার তত্ত্বের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। চলমান মুক্তিযুদ্ধ বা রাজাকার নির্মূল অপারেশান ভাল ভাবে শুরু হয়েছে। সাতজন ‘রাজাকার’ খতম করা হয়েছে, কতজনকে জখম করা হয়েছে ইয়ত্তা নাই। লড়াই চলবে।
২. শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় গুণ হোল, তিনি কখনই শত্রুমিত্র ভেদ করতে ভুল করেন না। আপনি হয় মুক্তি যুদ্ধের চেতনার পক্ষে, অথবা আপনি রাজাকার। মাঝখানে ‘অ’ কিম্বা ‘আ’ অথবা ব্যঞ্জন বর্ণে ‘খ’, কিম্বা ‘গ’ নাই। যদি আপনি আওয়ামী লীগ না করেন, শেখ হাসিনাকে ভালো না বাসেন, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম রাখবার জন্য অস্ত্র হাতে মাঠে না নামেন, আপনি অবশ্যই রাজাকার।
আমি কে তুমি কে
রাজাকার রাজাকার
কে বলেছে কে বলেছে?
স্বৈরাচার স্বৈরাচার
এইসব শ্লোগান দিয়ে লাভ হবে না। মাঠ সাজানোই ছিল। নিজেদের ‘রাজাকার’ বললে ফ্যাসিস্ট শক্তি বলছে, “ঐ তো, বলেছি না, এখন তারা নিজেরাই নিজেদের রাজাকার দাবি করছে’। তো করুক। আন্দোলন করবার আগে ভাবেন নাই কেন? এখন এগিয়ে যান। জনগণ সঙ্গে আছে। কারন ফ্যাসিস্ট শক্তির চোখে জনগণ মানেই এখন ‘রাজাকার’। এটা পাকিস্তানী রাজনীতিরই দ্বিতীয় বঙ্গীয় সংস্করণ। অথবা জর্জ বুশ মার্কা জয় বাংলা এডিশানঃ “হয় তোমরা আমাদের সঙ্গে অথবা তোমরা রাজাকার।
৩. ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রশক্তি ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সমাজের সকল নিপীড়িত শ্রেণী, শক্তি ও গোষ্ঠির স্বার্থ নিহিত রয়েছে। তাই তরুন ছাত্রদের বুঝতে হবে এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাকাছে নাই। এটাই হবার কথা। এই আন্দোলন জনগণ বনাম ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। বাস্তবিক কারনেই সেটা ঘটছে। তাই এই দিকটি সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে হাজির করা, স্পষ্ট করে তোলা এবং জনগণকে সংগঠিত করতে পারার ওপর আগামির বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি একে ‘আইনী’ ব্যাপার করতে চায়, কিন্তু আদালতের মীমাংসার জন্য তাদের তর সইছে না। ‘রাজাকার তত্ত্ব’ পেশ করবার মধ্য দিয়ে গণমানুষের মনে তারা ভাল জ্বালানি সরবরাহ করেছে। আগুনে ঘি পড়েছে।
৪. আবারো বলি: বাংলাদেশের জনগণকে একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পিরিয়ড। দাঁড়ি। এই বাস্তবতায় প্রতিটি সরকার বিরোধী কিম্বা গণস্বার্থসম্পন্ন আন্দোলন একটি মাত্রা অতিক্রম করবার পর সরাসরি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে বাধ্য। এর আগের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কোটা সংস্কার আন্দোলন এর জন্য তৈরি ছিল বলে মনে হয় না। এতে আপাতত কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু এর বিপদ ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এখন হুঁশিয়ার হওয়া বিশেষ ভাবে জরুরি।
৫. আন্দোলনের দৃশ্যমান দুর্বলতা হচ্ছে:
(ক) জনগণের চোখে এখনও এই আন্দোলন নেতৃত্ববিহীন।
(খ) কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা নাই যারা আন্দোলনে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য।
(গ) ফলে সমাজের অন্যান্য আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ ও সমর্থন তৈরির কোন কার্যকর প্রক্রিয়া অনুপস্থিত। আমার এই মূল্যায়ন যদি ঠিক হয় তাহলে এক পর্যায়ে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। অথচ ফ্যাসিস্ট সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা গেলে আন্দোলনের জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া শাপে বর হতে পারে। এর সুবিধা নিতে হলে তরুণদের উনসত্তরের গণ অভ্যূত্থান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে পূর্বানুবৃত্তি ঘটবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
৬. দ্বিতীয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যেখানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তার কারনে এই লড়াই সাময়িক স্তিমিত কিম্বা ঝুলে যেতে পারে, কিন্তু থামবে না। কারন বাংলাদেশের জনগণ আগের চেয়ে সচেতন। তরুনরা জনগণের সচেতনতার মাত্রা অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারলে বুঝবে যে জনগণ শুধু কোটা সংস্কার দাবির মধ্যে আটকে থাকতে রাজি না। শেখ হাসিনা ঠিক বুঝছেন কিনা জানি না। তবে যে চোখকে তিনি শাসিয়ে পিছু হঠাতে চাইছেন সেটা কিন্তু কোটা সংস্কার না। সেটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এটা বাংলাদেশের জনগণের চোখ। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। ঝাঁপিয়ে পড়লে রক্ষা নাই।
৫. মোদির আগমন কেন্দ্র করে বাংলাদেশে দিল্লী বিরোধী যে তরুণ লড়াকুরা গড়ে উঠেছে সম্ভবত এই আন্দোলন তাদের আরও পরিণত করবে। যারা আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে আন্দোলনকে সঠিক ভাবেই একটা উপমহাদেশীয় চরিত্র দিতে চেয়েছে তাদের বুঝতে হবে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ জাতীয় ভাষা ও তত্ত্বের উৎপত্তি কোথায়। এই তত্ত্বের উৎপত্তি হিন্দুত্ববাদের গর্ভে। এর সারকথা হচ্ছে দিল্লী সমর্থিত ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধিতা মানেই ‘রাজাকার’ হওয়া। দিল্লির নির্লজ্জ দালাল ও ফুট সোলজারদের বিবৃতি দেখে অবশ্য রাজাকার তত্ত্ব ও হিন্দুত্ববাদের সম্পর্ক বুঝতে আমাদের অসুবিধা হবার কথা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এতোকাল এই তত্ত্ব জনগণকে গেলানো গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। আমি তা মনে করি না।
৬. মোদি-অমিত শাহ ক্লিক এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে ভারতেও জনমত গড়ে উঠেছে। তাই বিপদ এখানেও। দিল্লী স্বাভাবিক কারনেই বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করবে। করছে। সেটা দৃশ্যমান হবে এমন কোন কথা নাই। কোটা বিরোধী আন্দোলনকে রাজাকারদের নাতিপুতিদের আন্দোলন হিশাবে চিহ্নিত করবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে দিল্লি ক্ষমতাসীনদের দিয়ে ভূরাজনৈতিক ঝাণ্ডাটাই আমাদের দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিল।
মনে রাখবেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস বোঝে, দিল্লিও সে ভাবেই বোঝে। এই বাস্তবতা মনে রেখে আন্দোলন সাজানোর দরকার আছে।
দিল্লীর বিরোধিতা করুন, কিন্তু মনে রাখবেন ভারতেও হিন্দুত্ববাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি রয়েছে। বাংলাদেশ উপমহাদেশীয় শক্তি বলয়ের বাইরে না।