কার্যকর বিরোধী দলের শূন্যতা পূরণই চ্যালেঞ্জ

কার্যকর বিরোধী দলের শূন্যতা পূরণই চ্যালেঞ্জনব্বই দশকের শুরুতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হলেও রয়ে গেছে কার্যকর সংসদের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের বিতর্ক। এমন আলোচনা আর বিতর্কের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা এবং নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করছেন, এই সংসদে একটি দল ও পেশার একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই সংসদীয় কার্যক্রমে আধিপত্য বিস্তারকারীদের স্বার্থের প্রতিফলন ঘটার ঝুঁকি রয়েছে।

এদিকে নতুন সংসদের সূচনালগ্নে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সারাদেশে করবে শান্তি সমাবেশ; অন্যদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কালো পতাকা মিছিল বের করার ঘোষণা দিয়েছে।
আগের সংসদে বিএনপির ছোট আকারের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে এবার মাত্র পাঁচটি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকছে। বিএনপি, সমমনাসহ ১৫ দল বর্জন করলেও ২৮ দল নির্বাচনে অংশ নেয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয়লাভ করে। বাকি ৬২ আসনে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সংসদের আসন ৩০০ হলেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ২৯৯ আসনে ভোট হয়। এক প্রার্থী মারা যাওয়ায় নওগাঁ-২ আসনের ভোট এখনও হয়নি।

ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন অবশ্য বলছেন, স্বতন্ত্র সদস্যরা স্বতন্ত্র হিসেবেই সংসদে থাকবেন। তাদের আওয়ামী লীগের অংশ ধরা ঠিক হবে না। স্বতন্ত্রদের কার্যক্রম সংসদে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি জাতীয় পার্টি সংখ্যায় কম হলেও তারা কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে বলে আশা রাশেদ খান মেননের।
আওয়ামী লীগের দলীয় হুইপিংয়ের অধীনে থেকে স্বতন্ত্র এমপিরা কতটুকু স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করতে পারবেন– এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, দলীয় হুইপিংয়ের বিষয়টি সম্ভবত ঠিক নয়। আর চিফ হুইপের নির্দেশনা মেনে চলা বিরোধী দলসহ সব সদস্যের দায়িত্ব।

১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে উভয়েই বিরোধী দলে থাকতে বেশির ভাগ সময় সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি চালু করে। দশম সংসদ থেকে টানা বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে জাতীয় পার্টি। যদিও তারা এ সময় সব সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন করে সংসদে এসেছে। ফলে তারা কখনোই নিজেদের বিরোধী দলের পরিচয়ে আস্থা অর্জন করতে পারেনি। বেশির ভাগ সময় সংসদে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হয়েছে। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেও তারা যে ১১ আসনে জয় পেয়েছে, সেখানে নৌকা প্রতীক তুলে নেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে এই সংসদে কতটুকু তারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে– সেটাই চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যদিও জাতীয় পার্টি গৃহপালিত নয়, আসল বিরোধী দল– তা প্রমাণের সুযোগ এসেছে বলে মনে করেন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গতকাল তিনি বলেছেন, মানুষের মধ্যে সমালোচনা ছিল গৃহপালিত বা এ ধরনের শব্দ। জাপার জন্য যাতে শব্দগুলো আর ব্যবহার না হয়, সে লক্ষ্যে সংসদ ও সংসদের বাইরে আগামী দিনে ভূমিকা রাখার কথা জানান তিনি।
মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে জাপার এমপিরা কাজ করবেন জানিয়ে চুন্নু বলেন, দলীয়ভাবে সংসদে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তা স্পিকারের দৃষ্টিতে এসেছে। সংসদের কার্যক্রমে এর ভূমিকা থাকবে। সংখ্যাটা বড় নয়; সংসদে কারা বিরোধী দল, তা আসল বিষয়।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ সংসদের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, একটি দলের একচ্ছত্র আধিপত্য। কারণ, ১১ জনের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সরকারি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে জিতে এসেছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব এই সংসদে অনুপস্থিত। কারণ, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এমপি এসেছেন ব্যবসায়ী পেশা থেকে। ফলে সংসদের কার্যক্রমে এই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারীদের স্বার্থের প্রতিফলন ঘটার ঝুঁকি রয়েছে।

তিনি বলেন, এসব কিছু বিবেচনায় সংসদের মৌলিক কাজ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রত্যাশা খুবই কঠিন। কারণ, প্রক্রিয়াগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পুরোপুরি অনুপস্থিত।
নতুন সংসদের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনেক সময় একচ্ছত্র আধিপত্যের মাধ্যমে যাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে, তাদের মধ্যে জনহিতকর চিন্তাভাবনা কাজ করলে ইতিবাচক কিছু ঘটতে পারে। তিনি বলেন, এটি হয়তো অলীক ভাবনা হতে পারে; তবু বিশ্বের অনেক দেশে এমন উদাহরণ আছে।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের কারণে ভোটের আগেই ক্ষমতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা ছিল, বিরোধী দলের আসনে কে বসবে? বিএনপির দলছুটদের নিয়ে একাধিক কিংস পার্টি ভোটে অংশ নিলেও তারা কোনো আসনে জিততে পারেনি। ফল ঘোষণার পর আলোচনায় চলে আসেন স্বতন্ত্র ৬২ এমপি; যাদের পাঁচ-ছয়জন বাদে বাকি সবাই আওয়ামী লীগের পদধারী। এই স্বতন্ত্র এমপিরা সংসদে জোট গঠনের মাধ্যমে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের আলোচনা জোরালো হলেও শেষ পর্যন্ত তা হালে পানি পায়নি। এই এমপিদের সবাই আওয়ামী লীগে ফিরতে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মতে, এবার স্বতন্ত্র এমপিরাই হতে পারেন মূল আকর্ষণ। কারণ, এর আগে এত সংখ্যক স্বতন্ত্র সদস্য কখনোই সংসদে ছিলেন না। সংসদকে প্রাণবন্ত বিতর্কের ভূমিকায় রাখতে তাদের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিদায়ী একাদশ সংসদে বিএনপির মাত্র সাত সদস্য ছিলেন। তারা সরকারের যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিরোধী দলকে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। তাই জাতীয় পার্টির ১১ জন ও স্বতন্ত্র সদস্যরা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারলে কার্যকর সংসদ করা খুব বেশি কঠিন হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, কেউ ইচ্ছা করলেই শক্তিশালী বিরোধী দল বা জোট গঠন করে দিতে পারে না। সরকারি দল বা বিরোধী দল সবাইকে ভোটে জিতে আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ বর্জনের দীর্ঘ সংস্কৃতি থেকে গত দুটি সংসদ বেরিয়ে আসতে পেরেছে। বিরোধী দলের সদস্যরা সংখ্যায় কম হওয়ার পরও কথা বলার যথেষ্ট সময় পাচ্ছেন। তাই নতুন সংসদও প্রাণবন্ত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

প্রথম দিন স্পিকার নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতির ভাষণ
আজ বিকেল ৩টায় শুরু হবে প্রথম দিনের বৈঠক। অধিবেশনের শুরুতেই নতুন সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হবে। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে একই পদে আবারও মনোনীত করেছে। একক প্রার্থী হিসেবে তারা দু’জনই আজ নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
এদিকে সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ভাষণ দেবেন। পরে ওই ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর অধিবেশনজুড়ে আলোচনা হবে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে মোঃ সাহাবুদ্দিনের এটাই হবে প্রথম ভাষণ।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদের অধিবেশন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ এলাকায় যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। প্রথম অধিবেশন সংসদ থেকে সরাসরি দেখার জন্য বিদেশি কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

প্রথম দিনের কার্যসূচিতে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পাশাপাশি সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন, শোক প্রস্তাব ও রাষ্ট্রপতির ভাষণ রয়েছে। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরই প্রথম দিনের বৈঠক মুলতবি করা হবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নেতা ও দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করবেন। এদিকে সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দলের নেতা হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জি এম কাদের) বিরোধী দলের নেতা ও দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধীদলীয় উপনেতার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

এর আগে রাষ্ট্রপতি দ্বাদশ সংসদের চিফ হুইপ হিসেবে নূর-ই-আলম চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ইকবালুর রহিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মো. নজরুল ইসলাম বাবু, সাইমুম সরওয়ার কমল ও মাশরাফি বিন মুর্তজাকে হুইপ নিয়োগ দেন।

সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদকে বিরোধীদলীয় হুইপ মনোনীত করেছে।

২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। আইন অনুযায়ী ওই সংসদের মেয়াদ গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে। একাদশের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিনই দ্বাদশ সংসদের মেয়াদ শুরু হলো।

আসন বণ্টন 
সরকারি দলের প্রথম সারিতে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনটি সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী এবং তার পরের আসনটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে। এ ছাড়া প্রথম সারিতে আসন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদ ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সংসদ নেতার পেছনের সারির প্রথম আসনে সরকারি দলের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বসবেন।

সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসন জি এম কাদের ও বিরোধীদলীয় উপনেতার আসন আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিরোধী দলের প্রথম সারিতে বিরোধীদলীয় উপনেতার পাশের আসনটি জাপার রুহুল আমিন হাওলাদার এবং তার পরের তিনটি আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র এমপি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ও ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননকে। বিরোধীদলীয় নেতার পেছনের সারির প্রথম আসনে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু বসবেন। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের পাশেই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আসন দেওয়া হয়েছে।

সূত্র : সমকাল