এবার বিদ্যুৎ, সারের বন্ডের জন্য টাকা ছাপাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

কিন্তু মুদ্রানীতি ঘোষণার মাসেই সরকারের দেওয়া ‘বিশেষ বন্ডের’ বিপরীতে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যাতে বাড়ছে মুদ্রা সরবরাহ। এতে সুদহার ধরা হয়েছে নীতি সুদহারের সমান, অর্থাৎ ৮ শতাংশ। মেয়াদ দেওয়া হচ্ছে ১৮০ দিন পর্যন্ত। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির লক্ষ্য থেকে সরে আসছে বলে মনে করছেন আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

টাকার অভাবে সার ও বিদ্যুতের দেনা মেটাতে ব্যাংকগুলোকে এই বিশেষ বন্ড দিচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যে পাঁচ ব্যাংককে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড দেওয়া হয়েছে। এখন এই বিশেষ বন্ডের বিপরীতেই টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতিমধ্যে ১৮০ দিন মেয়াদের জন্য আইএফআইসি ব্যাংককে ৪৫৯ কোটি টাকা ও সিটি ব্যাংককে ১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এটা মুদ্রানীতির লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ এই বন্ড জমা রেখে টাকা নিতে পারছে ব্যাংকগুলো। এটা নিয়মিত ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার অংশ। অন্যভাবে টাকা দিতে গেলে মেয়াদ দীর্ঘ হতো। যার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে বেশি পড়ত। এখন যে মাধ্যমে তারল্যসুবিধা দেওয়া হচ্ছে, এর প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে খুব বেশি পড়বে না।

কে কত টাকার বন্ড পেল

রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় টাকার সংকটে পড়ে সরকার বিশেষ বন্ড ছাড়ার এই কৌশল নিয়েছে। এই বন্ড দেওয়া হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। সরকারের কাছে সার ও বিদ্যুতে বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থার পাওনা প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি ১৪ হাজার কোটি টাকা বকেয়া। সারে বকেয়া ১২ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক সংকটে থাকা সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া শুরু করেছিল। তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সে পথ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরে এসেছে। এখন সরকার দেনা মেটাতে বন্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। ইতিমধ্যে সারের বকেয়া পরিশোধে ইসলামী ব্যাংককে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংককে ২৫৫ কোটি টাকা ও আইএফআইসি ব্যাংককে ৪৫৯ কোটি টাকার বন্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে সিটি ব্যাংককে ১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ও পূবালী ব্যাংককে ৭৭ কোটি টাকার বন্ড দেওয়া হয়েছে।

বন্ডের বিপরীতে নগদ টাকা পাচ্ছে ব্যাংক

সরকার থেকে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ বন্ড দেওয়া শুরুর পর এই বন্ডের বিপরীতে তারল্যসুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিস তারল্য ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে থাকে। গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এক চিঠিতে মতিঝিল অফিসকে জানায়, ব্যাংকগুলো সার ও বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া দায়দেনা নিষ্পত্তির জন্য সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ‘বাংলাদেশ সরকার স্পেশাল পারপাস ট্রেজারি বন্ড’কে জামানত হিসেবে গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বর্তমানের নীতি সুদহারে ১ দিন, ৭ দিন, ১৪ দিন, ২৮ দিন ও ১৮০ দিন মেয়াদি নিশ্চিত রেপো (বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ) প্রাপ্য হবে। এ ক্ষেত্রে জামানত হিসেবে দেওয়া দায়মুক্ত ‘বাংলাদেশ সরকার স্পেশাল পারপাস ট্রেজারি বন্ড’-এর সমপরিমাণ অর্থ রেপো হিসেবে দেওয়া হবে। সরকার কর্তৃক নিলামের এই বন্ড তুলে না দেওয়া পর্যন্ত এই বন্ড রেপোর জন্য বিবেচিত হবে।

এ জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে বিভাগটি। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকগুলোকে রেপো দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইলেকট্রনিক সিস্টেমে এই বন্ড জামানত হিসেবে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বন্ডের মেয়াদপূর্তিতে জামানতকৃত বন্ডটি বন্ধক (লিয়েন) রাখা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে টাকা কেটে রাখা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট হিসাবে জমা করা। এ ছাড়া মেয়াদপূর্তিতে গ্রহণ করা রেপোর সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট হিসাবে জমা করে ব্যাংকগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও রেপো দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় গত দুই দিনে বন্ড পাওয়া ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংককে বন্ডের বিপরীতে টাকা দেওয়ার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো ৮ শতাংশ সুদে টাকা ধার নিয়ে ১১-১২ শতাংশ সুদে ঋণ বা বাজারে খাটাতে পারবে।

এতে সুবিধা হয়েছে সরকার ও ব্যাংক—উভয়ের। কারণ, বকেয়া টাকা পেয়েছে ব্যাংকগুলো, আবার সরকারও কিছুটা দেনামুক্ত হয়েছে। তবে টাকা ছাপিয়ে সরকারের বন্ডের বিপরীতে ঋণ দেওয়া চালু করায় মূল্যস্ফীতি কমবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বাজারে টাকার সরবরাহ আরও কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে আগের চেয়ে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। পাশাপাশি লাগাম টানা হয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণেও।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুরেফিরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই টাকা বের করছে। সরাসরি টাকা ছাপিয়ে দিলে হয়তো এই সময়ের জন্য শোভন হতো না, এ জন্য একটু অন্য পথে দেওয়া হচ্ছে। এসব দায় ধীরে ধীরে বাড়বে। সামনেও হয়তো সরাসরি টাকা ছাপিয়ে শোধ করবে। এর ফলে সার ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর কোনো উদ্যোগ থাকবে না, বাড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ। আর মুদ্রানীতির লক্ষ্যের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক।’

প্রথম আলো