.
হতাশা ভুলে নির্বাচনের মাঠে নামলেও স্বস্তিতে নেই ১৪ দলের শরিকরা। আসন সমঝোতার মাধ্যমে নৌকা পাওয়া শরিক দলগুলোর প্রার্থীদের হারের ‘শঙ্কায়’ ভুগতে হচ্ছে। এসব আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাদের জন্য।
অন্য যে শতাধিক আসনে শরিক দলগুলো দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, সেগুলোতেও নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে। টানা তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে থাকা শরিক দলগুলো এবারই প্রথম এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
এর আগে থেকে আসন বণ্টন নিয়ে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েন চলে। একাদশ জাতীয় সংসদে তাদের দখলে থাকা বর্তমান আটটি আসনের সঙ্গে আরও দু-একটি আসনে ছাড় চেয়ে দেনদরবার চালিয়ে গেছে শরিকরা। তবে কয়েক দফা বৈঠকের পরও কখনও সাতটি, কখনও আটটির বেশি আসনে ছাড় দিতে সম্মত হয়নি আওয়ামী লীগ।
শেষ পর্যন্ত ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়ে এসে আওয়ামী লীগ থেকে তিন শরিক দলকে ছয়টি আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের জন্য ছাড় দেওয়া হয়। এসব আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে আওয়ামী লীগের দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে নেওয়ার শরিকদের দাবি পুরোপুরি অগ্রাহ্যই থেকে গেছে।
অন্যদিকে, আসন সমঝোতায় বর্তমান এমপি জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারকে ফেনী-১ এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মোস্তফা লুৎফুল্লাহর সাতক্ষীরা-১ আসনে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। মোস্তফা লুৎফুল্লাহ এরই মধ্যে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হতাশ শিরীন আখতার এখন দলীয় প্রতীকে লড়ছেন।
শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাঁচটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতারা জোট শরিক প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি। এ কারণে নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে রেহাই মিললেও কোথাও জাসদ, কোথাও ওয়ার্কার্স পার্টি এবং কোথাও জাতীয় পার্টি-জেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।
এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২ আসনে প্রভাবশালী দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাঁর বিপক্ষে ভোটের মাঠে আছেন বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও তিনবারের সাবেক এমপি মনিরুল ইসলাম মনি এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতি এ কে ফাইয়াজুল হক। ফলে এ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সাবেক এমপি তালুকদার মো. ইউনুস সরে গেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন মেনন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী প্রকাশ্যে মেননের পক্ষে থাকলেও সন্দেহের তালিকায়ও আছেন অনেকে। অনেকে প্রকাশ্যে নৌকার কর্মী দাবি করলেও গোপনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। মেননের নিজ বাড়ি পাশের নির্বাচনী আসন বরিশাল-৩ এর বাবুগঞ্জ উপজেলায় হওয়ায় ‘বহিরাগত’ আখ্যায়িত করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাঁকে আক্রমণ করছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বানারীপাড়া-উজিরপুরে নেতার কি অভাব পড়েছে যে বহিরাগত এনে নৌকার প্রার্থী করতে হবে?’ ফাইয়াজুল হক বলেন, নৌকা প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। আশা করি, ভোটাররা সুচিন্তিত মতামত দিয়ে আমাকে বিজয়ী করবে।
মেননের মতে, তিনি বরিশালেরই সন্তান। এলাকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সব সময় ছিল। তাঁর বিশ্বাস, উজিরপুর-বানারীপাড়াবাসীসহ গোটা বরিশালের মানুষ ভোটের মাঠে তাঁকে সহযোগিতা করবেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর জানা গিয়েছিল, গত তিনবারের এমপি জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি। ফলে বেশ স্বস্তিতেই ছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী উন্মুক্ত করে দেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েন ইনু। তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন। এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ পুরোপুরিই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। ফলে গত কয়েক বছর ধরেই কুষ্টিয়ায় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া আওয়ামী লীগ ও জাসদকে কুষ্টিয়া-২ আসনে সরাসরি লড়তে হচ্ছে।
এরই মধ্যে কামারুল ঘোষণা দিয়েছেন, জাসদের পক্ষে আর ভাড়া খাটবেন না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তিনি জনতার নেতা হয়ে মাঠে থাকবেন। ভেড়ামারা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আক্তারুজ্জামান মিঠু বলেন, আমরা গত তিনটি নির্বাচনে ইনুকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছিলাম। তবে তাদের কাছ থেকে ভালো আচরণ পাইনি। তাই আওয়ামী লীগ ও কর্মীদের বাঁচাতে আমরা এবার দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি।
এমন অবস্থায় হতাশ হলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা মেনেও নিয়েছেন ইনু। তিনি বলেন, খেয়াল রাখতে হবে, নির্বাচনী পরিবেশটা যেন শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক হয়। কেউ যেন কোনো শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা না বলি। এতে জোটের ঐক্যে ফাটল ধরতে পারে।
রাজশাহী-২ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা গত তিন নির্বাচনের মতো এবারও নৌকা প্রতীক পাওয়ায় সরে যেতে হয় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামালকে। আবার আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশার মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় কিছুটা ভারমুক্তও ছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা। তবে শফিকুর হাইকোর্ট থেকে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় ফের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী। তাঁকে মোটেও সমর্থন দিতে চাচ্ছে না স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ।
শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, জোটের সমর্থনে তিনবার নৌকা নিয়ে এমপি হলেও ফজলে হোসেন বাদশা আওয়ামী লীগ অফিসে আসেননি। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। এবার তাঁকে নৌকা দিলেও দলের সবাই আমার পক্ষে কাজ করছেন।
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, শফিকুরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আছে কিনা বলতে পারব না। সবাই আমার সঙ্গেই আছেন।
বগুড়া-৪ আসনটি ২০০৮ সাল থেকেই জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতি এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনকে দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। এর আগে জোটগত সমঝোতার কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজকে প্রত্যাহার করা হয়। আসনটিতে আওয়ামী লীগের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় স্বস্তিতে আছেন তানসেন। এর পরও বিএনপির চারবারের সাবেক এমপি ও আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মোল্লার বাধা টপকাতে হবে তাঁকে।
তাছাড়া এখানে মাঠে নামানো যাচ্ছে না স্থানীয় আওয়ামী লীগকে। হাতেগোনা দু-চারজন ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকা থেকে দূরে আছেন। নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, নৌকা যাকে দেওয়া হয়েছে, তিনি নৌকার যোগ্য নন। তাঁর হাতে নৌকা তুলে দেওয়ায় আমরা দূরে আছি। অবশ্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নন্দীগ্রাম পৌর মেয়র আনিছুর রহমান এবং নন্দীগ্রাম পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বকুল হোসেন বলেন, ১৪ দলের প্রার্থীর পক্ষে আমরা ভোট চাচ্ছি।
হেলাল উদ্দিন কবিরাজ বলেন, দলের সব নেতাকর্মীকে নির্দেশ দিয়েছি নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য। তানসেন বলেন, মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীরা প্রচারে নামলেও শীর্ষ পর্যায়ের অনেককে পাওয়া যাচ্ছে না। আশা করছি, তারাও মাঠে নামবেন।
আওয়ামী লীগ শরিকদের যেসব আসন ছেড়েছে, তার মধ্যে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনকে চমক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। গত দুটি নির্বাচনে আসনটি দেওয়া হয় বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানকে। তবে এবার তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে এবং দলটিকে সমর্থনও দেয়নি আওয়ামী লীগ।
এবার আসনটি দেওয়া হয় জাসদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোশাররফ হোসেনকে। ফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফরিদুন্নাহার লাইলীকে সরে যেতে হয়েছে। তবে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন তিনজন– সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. আবদুল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী মাহমুদা বেগম এবং দলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য ইস্কান্দার মির্জা শামীম। তারা নৌকার প্রার্থী মোশাররফ হোসেনকে বেশ চাপে ফেলেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে আছেন দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি। ফলে জাসদ ও আওয়ামী লীগের সরাসরি লড়াই এখানেও দেখা যেতে পারে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ইস্কান্দার মির্জা বলেন, আওয়ামী লীগের একটা অংশ আমার পক্ষে কাজ করছে। এলাকার মানুষ পরিবর্তন চায়। আমি বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল্লাহ বলেন, অতীতে আমি এলাকার মানুষের উন্নয়ন করেছি। সেই বিবেচনায় তারা আমাকে বিজয়ী করবেন বলে আশাবাদী।
সমকাল