আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীরাই চায় আসন–সমঝোতা

বিএনপিবিহীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাড়াতে জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) মাঝারি, ছোট, ইসলামপন্থী এবং অন্যান্য দলকে ভোটে টেনেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু কেউ আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে রাজি নয়। সবাই আসন–সমঝোতা করে সংসদ সদস্য হতে চান। এমনকি বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী দল তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা চাইছে।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার রাতে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আসন–সমঝোতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকটি হয়েছে অত্যন্ত গোপনীয়তায়। কোনো পক্ষই বৈঠকের স্থান ও আলোচনার বিষয়বস্তু খোলাসা করেনি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বৈঠকটি হয়েছে গুলশানে একজন রাজনীতিকের বাসায়। বৈঠকে জাতীয় পার্টিকে আসনসহ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কী কী সুবিধা দিতে পারবে, তা আলোচনায় এসেছে।

বৈঠক শেষ মুজিবুল হক চুন্নু প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। জাতীয় পার্টি আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এই বৈঠকের বিষয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে।

অন্যদিকে বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জাপার সঙ্গে ঐকমত্য হয়েছে। বৈঠকটি ছিল ফলপ্রসূ।

এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও জাপার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা দেখা করেছেন বলে জানা গেছে।

৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে কতটি আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন, সেই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

নৌকা প্রতীক–প্রত্যাশীদের তালিকায় ১৪ দলের শরিক ছাড়াও সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) আছে। তবে তারা প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীক চাইছে না। তাদের দলের কোনো কোনো নেতা নৌকা প্রতীক নেওয়ার পক্ষে। এ ছাড়া ইসলামপন্থী দল ও ‘কিংস পার্টি’খ্যাত নতুন নিবন্ধন পাওয়া দলও রয়েছে নৌকা পাওয়ার দৌড়ে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৯টি অংশ নিয়েছে। অবশ্য মনোনয়ন তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর দলের সংখ্যা কমতে পারে।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে অন্তত ২০টি দল সরাসরি নৌকায় নির্বাচন করতে আগ্রহী। বাকি ছোট ও ইসলামপন্থী কিছু দল আলাদা নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন–সমঝোতা চায়। আর কিছু দল আওয়ামী লীগঘেঁষা হলেও নৌকা প্রতীক পাবে না বলে নিশ্চিত। তারা ন্যূনতম আওয়ামী লীগের মিত্রের স্বীকৃতি নিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি এবার বেশির ভাগ আসনে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ার মতো আর্থিক, সাংগঠনিক ও জনভিত্তি নেই বলে মনে করছেন অন্য অংশগ্রহণকারী দলের নেতারা। এ জন্যই সমঝোতার মাধ্যমে অন্তত শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসন নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের কৌশল হচ্ছে প্রথমে প্রত্যাশিত আসনে সমঝোতা। এরপর আওয়ামী লীগের চাওয়া মেনে অংশগ্রহণ দেখাতে অন্যান্য আসনেও তাদের নামকাওয়াস্তে প্রার্থী থাকবে।

১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর মধ্যেই সমঝোতা চূড়ান্ত করতে হবে।

ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ কারা

গতকাল বুধবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, জাপা ও ১৪ দল আসন সমঝোতা চেয়েছে। তাহলে বিরোধী দল কে হবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘সময় হলে বিরোধী দল দাঁড়িয়ে যাবে। তা ছাড়া এখানে আরও অনেক দল আছে। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, সুপ্রিম পার্টিসহ বিভিন্ন দল রয়েছে।’

নির্বাচনে প্রতিপক্ষ কারা হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রতিদ্বন্দ্বী আমাদের প্রতিপক্ষ। যারা নির্বাচন করছে, তারা সবাই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।’

২০০৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল, জাতীয় পার্টি ও আরও কিছু ছোট দল মিলে মহাজোট করেছিল। ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকেরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায়। বাকি আসনে নির্বাচন হয়। ২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে ১৪ দল, জাতীয় পার্টি ও বিকল্পধারার সঙ্গে আসন–সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, এখন লড়াইটা হচ্ছে নির্বাচন বর্জনকারী বনাম অংশগ্রহণকারীর। অংশগ্রহণকারীরা সমমনা হলে আসন সমন্বয় হতে পারে। এতে মনে হতে পারে সংসদে সব একমনা ও মিত্রশক্তি হয়ে গেল। কিন্তু সংসদে গিয়ে বিরোধিতা করা যাবে না, এমন নয়।

আসন পেতে দৌড়ঝাঁপে অন্যরাও

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ২০ নভেম্বর কিংস পার্টি–খ্যাত তৃণমূল বিএনপির শীর্ষ নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি।

গত ২৪ নভেম্বর ইসলামপন্থী ৯টি রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন। এ সময় তাঁরাও সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা চান বলে অংশগ্রহণকারীরা জানান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা নেতাদের দলগুলো হচ্ছে ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, আশেকানে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

এর আগে গত ৩০ নভেম্বর খেলাফত রব্বানী বাংলাদেশ ও নেজামে ইসলামী পার্টির নেতারাও গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানায়।

গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী। তিনি ঢাকা-১৪ ও চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। উপস্থিত সূত্র জানায়, এ সময় মাইজভান্ডারী কোনো একটি আসনে নিজের জয় নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা করেন।

আওয়ামী লীগ ও সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তাদের চাহিদা মেনে আসন–সমঝোতা করলে ৮০-৯০টি আসনে ছাড় দিতে হবে।

এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় যা এসেছে, তাতে জাপা ৪০ আসনের কমে রাজি নয়। ১৪ দলের শরিকদের অগ্রাধিকার ২৫টির মতো আসনে। বিকল্পধারা, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, সুপ্রিম পার্টি, বিএনএফ—এসব দল আরও গোটা ১৫ আসন চাইছে।

এর বাইরে ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন পক্ষ যোগাযোগ করছে। তারাও নিশ্চিতভাবে গোটা দশেক আসন প্রত্যাশা করছে।

আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, জাপার বর্তমান সংসদ সদস্যদের অন্তত অর্ধেক, ১৪ দলের শরিক ও অন্যান্য কয়েকটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতাকে জয়ী করার আশ্বাস দেওয়া হতে পারে। ইসলামপন্থী ছোট দল ও কিংস পার্টিগুলোকে অন্যভাবে পুষিয়ে দিতে হবে। ওই নেতা আরও বলেন, আসন–সমঝোতা চাওয়া দলগুলো সারা দেশে ভোটার আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে না। বরং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তা করতে পারবেন। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের গুরুত্ব এবার বেশি।

নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপিসহ অন্যান্য দল নির্বাচন বর্জন করার কারণে আওয়ামী লীগ চাইলে সব আসনে জয়ী হতে পারবে। অন্য যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তারাও সেটা জানে। এ জন্যই হয় নৌকা নতুবা সমঝোতা চাইছে। এ ধরনের নির্বাচনকে সারা বিশ্বেই একতরফা ও আসন–সমঝোতার নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সূত্র : প্রথম আলো