কঠিন সময়ে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক

কঠিন সময়ে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কমালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ও ভারতের মন্ত্রী রিজিজু

সুধা রামচন্দ্রন  : মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা পরই দ্বীপরাষ্ট্র থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করার জন্য ভারতকে ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ অনুরোধ করেন মোহাম্মদ মুইজ্জু। প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, মুইজ্জু ও ভারতের ভূ-বিজ্ঞানমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর মধ্যকার বৈঠকে আনুষ্ঠানিক এ অনুরোধ করা হয়।

১৭ নভেম্বর মুইজ্জুর শপথ অনুষ্ঠানে ছিলেন কিরেন। ‘মালদ্বীপের জনগণ তাঁকে (মুইজ্জু) ভারতের কাছে অনুরোধ করার জন্য শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছিল’, যাতে মালদ্বীপ থেকে তাদের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। মুইজ্জু ‘আশা প্রকাশ করেছেন, ভারত মালদ্বীপের মানুষের গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে সম্মান করবে।’

মুইজ্জু প্রশাসন বলেছে, তারা ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তাসহ প্রায় ২১টি চুক্তি পর্যালোচনা করছে। তবে এখন পর্যন্ত মুইজ্জুর অনুরোধের বিষয়ে ভারত থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। নয়াদিল্লি ক্ষুব্ধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট সোলিহের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।

মালদ্বীপ পূর্ব-পশ্চিম জাহাজ চলাচল পথের কাছাকাছি অবস্থিত। এখান দিয়ে পারস্য উপসাগর থেকে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ তেল পরিবহন করা হয়।

অবশ্য, ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনও একটি চুক্তি নবায়ন করতে অস্বীকার করেছিলেন, যার অধীনে ভারত দুটি নৌ হেলিকপ্টার দিয়েছিল। সে সময়ও মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় বাহিনীর বিদায় দাবি জানানো হয়।

অবৈধভাবে মাছ ধরা, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র পাচার বন্ধ এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মালদ্বীপের বিশাল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষমতা না থাকায় ভারত তার নিরাপত্তা দিচ্ছে। উপকূলীয় নজরদারি রাডার স্থাপন, সামরিক হাসপাতাল ও মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ সুবিধাও দিচ্ছিল ভারত। একই সঙ্গে দিল্লি তাকে বিমান, হেলিকপ্টার, সামুদ্রিক অ্যাম্বুলেন্স, বিশেষ জাহাজ এবং ইন্টারসেপ্টর বোট বা টহলের নৌকাও দিয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত মালদ্বীপের সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে। খেয়াল করুন, মালদ্বীপ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ৭০ শতাংশ পূরণ করেছে ভারত। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন লিখেছে, ‘কেবল গত ১০ বছরে ভারত ১৪০০ এর বেশি মালদ্বীপ সেনাকে প্রশিক্ষিত করেছে। দেশটিতে মোট সেনা সদস্য মাত্র ৪০০০।’

মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব নিরাপত্তা স্বার্থ নিঃসন্দেহে জড়িত। সে জন্য ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের ফেরত পাঠানো নয়াদিল্লিকে রাগান্বিত করার জন্য যথেষ্ট। তবে মালদ্বীপের বিশ্লেষক বলছেন, এটি ভারতের চেয়ে মালদ্বীপকে ‘বেশি’ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত মুইজ্জু অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাণিজ্যের জন্য চীনের ওপর বেশি ঝুঁকে পড়ে মালদ্বীপকে ভারত থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে পারেন। কিন্তু চুক্তি বাতিল করা মালদ্বীপের জন্য কম খরচের ব্যাপার নয়। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান হঠাৎ একটি চুক্তি বাতিল করেন। তাঁর পূর্বসূরি মোহাম্মদ নাশিদ ভারতের জিএমআর গ্রুপের সঙ্গে মালে বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। পরে সিঙ্গাপুরের সালিশ নিষ্পত্তি আদালতের নির্দেশে মালদ্বীপকে ২৭১ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়; সে জন্য এটি মালদ্বীপের জন্য ছিল এক প্রকার আত্মঘাতী পদক্ষেপ।

ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত মালদ্বীপের নিকটবর্তী। ফলে মালদ্বীপের রাজনৈতিক, নিরাপত্তা এবং মানবিক সংকটের সময় ভারতই প্রথম এগিয়ে আসে। ভারতীয় সৈন্যরা ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে বিদেশি-ভাড়াটে-সমর্থিত অভ্যুত্থানচেষ্টা সফলভাবে প্রতিহত করে। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের সুনামি, ২০১৪ সালে পানির সংকট এবং কভিড-১৯ এর পরও ভারতীয় ত্রাণ কার্যক্রম সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মালদ্বীপই প্রথম ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ভারতের কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন পেয়েছিল। ব্যাপকসংখ্যক মালদ্বীপবাসী শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ভারতে আসে।

মুইজ্জুর ‘ইন্ডিয়া আউট’ বয়ানকে অনেকেই নিছক বাগাড়ম্বর হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিশ্লেষকরা যুক্তি দিয়েছিলেন, দেশ শাসনের প্রয়োজনীয়তা তাঁকে আরও নমনীয় করবে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি বিষয়টি নিয়ে তৎপর। তিনি শুধু বিজয়ের পরপর মালেতে ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের প্রত্যাহার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেননি; মন্ত্রী রিজিজুর সঙ্গে তাঁর বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবিটি উত্থাপনও করেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের বক্তব্যেও ভারতের নাম প্রকাশ না করেই তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেন।

বলাবাহুল্য, ভারতকে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় যুক্ত হওয়ার নীতিগত উপায়ে পরিবর্তন আনতে হবে। গোপনীয় চুক্তির মাধ্যমে স্বার্থ উদ্ধার সহজ হলেও সেগুলো বিরোধী দলগুলোর মোক্ষম নিশানা হতে পারে। তা ছাড়া ভারতকে প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক বিভাজন ছাপিয়ে সব দল এবং রাজনীতিবিদের সঙ্গে কাজ করতে শিখতে হবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা কূটনীতি থেকে ভারতের অনেক কিছুই শেখার আছে।

সমকাল