চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে যান চলাচল শুরু হয়েছে গত ২৯ অক্টোবর। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির দিনগুলো বাদে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার ৪৮টি যানবাহন টানেল পারাপার হয়েছে। আর চালুর পর ১৮ দিনের হিসাব ধরলে প্রতিদিন গড়ে টানেলটি ব্যবহার করেছে ৬ হাজার ৩১৮টি যানবাহন।
যদিও টানেলটি নির্মাণের জন্য করা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ২০২৫ সালে প্রতিদিন প্রায় ২৮ হাজার যান চলাচল করবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালকে টানেল চালুর বছর ধরে এ পূর্বাভাস করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, চালুর বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি চলতে পারে।
টানেল দিয়ে চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা পূর্বাভাসের চেয়ে কম হওয়ার পেছনে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিকে দায়ী করছেন সেতু কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলীরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাড়বে যান চলাচল। তবে সেতু কর্তৃপক্ষের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, টানেলের সঙ্গে পরিকল্পিত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়নি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত দুর্বল। আবার টানেলকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নও হয়নি। যতদিন এ কাজগুলো হচ্ছে না, ততদিন বৃহৎ এ প্রকল্পটির কার্যকর সুফল পাওয়া যাবে না বলে অভিমত তাদের।
টানেলটি নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয় ২০১৩ সালে। এতে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, ২০১৭ সালে চালুর প্রথম বছরে টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি যান চলাচল করবে। ২০২০ সালে তা প্রায় ২১ হাজার ও ২০২৫ সালে প্রতিদিন চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে ২০১৭ সালে টানেলটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও এটি উদ্বোধন হয়েছে চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, চালুর পরের ১৮ দিনে (২৯ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত) টানেলটি পারাপার হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭২১টি যানবাহন। ২৯ অক্টোবর চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করেছে ৩ নভেম্বর। ওইদিন পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৭৯৮টি। পরের দিন ৪ নভেম্বর চলাচল করে ১০ হাজার ৫৩৩টি যানবাহন। দুইদিনই ছিল শুক্র ও শনিবার—অর্থাৎ সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
একইভাবে পরের দুই শুক্র ও শনিবারে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৪৭৬ ও ৭ হাজার ৮১৭টি। অন্যদিকে ৭ ও ১৪ নভেম্বর যানবাহন চলেছে ৫ হাজার ৩২৭ ও ৪ হাজার ৩৩৭টি। এ দুইদিন দেশে হরতাল বা অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচি ছিল না। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে হরতাল-অবরোধ চলাকালীন ও স্বাভাবিক দিনের মধ্যে টানেল ব্যবহার করা যানবাহনের সংখ্যায় খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায়নি। যানবাহন যা বেশি চলেছে, তা শুক্র ও শনিবারের মতো ছুটির দিনে।
কর্ণফুলী টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত যেসব যানবাহন চলেছে তার একটি বড় অংশই পর্যটনকেন্দ্রিক। অর্থাৎ যারা টানেল ব্যবহার করেছেন, তাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিল টানেলটি ভ্রমণ করে দেখা। বিষয়টি উল্লেখ করে বর্তমানে চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা দিয়ে টানেলের কার্যকারিতা বোঝা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া। কর্ণফুলী টানেলসহ চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন এ প্রকৌশলী।
সুভাস বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টানেল দিয়ে যারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই ভিজিটর। কয়জন চাকরির কাজে গেছেন, কয়জন ইন্ডাস্ট্রিতে গেছেন? আমরা একটা টানেল করলাম কিন্তু সেখানে এখনো ইন্ডাস্ট্রি হয়নি। এর সুফল পেতে হলে পুরো আনোয়ারা এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে দরকার হবে পরিকল্পিত সড়ক নেটওয়ার্ক এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা, যার কোনোটিই এখনো গড়ে ওঠেনি।’
তিনি বলেন, ‘পতেঙ্গা টার্মিনাল দিয়ে বছরে সাড়ে চার লাখ একক কনটেইনার আসবে। এ টার্মিনালটি চালুর পর সেখানকার গাড়িগুলো কীভাবে যাতায়াত করবে, তার পরিকল্পনাও কিন্তু এখনো হয়নি। বন্দরকে যদি ইউটিলাইজড করতে হয়, বন্দরের গাড়ির ফার্স্ট প্রায়োরিটি হবে গতিশীলতা বাড়ানো। শুধু সাড়ে তিন কিলোমিটার টানেল দিয়ে তো গতিশীলতা বাড়ানো যাবে না। এখনো বে টার্মিনাল হয়নি, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়নি। এগুলো হলে চাপ আরো বাড়বে। কাজেই এখান থেকে যে ট্রাফিকটা জেনারেট হবে, সেই ব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত না হবে এবং সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠবে, ততদিন ১০ হাজার কোটি টাকার এ টানেলের সুফল মিলবে না।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ করা হয়েছে চীন সরকারের ঋণে। ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে চীনের ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড এরই মধ্যে শেষ হওয়ার কথা জানিয়েছেন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল) পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টানেলের এ ঋণ পরিশোধ করা হবে আদায় হওয়া টোলের টাকা দিয়ে।
যদিও বর্তমানে আদায় হওয়া টোলের টাকায় টানেল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের জন্য করা সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় টানেলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুই ধরনের ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘ডেইলি মেইনটেন্যান্স’। টানেলের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন সরবরাহসহ বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজের পেছনে বছরে ১৮ লাখ ডলার (২০১২ সালের হিসাবে) খরচ হবে। অন্যদিকে প্রতি পাঁচ বছরে একবার করা হবে ‘রেগুলার মেইনটেন্যান্স’। এজন্য প্রতি পাঁচ বছর পরপর আরো ১৯ লাখ ডলার খরচ করতে হবে।
রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক পরিচালন কাজে বছরে ব্যয় হবে ১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় নিয়ে এ পরিচালন ব্যয় প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
টানেলটিতে বর্তমানে পূর্বাভাসের চেয়ে কম যানবাহন চলাচল করলেও দ্রুতই ট্রাফিক বাড়তে শুরু করবে বলে মন্তব্য করেছেন হারুনুর রশীদ চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি কিছুটা অস্বাভাবিক। যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে অনেকেই গাড়ি বের করছেন না। মানুষ রাস্তায় কম বের হচ্ছেন। ফলে টানেলে যানবাহনের সংখ্যা কম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে।’
বনিক বার্তা