ডলারের সব উৎসে ভাটা

সমকাল : বিদেশি ঋণের ছাড়, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই, রপ্তানি কিংবা প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)– কোনো উৎস থেকেই নেই সুখবর। ডলারের সব উৎসে চলছে ভাটার টান। অন্যদিকে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হচ্ছে আগের চেয়ে ঢের। এ ঋণে সুদের হারও এখন বেশি। একে তো ডলার আসছে কম, আবার পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি। এ দ্বিমুখী পরিস্থিতি রিজার্ভ সংকটের চাপকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পদ্ধতিতে এ হিসাব করা হয়েছে।

বিদেশি ঋণের ছাড় কমেছে, বেড়েছে পরিশোধ

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, এ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলে পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধের পরিমাণ ৪ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।

 

গত দুই মাসে মূল ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এ সময় মূল ঋণ পরিশোধ করা হয় ২৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। আর শুধু সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার সুদ পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ কোটি ২৮ লাখ ডলার। অন্যদিকে, ঋণ এবং অনুদান মিলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ অর্থাৎ অর্থছাড় কমেছে ১১ শতাংশ। মাত্র ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে গত দুই মাসে।

গত অর্থবছরের এ দুই মাসে যার পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অর্থাৎ, একদিকে ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধের চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় কমেছে। ইআরডির প্রাক্কলন অনুযায়ী, এ অর্থবছরে ৩২৮ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ২৭৪ কোটি ডলার।

কেন উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থছাড় কমিয়ে দিচ্ছেন– জানতে চাইলে ইআরডির ফরেন এইড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট-ফাবার শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা সাধারণত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এডিপি বাস্তবায়ন ধীরগতিতে চলছে। এ কারণে অর্থছাড়ও কম হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, আগস্টে এডিপি বাস্তবায়ন গত বছরের আগস্টের চেয়ে পরিমাণ এবং হার দুটিতেই কমেছে। গত আগস্টে বাস্তবায়নের হার ছিল ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে মোট ৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা। গত বছরের একই মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধের দায় ক্রমেই বাড়বে। সমকালকে তিনি বলেন, নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার বেড়েছে অথচ রেয়াতকাল পরিশোধের সময়সীমা কমেছে। আবার এসব ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় দিয়ে। সেখানে গতি কম। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়ছে।

এফডিআই কমেছে ২৯ শতাংশ

বিদেশি মুদ্রার অন্যতম একটি উৎস বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বা এফডিআই। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে এফডিআই কমেছে ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মোট ৬২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে এ সময়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এফডিআইয়ের সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে সর্বশেষ এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিনিয়োগ ডেটা সব সময়ই ছয় মাস পিছিয়ে থাকে। মার্চ পর্যন্তই হালনাগাদ তথ্য রয়েছে। এফডিআই কেন কমছে– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগে সহায়ক নীতি বিবেচনা করে থাকেন। সামনে নির্বাচন। এর পর সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আসে কিনা, তা তাদের মাথায় রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণত বিনিয়োগ কমই হয়ে থাকে।

সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমেছে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা

বিদেশি মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি আয়। এ উৎস থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলার পাওয়া যায়। প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগের মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কম হয়েছে ৪৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ৪৩১ কোটি ডলার। আগস্টে এ পরিমাণ ছিল ৪৭৮ কোটি ডলার। রপ্তানি খাতের সবচেয়ে বড় পণ্য তৈরি পোশাক। সমজাতীয় পণ্যসহ মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশের মতো আসে এ খাত থেকে। রপ্তানি কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সমকালকে বলেন, এ সময়টাতে পোশাকের চাহিদা কম থাকে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে মৌসুম পরিবর্তন ঘিরে দীর্ঘকাল ধরেই এ রকম হয়ে আসছে। সারা বিশ্বেই রপ্তানি কমেছে এ সময়। সে তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি পরিস্থিতি বেশ ভালো।

নির্বাচন ও মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগের প্রভাবে রপ্তানি কমছে কিনা জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ক্রেতাদের মধ্যে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে সত্য, তবে ক্রেতাদের তারা আশ্বস্ত করছেন এসব কারণে সরবরাহ চেইনে প্রভাব পড়বে না।

রেমিট্যান্স কমেছে ১৩ শতাংশ

সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সে বড় পতন হয়েছে। এ মাসে মাত্র ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। গত ৪১ মাসের মধ্যে আর কোনো মাসে এত কম রেমিট্যান্স আসেনি। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার কম। অর্থাৎ রেমিট্যান্স কমেছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগের মাস আগস্টের চেয়ে কমেছে ১৬ শতাংশ। আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।