দুর্নীতি করে পালাচ্ছেন কর্মকর্তারা

রফিক রাফি
বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট
ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে আর কর্মস্থলে ফিরছেন না বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। কেউ কেউ লিয়েনে বিদেশে গিয়েও আর ফিরছেন না। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।
এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে বেবিচক। গত সোমবার পৃথক অফিস আদেশে বেবিচকের দুই কর্মকর্তা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুজ্জামান ও শাহজালালের সিনিয়র যোগাযোগ প্রকৌশলী মো. ইখতিয়ার ইসলামকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে দুর্নীতি করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় এসব কর্মকর্তা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, চাকরিবিধি ভঙ্গ, অনিয়মকারী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে সংস্থাটি। গত জুলাই মাস পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ১৮টি বিভাগীয় মামলা চলমান ছিল। জুলাই মাসে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আবার নতুন করে মামলা রুজুও হয়নি। এর মধ্যে ১৩টি মামলার সঙ্গে আদালতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফৌজদারি এই মামলাগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। বাকি ৫টি বিভাগীয় মামলার মধ্যে বেশিরভাগ জবাব দাখিল ও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।

অফিস আদেশে বলা হয়, মো. শহীদুজ্জামান, সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল), সদর দফতর প্রকৌশল বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ২১ দিনের ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র যান। কিন্তু ছুটি শেষে দেশে না আসায় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’-এর অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
মামলার তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) হিসেবে ডিমোশন দেওয়া হয় এবং আদেশের তারিখ পর্যন্ত অননুমোদিত ছুটিকে বিনা বেতনে অসাধারণ ছুটি হিসেবে মঞ্জুর করে বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করে তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু তারপরও তিনি কাজে যোগ না দিয়ে শারীরিক অসুস্থতার দুটি আবেদনপত্র ই-মেইলে বেবিচকে পাঠান। সেটা নাকচ করে তার বিরুদ্ধে আবারও বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’-এর অভিযোগ সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর বিধি ৪৯(গ) অনুযায়ী ‘পলায়ন’-এর দায়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

 

অন্য এক অফিস আদেশে বলা হয়, শাহজালালের সিনিয়র যোগাযোগ প্রকৌশলী মো. ইখতিয়ার ইসলাম গত ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের শর্ত সাপেক্ষে লিয়েনে কানাডা যান। লিয়েনের মেয়াদ গত ২০২২ সালের ১৩ মার্চ শেষ হয়। কিন্তু তিনি স্বপদে কাজে যোগদান না করে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, টরেন্টো, কানাডার মাধ্যমে দুই বছর লিয়েন বৃদ্ধির আবেদন করেন যা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অবিবেচিত হয়। তিনি অনুমতিসহ দেশ ত্যাগ করে বিনা অনুমতিতে অনুমোদিত সময়ের পর গত ২০২২ সালের ১৪ মার্চ থেকে বিদেশে অবস্থান করায় ও এতে কর্তৃপক্ষের কাজে বিঘ্ন ঘটায়, লিয়েন পুনর্বিবেচনা বিষয়ে তার আবেদন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলার তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর বিধি ৪৯(গ) অনুযায়ী ‘পলায়ন’-এর দায়ে সিনিয়র যোগাযোগ প্রকৌশলী মো. ইখতিয়ার ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করে বেবিচক। আবদুল খালেক তার স্ত্রীর বড় ভাইকে দেখতে দুই মাসের ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর কানাডায় যান। কিন্তু ছুটি শেষে তিনি দেশে ফেরেননি।
সূত্র জানায়, বেবিচকের এই প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে সরকারি ৭ হাজার ৮৩০টি পে-অর্ডার উদ্ধার হয়, যেগুলো তিনি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে রেখেছিলেন। ২০ ক্যাটাগরিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পে-অর্ডারগুলো। কিন্তু আবদুল খালেক বেবিচকের হিসাব শাখায় জমা না দিয়ে সেগুলো নিজের ড্রয়ারে রেখে দেন।
বেবিচকের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধেও বেবিচকের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত ১০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দুই মাসের ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১৪ জুন যুক্তরাজ্যে যান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) লাইব্রেরিয়ান তানিয়া আক্তার। এরপর আর ফেরেননি। দীর্ঘ ১৯ মাস চিঠি চালাচালির পর তাকেও বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া যশোর বিমানবন্দরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলমকেও খুঁজে পাচ্ছে না বেবিচক। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাঁচ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি (ক্যাজুয়াল লিভ) নিয়ে নিজ বাড়ি পাবনায় যান মাহবুব। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেবিচকের অনেকেই দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে বিদেশে সটকে পড়ছেন। বিদেশে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী চাকরিচ্যুতির শাস্তি ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংস্থাটি। এতে সংস্থাটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমানকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এর আগে তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে বেবিচকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সময়ের আলো/আরএস/