গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৬ মে ২০২১
গণতন্ত্র শব্দটি বিভাজন করলে এর সরল অর্থ দাঁড়ায় জনগণের ব্যবস্থা। সেই বহুল উচ্চারিত সংজ্ঞা ‘জনগণের মধ্যমে জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’। গণতন্ত্র মানবসভ্যতার সেই উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা যা হাজার হাজার বছর ধরে পরীক্ষিত হয়ে আজকের অবস্থানে উত্তীর্ণ হয়েছে। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতন্ত্র পৃথিবীর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। কারণ একজনের শাসন যত উত্তমই হোক- অংশীদারিত্বের আনন্দ ধারণ করে না। প্লেটো বলেন, ‘কালেকটিভ উইজডম ইজ মাচ মোর বেটার দেন দ্যাট অব এ ফিলোসফার কিং’। সম্মিলিত মেধা-মনন একজন দার্শনিক রাজার চেয়ে অনেক শ্রেয়। সে জন্য একজন বেনেভোলেন্ট ডিকটেটর বা মহৎ একনায়ক জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি যদি প্রতিদিন কোর্মা পোলাও কোফতা কাবাব খাওয়ান তা হলেও না। নিত্যদিন মিঠাই মণ্ডা রসগোল্লা খাওয়ালেও না। গাদ্দাফির লিবিয়া আজ বিভক্ত-বিপর্যস্ত। সুখে ছিল তারা। সুখে থাকতে ভূতে কিলেয়েছে তাদের। আর সেই ভূতের নাম গণতন্ত্র। এই দেশে গণতন্ত্রের আগে এরশাদতন্ত্র ছিল। বর্তমান সরকার দাবি করে গণতন্ত্রের স্বাদ তারা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। এখন মানুষ আওয়ামী গণতন্ত্রের স্বাদ আস্বাদন করে করে দোজখ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। অথচ বলার উপায় নেই। এই বলার উপায়টির নামই গণমাধ্যম।
মানুষ ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’। অথচ ‘সদা ভয় সদা লাজ’। ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একখানা কিতাব লিখেছেন। এটির নাম ‘চিলেকোঠার সেপাই’। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন তরতাজা যুবক নিজে নিজে বিড় বিড় করে। মুক্তিযুদ্ধের হাজারও ছবি আঁকে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে। তড়পায়। দাঁতে দাঁত ঠোকে। অবশেষে নিজকে প্রকাশ করতে না পেরে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। এখন এ সময়ে কত যুবকের এ অবস্থা, বলা কঠিন। এই প্রকাশ করার দুটো অর্থ যা করতে চায় তা করতে পারা এবং যা বলতে চায় তা বলতে পারা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে আমরা যেমন অবরুদ্ধ ছিলাম। তেমনই এখন আবার নতুন করে অবরুদ্ধ আছি। অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে। আমরা যে অবরুদ্ধ আছি তা বুঝবো কেমন করে? ছোটবেলার ছড়া : ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/ তুমি কতো কষ্ট পাও রোধ-বৃষ্টি-ঝড়ে।’ উন্নয়নের মহাসড়কে মহাসুখে আছি আমরা। আমাদের এতো সুখ আর সয় না। নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। নিজের অলক্ষ্যেই কষ্ট পাই রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম অবরুদ্ধ হলেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। তিনি অপমানিত লাঞ্ছিত হলেন। কারাবরণ করতে হলো তাকে। মামলা আর মুচলেকার সম্মুখীন হলেন। অবরুদ্ধ হয়ে বুঝলেন স্বাধীনতার স্বাদ। আমরা যে আছি মহাসুখে তা তিনি বুঝলেন। উন্নয়নের গণতন্ত্রের স্বাদ আস্বাদন করলেন তিনি। দেশবাসী দেখলো। অবশ্য মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল বললেন, ‘রোজিনার সঙ্গে আমাদের বিবেকও আজ বন্দিদশায়’। রাজনীতিবিদরা বলছেন, দেশ আজ এক খোলা বন্দিশালায় পরিণত হয়েছে। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির যদি ৩৫ লাখ লোক মামলা মোকদ্দমায় বন্দিদশায় থাকে; তা হলে সব মিলে কতো?
সেখানে গণমাধ্যম একটু খোলা জানালা। অথচ স্বাধীনতার দাবি ছিল ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’। স্বাধীনতার দাবি ছিল মানুষের অধিকার। স্বাধীনতার দাবি ছিল কথা বলার অধিকার। সংবাদপত্রের অধিকার। সমাবেশের অধিকার। আর এসবই গণতন্ত্রের শর্ত। সবটুকু মিলিয়েই তো স্বাধীনতা। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে তা অধীনতায় পরিণত হয়েছে। সাংবাদিক ও ছড়াকার আবু সালেহ প্রশ্ন করেন ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা?’ এখন ফৌজদারি আইন এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা সরকারবিরোধীদের শায়েস্তা করার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে সাথে সাংবাদিকরাও এ হাতিয়ারের শিকার হচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরে অত্যাচারের খড়গ কৃপাণে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। গুম হয়েছেন কেউ কেউ। প্রবীণ সম্পাদক আবুল আসাদ ঠুনকো অভিযোগে দীর্ঘ দিন কারাগারে ছিলেন। মাহমুদুর রহমান কারাগারে ছিলেন। অবশেষে এখন দেশান্তরি। আরো ৫০ জন সাংবাদিককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। সাংবাদিক নেতা রুহুল আমীন গাজীকে একরকম গায়ের জোরে আটকে রাখা হয়েছে। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত তার সুরাহা হয়নি। মুক্ত বুদ্ধিজীবী শহিদুল ইসলাম ও সাংবাদিক কাজলসহ অনেকে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের মনের আয়না। সংবাদপত্র টিভি চ্যানেল, রেডিও, ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলো গণমাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। স্বাধীনতার সুপ্রভাতে সংবিধানে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের গ্যারান্টি দেয়া হয়। সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে ৩৯ অনুচ্ছেদের ‘খ’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইলো।’ অথচ সময় যেতে না যেতেই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে তারা। ১৯৭৪ সালে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিনেন্স জারি করা হয়। ১৯৭৫ সালের বাকশালের আওতায় মাত্র চারটি সংবাদপত্র তাও আবার সরকারি মালিকানায় চালু রাখা হয়। এর আগে গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে জেলে পোরা হয়। ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে তারা বন্ধ করে দেয় দৈনিক বাংলা ও জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্র। দ্বিতীয় মেয়াদে আরো খড়গ হানে তারা। আমার দেশে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় দিগন্ত ও ইসলামী টিভি। আজকে এই মুহূর্তে তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮। অবশ্য রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার স্বীকৃতি পৃথিবীজুড়ে। গণমাধ্যকে বলা হয় সরকারের পাহারাদার। কোথায় কী ভুল বা সমস্যা হচ্ছে গণমাধ্যম তা সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ জন্য তাদের বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বা ফোর্থ স্টেট। গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের এ সাহসী ভূমিকার কারণে পৃথিবীর অনেক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির খবর জনসম্মুখে আসে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি, পেন্টাগন পেপার্স, বফোর্স কেলেঙ্কারি ইত্যাদি বড় বড় অপরাধের হদিস দেন সাংবাদিকরাই। বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকা লোপাটকারীদের ধরিয়ে দেন সাংবাদিকরাই। দুর্নীতির ইতি টানতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এই প্রথমবারের মতো রোজিনা ইসলামকে ঘিরে বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন অভিন্ন ভাষায় প্রতিবাদ করেছে। এর আগে সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাংবাদিক সমাজের মধ্যে এরকম ঐক্য গড়ে উঠেছিল। পরে সরকার পদ-পদবি ও হালুয়া-রুটি বিতরণ করে ওই ঐক্য বিনষ্ট করে দেয়। এখন বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র উদ্ধারের পূর্বশর্ত হচ্ছে সাংবাদিকদের ঐক্য। শেষ মুহূর্তে সাংবাদিকদের ঐক্য স্বৈরাচার এরশাদের পতন অনিবার্য করে তোলে। বিভিন্ন ধরন ও বৈশিষ্ট্যে বিভক্ত সংবাদমাধ্যমকে সত্যিকার গণমাধ্যম হয়ে উঠতে হলে সত্যের সাক্ষ্য দিতে হবে। লোকভয় জয় করতে হবে। ইস্পাতকঠিন ঐক্যে সুদৃঢ় থাকতে হবে। তবে এত হতাশার মাঝেও রোজিনা ইসলামকে ঘিরে যে সমীকরণ দেখা গেছে; তাতে আশার আলো দেখছেন দেশের সচেতন নাগরিকসমাজ। সবাই জানে ঐক্যেই গণতন্ত্রের মুক্তি। আর বিভক্তিতে অধীনতার চুক্তি।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]