জীবনের অনেক ‘ফাইন-টিউনিং’ আদালত দিয়ে করা সম্ভব না

জীবনের অনেক ‘ফাইন-টিউনিং’ আদালত দিয়ে করা সম্ভব না

কানাডার একটি আদালত এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাসহ তিন জন অভিযুক্তকে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন । টেলিফোনে আড়ি পেতে পাওয়া যেসব প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দাখিল করা হয়েছিল , আদালত সেগুলি নাকচ করে দিয়েছে । বিচারক তার রায়ে বলেছেন , প্রমাণ হিসেবে যেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো ‘অনুমানভিত্তিক, গাল-গল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়’।
বিষয়টি পুরো জাতির জন্যে অবশ্যি স্বস্তিকর বিষয় । কিন্তু সরকার ও সরকার বান্ধব মিডিয়া এই রায়টিকে ব্যবহার করে নিজেদের অন্য সকল পাপ ঢেকে ফেলতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে । বাঁধ ভাঙা উচ্ছাসের সামনে কিছু করুণ বাস্তবতা চাপা পড়ে যাচ্ছে ।
এখানে কয়েকটি বিষয় বিবেচ্য । বিশ্বব্যাংক একটি ব্যবসায়িক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান , কোন দাতব্য সংস্থা নহে । একজন ক্লায়েন্ট সম্পর্কে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রায় (পর্যবেক্ষণ বা মূল্যায়ন ) এবং আদালতের রায় এক নাও হতে পারে । যে কোন সভ্য আদালতে benefit of doubt সব সময় অভিযুক্তের পক্ষে যায় । কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজের ঝুকির কথা চিন্তা করে যে কোনও doubt কে address করে নিজের পক্ষে ব্যবহার করে ।
পুরো বিষয়টিকে এই এঙ্গেল থেকে দেখাই নিরাপদ । বিশ্বব্যাংক অনেকটা আড়ি পেতে যে প্রমাণগুলি দাখিল করেছে , আদালত তা গ্রহণ করে নাই ।
ঘুষ এমন একটা কর্ম যা কোন আদালত কর্তৃক ধরা যায় না , ছোয়া যায় না – শুধু মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় । আইনের দৃষ্টিতে এদেশে খুব বেশি ঘুষখোর নেই । অথচ বাস্তব অবস্থা তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ।

নিচের উদাহরণটি বিষয়টিকে আরেকটু খোলাসা করতে পারে ।
এক ভদ্র মহিলা তার স্বামীকে সন্দেহ করছিলেন । কিন্তু কোনদিন হাতে নাতে ধরতে পারছেন না । একদিন তিনি অসময়ে বাড়ি ফিরে আসেন । এসে দেখেন স্বামীধন বাসার কাজের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরেছেন । এমতাবস্থায় স্ত্রীকে দেখে হতভম্ব স্বামী বলেন ,বিশ্বাস করো , মেয়েটি তোমার পুরণো শাড়ী পরে থাকায় এই ভুলটি করে ফেলেছি ।
স্বামী ধনের এই খোঁড়া যুক্তি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি । তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে কোর্টে দাম্পত্য অবিশ্বস্ততার মামলা ঠুকে দেন । স্বামীর পক্ষের উকিল সেই স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন ,
কাজের মেয়েটি কি সেদিন আপনার পুরণো শাড়ী পরিধান করেছিল ?
বাদি : জী , তাই পরেছিল ।
উকিল : কাজেই আপনার স্বামী আপনাকে ভেবেই কাজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিল ।
বাদি : এটা ঠিক না । এটা ওর খোঁড়া যুক্তি ।
উকিল : আপনি যেভাবে এটাকে খোঁড়া যুক্তি বলছেন । আইন তা পারে না । আপনার স্বামীর অবিশ্বস্ততার আর কী কী প্রমাণ আপনার হাতে রয়েছে ?
বাদি: অনেকবার বিষয়টি টের পেলেও ওদেরকে হাতে নাতে ধরেছি শুধু মাত্র ঘটনার দিনটিতেই ।
উকিল : আপনি শুধু উক্ত মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছেন । আর কিছু দেখেন নি ।
বাদী: জী । আর কিছু দেখি নাই । তবে এটুকু থেকেই বাকি সম্পর্কটুকু আন্দাজ করা যায় ।
উকিল : ( বিচারককে উদ্দেশ্য করে ) এরূপ আন্দাজ ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না মহামান্য আদালত । ….

আদালতও এই উকিলের যুক্তি ফেলতে পারে নি । ঘটনা যাই হোক না কেন , আদালতের কাছে সাপোর্টিং ডকুমেন্টই আসল কথা ।
সবকিছু শোনে বিচারক benefit of doubt টি অভিযুক্তের পক্ষেই দিতে বাধ্য হয়েছেন । ফলে স্ত্রীর সন্দেহ অহেতুক ও অমূলক বলে আদালতের কাছে প্রতিপন্ন হয়েছে ।

এই ভাবে আদালতের রায়ে নির্দোষ হিসাবে ঘোষিত মানুষটি স্ত্রীর কাছে বিশ্বস্ত স্বামী নাও হতে পারে । আদালত অনেক সময় এরূপ মোটা দাগেই সিদ্ধান্ত দেয় । তারপর প্রতারিত পার্টনার বা বন্চিত জনতাকে ফাইন -টিউনিংটি নিজেদেরই প্রয়োজনে করে নিতে হয় । জীবনের অনেক ফাইন টিউনিং আদালতের রায় দিয়ে সম্ভব হয় না ।

আদালতের রায়ের উপর ভিত্তি করে কোনও পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয় না । এই ফাইন -টিউনিংএ সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি ব্যবহৃত হয় তাহলো জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি । জনগণের মনের এই কোণটিতে কোনও আদালত প্রবেশ করতে পারে না ।
কানাডার আদালতের রায়ের পরেও জনগণ এই ফাইন টিউনিংটি ঠিক ঠিক ভাবে করতে পারবে বলেই মনে হয় ।