৫ই মে: নীরবেই কেটে গেল ইতিহাসের রক্তাক্ত এক গণহত্যার দিন

 আমার দেশ
৫ মে ২০২৩

 নীরবেই কাটছে ৫ মে গণহত্যা দিবস

নীরবেই কাটছে ৫ মে গণহত্যা দিবস

নিজস্ব প্রতিনিধি

আজ ৫ই মে। বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তাক্ত এক গণহত্যার দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সহায় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি (সাবেক বিডিআর) যৌথভাবে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে। মধ্যরাতের অন্ধকারে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন দিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমন্ত এবং জিকিররত জনতার উপর অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সহায়ক পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি। তাদের সাথে অস্ত্র হাতে যোগ দিয়েছিল সন্ত্রাসী আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা। মধ্যরাতে ইতিহাসের জঘন্যতম এক গণহত্যায় মেতে উঠেছিল তারা। সেই রাতে গুলিতে কত মানুষ নিহত হয়েছিলেন তার কোন হিসাব এখনো নেই। একদিন হয়ত এর প্রকৃত তদন্ত হবে। বের হবে নিহতের পরিচয়। বিচার হবে গণহত্যার সাথে জড়িতদের।

বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহন ছিল ৫ মে’র সমাবেশে। লাখো মানুষ ছুটে এসেছিল নিজ নিজ দায়িত্বে। লক্ষ্য ছিল দেশবিরোধী চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করা। দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী এবং সাধারণ মানুষের লালিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শাহবাগে গড়ে উঠেছিল কথিত জনতার মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকেই ফ্যাসিবাদী শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধের দাবীতে ফ্যাসিবাদীরা শাহবাগ থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত লাঠিমিছিলও করেছিল। ধর্মপ্রাণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে ৫ মে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছিল ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গড়ে উঠ কথিত জনতার মঞ্চ। জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিরোধী এ মঞ্চ থেকেই দেশের ৯০শতাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নানা শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল।

ভারতপন্থী আওয়ামী গণমাধ্যম গুলো কথিত এই জনতার মঞ্চের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এক অসুস্থ প্রচারণায় মেতে উঠেছিল। একদিকে ভারতপন্থী পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল গুলো কথিত জনতার মঞ্চের পক্ষে অসুস্থ প্রচারণা চালিয়েছিল। অপরদিকে আমার দেশ তাদের মুখোশ উন্মোচন করেছিল। এতেই ভারতপন্থীদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। আমার দেশ বন্ধের দাবী উঠানোর জন্য ভারতপন্থী গণমাধ্যম গুলো উস্কে দিয়েছিল শাহবাগের কথিত জনতার মঞ্চকে।

৫ মে রাতের নৃশংস হামলায় যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তাদেরকেও পরবর্তীতে পুলিশি জুলুমের শিকার হতে হয়েছিল। পুলিশ-র‌্যাব -বিজিবি’র সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর হামলায় আহতদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন অনেককে গ্রেফতার করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন মহাসচিব আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সমাবেশ থেকেই। রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল তাঁকে। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি।

কী ঘটেছিল সেদিন?

১৩ দফা দাবীতে হেফজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি ছিল ৫ মে (২০১৩)। পূর্বঘোষিত এই কর্মসূচি সফল করতে সকাল থেকেই ঢাকা প্রবেশের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হয়েছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখো জনতা। সরকার সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ করে দিয়েও ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোর নির্ধারিত পয়েন্টে মানুষের ঢল ঠেকাতে পারেনি। ঢাকা ঘেরাও সফল করে বিকালে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে জনতা রওয়ানা দেয় মতিঝিলের শাপলা চত্বরের দিকে। সায়দাবাদ, গাবতলি, মহাখালী, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকায় প্রবেশের পয়েন্ট থেকে পায়ে হেঁটে মতিঝিলে আসেন জনতা। চারদিক থেকে আসা মানুষের ঢলে বিকালে পুরো ঢাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার আগেই শাপলা চত্বরের চারপাশের রাস্তা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। মানুষের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার। এতে শেখ হাসিনার অনুগত রাষ্ট্রীয় খুনিরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে গুপ্তহত্যার ছক তৈরি করে।

 

৫ই মে শাপলাচত্ত্বরে সশস্ত্রবাহিনীর হামলার কিছু চিত্র

 

হেফাজতের আমিরকে সমাবেশে আসতে বাধা:

হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমীর মরহুম আল্লামা আহমদ শফির সমাবেশে এসে দোয়া করে পরবর্তী কর্মসূচি দেয়ার কথা ছিল। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসায় এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর প্রতিবন্ধকতার কারণে সমাবেশস্থলে আসতে পারছিলেন না। শাপলা চত্বরের দিকে রওয়ানা দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁকে লালবাগ মাদ্রাসা গেটেই আটকে দেয়। তখন সমাবেশে ঘোষণা দেওয়া হয় তাদের আমীর না আসা পর্যন্ত শাপলা চত্বর থেকে যেন কেউ না যায়। সিদ্ধান্ত হয় রাতে তারা সমাবেশস্থলেই অবস্থান করবেন।

যৌথবাহিনীর সশস্ত্র হামলা:

রাত বাড়তে থাকলে সারা দিনের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে ক্লান্ত জনতার অনেকেই রাজপথে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ জিকির করতে থাকেন। এমতাবস্থায় মতিঝিল ও আশে-পাশের এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিস্ট সরকার। এতে পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গভীর রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকা অন্ধকারে যৌথবাহিনী এবং আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগুতে থাকে সমাবেশের দিকে। নির্বিচার গুলিতে অসংখ্য মানুষ নিহত এবং আহত হতে থাকেন। সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট আওয়াজে যুদ্ধাবস্থার মতো পরিবেশ তৈরি হয়। ঘুমিয়ে এবং জিকিরে থাকা নিরস্ত্র হেফাজত কর্মীরা তখন দিশাহীন অবস্থায় ছোটাছুটি শুরু করেন। রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলিতে কতজন আহত এবং কতজন নিহত হয়েছিলেন তা দেখা ও খোঁজ নেওয়ার সুযোগ কারো ছিল না ওই সময়। এতে রাত পোহাবার আগেই সরকারি লোকজন রাস্তা ধুয়ে-মুছে রক্ত পরিষ্কার করে ফেলার সুযোগ পায়।

হেফাজতের ভয়ে কম্পিত ছিলো ফ্যাসিস্ট হাসিনা:

টানা ৩ মাসের বেশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে ভারতীয় মদদে ইসলাম বিদ্বেষী গণজাগরণ মঞ্চ চালানো হয়েছিল ওই সময়। শাহবাগের পিজি হাসপাতালের মরণাপন্ন রোগীদের জরুরী যাতায়াতের পথ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহের জন্য পিজি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে শেখ হাসিনা দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অথচ, হেফাজতে ইসলামের এক রাতের অবস্থান সহ্য করতে পারেনি তার সরকার। রাতের আঁধারে গণহত্যা চালিয়ে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিকে পণ্ড করে দেওয়া হয়। এই হত্যাকাণ্ডে প্রধান দায়িত্ব পালন করেন বিডিআর-এর তৎকালীন ডিজি এবং পরবর্তীতে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, ডিএমপি’র তৎকালীন কমিশনার এবং পরবর্তীতে আইজি বেনজির আহমেদ এবং র‍্যাবের তৎকালীন অপারেশনস প্রধান ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান।

টানা তিন মাস বেসরকারি টেলিভিশনগুলো শাহবাগের গণজাগরণের ফাঁসি চাই শ্লোগান লাইভে প্রচারের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যার উস্কানি দেওয়া অব্যাহত রাখলেও হেফাজতের এক রাতের সমাবেশ লাইভ প্রচার সহ্য হয়নি সরকারের। সে রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন চ্যানেল। এর আগেই ১১ এপ্রিল বন্ধ করে দিয়েছিল আমার দেশ পত্রিকা। গ্রেফতার করা হয়েছিল সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে।

নীরবেই কাটছে ৫ মে গণহত্যা দিবস:

এই দিনটিকে স্মরণে রেখে পরবর্তী কয়েক বছর ৫ মে সভা সমাবেশের মাধ্যমে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবী উঠেছিল। কিন্তু সরকারি চাপ, গুম-ক্রসফায়ার এবং অন্যান্য চক্রান্ত হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বকে এ বিষয়ে নীরব করে দিতে সক্ষম হয়। এই নীরবতা বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের সফলতা মনে হলেও দেশের সাধারণ মানুষ গণহত্যার কথা ভুলে নাই। এই গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবী অব্যাহত আছে মানুষের মাঝে। বিচারও একদিন হবে বাংলাদেশের মাটিতে। আমার দেশ মানবতা বিরোধী এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে মানুষের পাশে ছিল এবং আছে সব সময়।

৫ মে রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় দিগন্ত এবং ইসলামি টেলিভিশন। এই দুইটি চ্যানেল শাপলা চত্ত্বরের সমাবেশ সরাসরি লাইভে প্রচার করেছিল। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত ও আল্লাহর জিকিররত মানুষদের উপর অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনেক দৃশ্য ধারণ করা ছিল এই দুইটি টেলিভিশন চ্যানেলে। কিন্তু মধ্যরাতে অকস্মাৎ অভিযান চালিয়ে চ্যানেল দু’টির প্রচারণা বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিবাদী সরকার। যাতে মানুষ গণহত্যার চিত্র দেখতে না পারে সেজন্যই মূলত এই দু’টি চ্যানেলকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেই রাতে। বলা হয়েছিল তদন্তের পর এই দু’টি চ্যানেল আবার খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু গত ১০ বছরেও তাদের তদন্ত আর শেষ হয়নি।