৪ বছরের ছুটি নিয়ে স্বামীর কাছে যাচ্ছেন সেই ইউএনও

jugantor

 আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল 
 ০৫ জুলাই ২০২৩
ইউএনও নুসরাত
ইউএনও নুসরাত ফাতিমা

মাত্র ১১ মাসের দায়িত্ব পালনকালে নানা অঘটনের জন্ম দেওয়া বরিশালের বাবুগঞ্জের ইউনএনও নুসরাত ফাতিমা এবার যাচ্ছেন আমেরিকায়। ৪ বছরের শিক্ষা ছুটি পেয়েছেন তিনি। স্বামীও রয়েছেন সেখানে।

মধ্যরাতে বাবুগঞ্জ ছাড়েন বিতর্কিত এই ইউএনও। ঈদের আগের রাতে অনেকটা গোপনে ঢাকায় চলে যান তিনি। আমেরিকায় যাবেন স্বীকার করলেও কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না করার দাবি এই সরকারি কর্মকর্তার। বিধি মেনে কাজ করতে গিয়ে কিছু মানুষের বিরাগভাজন হওয়ায় এসব অপপ্রচার বলে পালটা অভিযোগ তার।

গত বছরের ২৭ আগস্ট বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে যোগদান করেন নুসরাত ফাতিমা। যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে উঠতে শুরু করে ক্ষমতার অপব্যবহার আর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। একের পর এক অঘটনে বারবার শিরোনাম হন গণমাধ্যমে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মুরাল সংস্কারের টাকা দিয়ে বাথরুম আধুনিকায়নের ঘটনা।

গত বছরের শেষদিকে উপজেলা পরিষদের এক সভায় প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি বিল উত্থাপন করেন তিনি। সেখানে বঙ্গবন্ধুর মুরাল সংস্কার বাবদ দেখানো হয় ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭১২ টাকা ব্যয়। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জনপ্রতিনিধিরা। অভিযোগ উঠে মুরাল সংস্কারের টাকা দিয়ে ইউএনওর বাসভবনের বাথরুম সংস্কারের। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেন। একাধিক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘উত্থাপিত বিলে মুরাল সংস্কার খাতে যে ব্যয় দেখানো হয়, তার প্রায় কিছুই করা হয়নি। বরং ওই টাকা খরচ করা হয় ইউএনওর বাথরুম ও বাসভবন সংস্কারে। বাথটাব টাইলস উঠিয়ে লাগানো হয় নতুন করে। বাসভবনে থাকা পুরোনো এসএস খুলে লাগানো হয় মুরালে। বাসভবনে লাগানো হয় স্বর্ণালি রঙের নতুন এসএস। প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মুরাল সংস্কারে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়নি। হইচইয়ের একপর্যায়ে ফেরত যায় বিল।’

উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফারজানা ওহাব বলেন, ‘ইউএনও নুসরাত যোগদানের মাত্র কিছুদিন আগে পূর্ববর্তী ইউএনও ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবনটির সংস্কার করেন। এরপরও আবার কেন এর সংস্কার করতে হবে? পরিষদের কোনো পূর্বানুমোদন ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই টাকা খরচ করেন ইউএনও। জাতির পিতার মুরাল নিয়ে এই দুর্নীতির প্রতিবাদ জানিয়েছি।’ উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী দুলাল বলেন, ‘অসংগতি পাওয়ায় মুরাল সংস্কারের বিল পরিশোধ করিনি আমরা।’ অভিযোগ অবশ্য স্বীকার করেননি নুসরাত। যথাযথ ব্যয় করে বিল উত্থাপন হয়েছে বলেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান, স্ত্রীকে মারধর আর দুই ছেলেকে গ্রেফতার করেও ক্ষমতার অপব্যবহার দেখান ইউএনও নুসরাত। ২৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ তোলেন বাবুগঞ্জের আরজি কালিকাপুর এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম ওরফে ছত্তার। ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিরোধিতার জেরে এক ইউপি সদস্যের কথা শুনে তার জমিতে ড্রেনের কাজ শুরু করান ইউএনও। প্রতিবাদ জানালে ব্যক্তিগত আনসার দিয়ে ছত্তার ও তার পরিবারকে করেন হেনস্তা। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার বৃদ্ধ স্ত্রীকে মারতে তেড়ে যাচ্ছেন নুসরাত। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কেবল মারধরই নয়, মুক্তিযোদ্ধার দুই ছেলেকে আটক করেন তিনি। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের অপপ্রয়োগও করা হয়। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ইউএনও বলেন, ‘ড্রেনের কাজ চলার সময় শ্রমিকদের ওপর হামলা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল ছত্তারের লোকজন। নিরাপত্তার স্বার্থে আনসার বাহিনীকে ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া যেখানে কাজ চলছিল, সেটা সরকারি জমি।’ মুক্তিযোদ্ধা ছত্তার বলেন, ‘ঘটনার পর মামলা করি আমি। আদালতের নির্দেশে কাজ বন্ধ রয়েছে।’

জাটকা নিধন প্রতিরোধ অভিযানে ব্যবহৃত ট্রলারে আগুন দিয়েও সমালোচিত হন নুসরাত। গত বছরের ১৩ অক্টোবর সুগন্ধা নদী তীরে ঘটে এ ঘটনা। ওইদিন আনোয়ার মাঝির ট্রলার নিয়ে অভিযানে যান নুসরাত। ফেরার পর জব্দ করা মাছের পরিমাণ কম মনে হওয়ায় সন্দেহ করেন আনোয়ারকে। ইউএনওর অগ্নিমূর্তি দেখে পালিয়ে যান তিনি। পরে তার নির্দেশে ট্রলারটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন আনসার সদস্যরা। ইউএনওর নির্দেশে ট্রলারে আগুন দেওয়ার এই ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফায়ার সার্ভিসের উপজেলা ইনচার্জ আব্দুল মালেক বলেন, ‘খবর পেয়ে গেলেও আগুন নেভাতে বাধা দেন ইউএনও। মামলার আলামত পোড়ানো হচ্ছে বলেন তিনি।’ জেলা প্রশাসনের তদন্তে অবশ্য ঘটনার সত্যতা মেলেনি। আনোয়ার বলেন, ‘ভয় দেখিয়ে আমাকে বলতে বাধ্য করা হয় দুর্ঘটনার কথা। নতুন ট্রলার দেওয়ার কথা বললেও দেননি। বহুদিন ধরনা দিয়েছি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিলন মৃধার কাছে। ইউএনওকে বাঁচানোর জন্য তিনিই বিষয়টির মধ্যস্থতা করেছিলেন।’ একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ধরেননি মিলন মৃধা। সদ্যবিদায়ি ইউএনওর ভাষায় ঘটনাটি ছিল দুর্ঘটনা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের এক কর্মচারীসহ দুজনকে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখার ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন এই ইউএনও। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে দুর্নীতির খবর পেয়ে পরিদর্শনে যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। খবর পেয়ে নিম্নমানের ইট সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন নুসরাত। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বরের ওই ঘটনায় ইট সরাতে ব্যর্থ হওয়ায় পিআইও অফিসের কর্মচারী বাশার ও মনিরের ইটভাটার ম্যানেজারকে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন ইউএনও। ঘণ্টাখানেক এভাবে বেঁধে রাখার পর স্থানীয়দের অনুরোধে খুলে দেওয়া হয় দড়ি। এ সংক্রান্ত ছবি-ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অবশ্য এর আগেই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসে দেখে যান সব। ওই ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, ‘ভুলে নিম্নমানের ইট পাঠানো হয়েছিল। সরিয়ে নিতে বললেও তা না সরানোয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’

সবশেষ বাবুগঞ্জের উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামকে ব্যাংকের কক্ষে আটকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে খবরের শিরোনাম হন নুসরাত। ২৫ জুন সোনালী ব্যাংক খানপুরা শাখায় ঘটে এ ঘটনা। শহিদুল ইসলামের অভিযোগ, ‘এডিপি প্রকল্পের প্রায় ২ কোটি টাকার বরাদ্দ আসে কয়েকদিন আগে। সেই টাকা যৌথ অ্যাকাউন্ট করে নেওয়ার উদ্যোগ নেন ইউএনও-উপজেলা চেয়ারম্যান। প্রতিবাদ জানালে আমাকে ব্যাংকের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। আনসার সদস্য দিয়ে অপমান করানোর পাশাপাশি দেওয়া হয় গ্রেফতারের হুমকি। পরে চাপ সৃষ্টি করে সই নেওয়া হয় চেকে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।’ অভিযোগ অস্বীকার করে নুসরাত বলেন, ‘জুন ফাইনালের বিল নিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী-উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছিল। খবর পেয়ে ব্যাংকে গিয়ে সেটা মিটিয়ে দিই। গ্রেফতারের নির্দেশ দিইনি।’ যদিও ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে শোনা যায় শহিদুলকে গ্রেফতার করতে বলছেন ইউএনও।

এ ঘটনার পর গত ২৮ জুন গভীর রাতে বাবুগঞ্জ ত্যাগ করেন নুসরাত ফাতিমা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাবুগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কয়েকদিন আগেই বাবুগঞ্জ ছাড়ার নির্দেশ পান তিনি। এরপরও থেকে যান। এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে লবিং-তদবিরও করেন। আসলে তিনি জুন পাড় করে যেতে চাইছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তার যাওয়াটা সুখকর হয়নি। ইউএনও হিসাবে কোনো রকম বিদায় সংবর্ধনা ছাড়াই যেতে হলো তাকে। নুসরাত ফাতিমা বলেন, ‘৪ বছরের শিক্ষা ছুটি পেয়েছি। পিএইচডি করতে আমেরিকা যাব। ১৮ জুন ছুটি অনুমোদন হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই ফ্লাইট ধরব।’ আপনার স্বামীও তো আমেরিকায় থেকে পিএইচডি করছেন জিজ্ঞাসা করলে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেন তিনি। হঠাৎ বাবুগঞ্জ ছেড়ে আসা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ তো নয়, সহকর্মী সবাই জানে। তাছাড়া আমি তো আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।’