বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত কিছু জরিপের ফল আমাদের সবার মনোযোগ দাবি করে এ কারণে যে এই জরিপগুলো বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি এবং শিক্ষার এমন চিত্র তুলে ধরে, যা উদ্বেগজনক।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য বিষয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন এবং সংশয় সব সময়ই আছে; অতীতে দেশের অর্থনীতি নিয়ে, বিশেষত প্রবৃদ্ধি বিষয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা প্রশ্ন তুলেছেন। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত এই জরিপগুলোতে বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনযাপনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে।
যেকোনো জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অবস্থার বর্ণনা দেয়, কিন্তু তার কারণ নির্দেশ করে না। কারণ অনুসন্ধানের জন্য দরকার এগুলোকে একত্রে পাঠ করা, বিশ্লেষণ করা। একই সঙ্গে অন্যান্য সূত্রে যে তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করা।
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১৭ কোটি ১৫ লাখ। এই জনসংখ্যার মধ্যে কারা শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছে এবং করছে না, তা জানা যায়।
এতে জানা যাচ্ছে যে তরুণদের প্রায় ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ পড়ালেখা বা কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁদের বয়স হচ্ছে ১৫ থেকে ২৪ বছর। বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমে এই তথ্য জানিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়েছে, ‘অলস সময় পার করছেন ৩৯ শতাংশ তরুণ’। এই শিরোনাম এমন ধারণা দেয়, তরুণেরা যেন স্বেচ্ছায় কোনো রকমের কাজে যুক্ত হতে আগ্রহী নন।
এ তথ্যের আড়ালে যা সুস্পষ্ট, তা হচ্ছে বাংলাদেশে নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ মানুষ এ অবস্থায় আছেন। সরকার সম্ভবত এ বিষয়ে আত্মতৃপ্তি বোধ করতে পারে যে ২০২২ সালের তুলনায় এই হার সামান্য হলেও হ্রাস পেয়েছে—২০২২ সালে এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে এই তরুণ জনগোষ্ঠী তাহলে কীভাবে টিকে আছেন। একটি দেশের তরুণদের এক বড় অংশই অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না কেন?
বয়সের বিবেচনায় তরুণদের হওয়ার কথা অর্থনীতির চালিকা শক্তি, জনসংখ্যায় তরুণদের আধিক্যকে অর্থনীতিবিদেরা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলে বর্ণনা করেন। বাংলাদেশের প্রায় ৫০ শতাংশই তরুণ, কিন্তু সেই তরুণদের মধ্যে যখন ৩৯ শতাংশকেই ‘অলস’ থাকতে হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে এই কথিত ‘ডিভিডেন্ড’ বা লাভ পাওয়ার পথই রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রাসঙ্গিকভাবে যে প্রশ্ন ওঠে, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার কত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৩ সালের শেষে যে শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা যায়, অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ। আগের বছরের চেয়ে এই সংখ্যা বেড়েছিল ৪০ হাজার। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বেকারত্বের হার হচ্ছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে, কেননা বেকারত্বের যে সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার বাড়ছে না।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিরা দেশের বাইরে প্রবাসে যান। ফলে দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা ২৪-২৮ লাখের মধ্যে আছে। এই স্থিতাবস্থা প্রমাণ করে, দেশের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তার সুবিধা নতুন চাকরিপ্রার্থীরা পাচ্ছেন না।
এতে তরুণদের এক বড় অংশই দেশত্যাগের কথা বিবেচনা করছেন। সেটাই জানা গিয়েছিল ২০২৩ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের করা জরিপে। দেশের শিক্ষিত তরুণদের ৪২ শতাংশ বিদেশ পাড়ি জমানোর কথা বলেছিলেন (বণিক বার্তা, ১৭ নভেম্বর ২০২৩)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ জানিয়েছিল, বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের (স্নাতক পাস) সংখ্যা ছিল প্রায় আট লাখ—মোট ১২ শতাংশ। সম্প্রতি করা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএসের) এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করার তিন বছর পরও ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার (প্রথম আলো, ২৪ মার্চ ২০২৪)। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করাদের অবস্থা এর চেয়ে ভালো কিছু নয়।
কিন্তু শিক্ষিত তরুণেরাই কেবল নাগরিক নয়, যাঁরা স্বল্প শিক্ষিত বা শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত, তাঁরা কী করছেন? তাঁদের একাংশ বৈধ উপায়ে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন। আরেক অংশ যাচ্ছেন অবৈধ পথে। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায়ই নিহত হন, তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
১ মার্চ রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৩৩২ জন; আগের বছর আবেদন করেছিলেন ৩৩ হাজার ৭৩১ জন (প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০২৪)
শিক্ষিত তরুণদের মধ্যকার এই বেকারত্বের বিষয় থেকে বোঝা যায় যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তরুণদের অর্থনীতিতে যুক্ত করতে পারছে না। কেননা সেই সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। এর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে যাচ্ছে প্রায় ৪১ শতাংশ জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স ৫ থেকে ২৪। এই হার গত বছরের তুলনায় সামান্য কম কিন্তু ২০১৯ সালের তুলনায় অনেক বেশি। সেই সময় মাত্র ২৯ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ছিল; ২০২০ সালে ২৮ শতাংশ (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০২৪)।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা শিশু-কিশোর-তরুণদের হার বৃদ্ধি, তরুণদের কথিত ‘অলস’ থাকা, শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের অভাব, অবৈধ পথে বাংলাদেশিদের দেশত্যাগের ঘটনাগুলোর বিষয়ে আমরা তথ্য পাই বিচ্ছিন্নভাবে কিন্তু এগুলো বাংলাদেশের বিরাজমান অবস্থার ছবি তুলে ধরে।
এই বিরাজমান অবস্থা বলছে যে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমন শিক্ষা দিতে সক্ষম হচ্ছে না, যা শিক্ষার্থীদের অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি যেটা বোঝা যাচ্ছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতি অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা তৈরি করছে না, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে না।
দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতির প্রধান দিক হয়ে উঠেছে প্রবৃদ্ধি; জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই লক্ষ্য যে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুইয়ের জন্যই একটা বড় রকমের বিপদ ডেকে আনছে—তার বহুবিধ প্রমাণ সহজেই দেখা যায়। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি।
আয় ও ভোগের ক্ষেত্রে ২০১৬ এবং ২০২২-এর পার্থক্য দেখায় যে আয়বৈষম্য ২০১৬ সালে ছিল ০.৪৮২, ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ০.৪৯৯। ভোগবৈষম্য বেড়ে ২০১৬ সালে ছিল ০.৩২৪, ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ০.৩৩৪। প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করছে, যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণ পরিশোধের দায় যাদের ওপরে পড়বে, তার একটি বড় অংশই হচ্ছে এখন যারা শিশু-কিশোর-তরুণ।
শিশু-কিশোরদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান, তরুণদের যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তোলা, তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা—এই সব বিষয়ে কোনো রকমের উদ্বেগ না থাকা, কার্যকর পরিকল্পনার অনুপস্থিতি দেশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হয় উদাসীনতার প্রমাণ নতুবা এই অবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ। অনুসৃত নীতিমালা যে কেবল ভবিষ্যৎ নাগরিকদের অপ্রস্তুত ও প্রশিক্ষণহীন করে রাখছে তা-ই নয়, এতে করে ভবিষ্যতে কর্মশক্তির জন্য পরনির্ভরতার পথও উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।
এসব নীতি আকাশ থেকে পড়ছে না, এগুলো তৈরি করা হয়েছে এবং করা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ফলে এসব পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করলেই হবে না, এটাও বোঝা দরকার কেন এবং কীভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
prothom alo