২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে গেল

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২১ আগস্ট ২০২২, ২২:০৯
বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ – ছবি : বিবিসি

ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে যখন গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয় তখন মঞ্চের কাছেই ছিলেন নাসিমা ফেরদৌস। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের সময়ে গুরুতর আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি।

ওই সময়ের ঘটনা মনে করে তিনি বলেন, ‘দেখলাম মানুষ পাখির মতো শুয়ে পড়লো। পড়ে গেলো। আমার পায়ের শক্তি নাই যে উঠে দাঁড়াবো। দ্বিতীয় শব্দ হলো, তখন মনে হলো পেটের মধ্যে কিছু ঢুকে গেলো। পেটিকোটের ফিতা ছিঁড়ে গেলো। পাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে চলে যাচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। লাশ আর লাশ।’

এ ঘটনার জন্য তিনি তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারকে দায়ী করেন।

ওই ঘটনায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন, আর আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির বহু নেতা-কর্মী। শুরু থেকেই এ হামলার জন্য তখনকার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারকেই দায়ী করে আসছিলেন শেখ হাসিনা।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এ ক্ষোভ নাসিমা ফেরদৌসের একার নয়। বরং শেখ হাসিনা নিজেও বহুবার এটি বলেছেন এবং তার দলের প্রতিটি স্তরের নেতা-কর্মীই তা বিশ্বাস করেন।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে তারা এটা করেছে। আদালতের রায়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। এতগুলো ন্যক্কারজনক ঘটনার পরে কিন্তু বিএনপি নেত্রীর ছোটো ছেলে যখন মারা যান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ করে তারা রাজনীতির যে দেয়াল তারা তৈরি করেছিলেন, সেটি আরো পোক্ত করেছিল। যারা প্রতিপক্ষকে খুন করে নিশ্চিহ্ন করতে চায় তাদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে আত্মঘাতী।’

অর্থাৎ ২১ অগাস্টের ঘটনার জন্য কোনোভাবেই বিএনপিকে মেনে নিতে রাজী নয় আওয়ামী লীগের নেতারা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও।

যদিও ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের অনেকে এই হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে পাল্টা দায়ী করে যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন সেগুলোও দল দুটোর মধ্যে বৈরিতা বাড়িয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের ক্ষতি করেছিল বলেও অনেকে মনে করেন।

এমনকি বিএনপির আমলে এ ঘটনায় করা মামলা নিয়েও নানা নাটকীয়তা গণমাধ্যমে এসেছিল। তবে আওয়ামী লীগের সময় ২০১৮ সালে মামলার যে রায় হয়েছে তাকেও প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ করেছিল বিএনপি।

ওই মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভার সদস্য লুৎফুজ্জমান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়াও আরো ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থ দণ্ড দেয়া হয়।

তবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তারা এখনো মনে করেন ২১ অগাস্টের ঘটনা রাজনৈতিক বিষয়ই নয় এবং এ ঘটনাকে ব্যক্তিগতভাবে নেয়ারও সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, ‘২১ অগাস্টের ঘটনা নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। কিন্তু এটি অরাজনৈতিক। সবার নিন্দা করা উচিত। এটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধের ঘটনা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যত শক্তিশালী হবে তত এগুলো কমবে। অথচ অনেকেই এসব ঘটনাকে ভিত্তি করে গণতন্ত্রকে আরো দুর্বল করছে।’

বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, সরকার বিএনপির প্রতি যে আচরণ করছে তার কারণই হলো ২১ অগাস্ট। এমনকি তাদের মতে, বিএনপির প্রতি সরকারের কঠোরতার যে অভিযোগ বিএনপি করে থাকে তার মূল কারণও এটি।

যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন, ১৫ অগাস্টসহ নানা ঘটনার কারণে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার বৈরিতা পুরনো। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, দুটি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক যে সম্পর্ক আগে ছিল, সেটিকেও কঠিন করে তুলেছে ২১ অগাস্ট।

তার মতে, ২১ অগাস্ট এতোটাই ক্ষত তৈরি করেছে যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মানুষ এই ঘটনা অনেক দিন মনে রাখবে। এ কারণে দু’দলকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন।

আর এই ঘটনার জের ধরে দল দু‘টার মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা বা আলোচনার সুযোগ না থাকলে, তা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে আরো কদর্য করে তুলবেই বলে মনে করছেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি