রাজশাহীতে ওয়াসার ভূগর্ভস্থ পানির ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্পে প্রায় ২৮ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় চীন। এর আগে ২০২২ সালে দেশটির পক্ষ থেকে নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। দেশের বড় কোনো প্রকল্পে চীন সর্বশেষ ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২১ সালে। ওই বছর ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ১১৩ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার দেয়ার বিষয়ে ঢাকার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বেইজিং।
যদিও ২০১৬ সালে সফরের সময় বাংলাদেশে প্রায় ২৫ বিলিয়ন (আড়াই হাজার কোটি) ডলারের বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর ধারাবাহিকতায় ২০২১ সাল পর্যন্ত এখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে চীন। ওই সময়ের মধ্যেই পদ্মা সেতু রেল লিংক (সহায়তার পরিমাণ প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার) এবং বিদ্যুৎ সংযোগ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের (১৪০ কোটি ডলারের কিছু বেশি) মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলোয় ঋণ দেয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল চীন। যদিও ২০২১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে সে জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে দেশটি।
আর্থিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঋণ ও অনুদান হিসেবে ১ হাজার ১০৪ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এ প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ছাড় হয়েছে ৭৭২ কোটি ডলার। এর বড় একটি অংশ এসেছে শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। ওই সময়ের পর থেকে এ পর্যন্ত আর নতুন কোনো বড় অংকের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়নি বেইজিং।
এক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাদের মূল্যায়ন হলো এসব সংকটের কারণে দেশে প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের সংশয়ের জায়গা তৈরি হয়েছে। আবার কভিডের পর থেকে চীন নিজেও অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশটি নতুন বিনিয়োগ নিয়ে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করে থাকতে পারে। তবে এর মধ্যেও বিভিন্ন দেশে চীনের আর্থিক সহায়তা বজায় থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন দেখা যাচ্ছে। বেইজিংয়ের প্রতি বৈরী পক্ষগুলো থেকে নানা নেতিবাচক প্রচার রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারও দেশটি থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিনিয়োগ কমে আসার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা এর প্রথম কারণ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্যে চীনের বিনিয়োগের প্রভাব নিয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল। তাই সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো বিনিয়োগ সীমিত করার বিষয়ে চিন্তা করা হয়ে থাকতে পারে। গত দুই বছর চীনের অর্থনীতিও চাপের মধ্যে রয়েছে। তাই হয়তো তারাও সাবধানতা অবলম্বন করছে।’
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে স্বাক্ষরিত হয় ‘স্ট্রেনদেনিং অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন’ শীর্ষক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)। ওই চুক্তির আওতাভুক্তসহ নানা খাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন শি জিনপিং। ওই এমওইউর আওতায় বাংলাদেশে চীনা ঋণে মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল।
এ পর্যন্ত চলমান আটটি প্রকল্পের বিপরীতে মাত্র ৭৯২ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য ৭০ কোটি ডলারের প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২০১৭ সালে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপন প্রকল্পের জন্য ৫৫ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয়। ২০১৮ সালে পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে দুটি ঋণ চুক্তি হয়। ২০১৯ সালে ও ২০২০ সালে ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও গ্রিড শক্তিশালীকরণের দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০২১ সালে ঢাকা- আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের চুক্তিটির পর নতুন কোনো বড় প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দেয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়নি চীন।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হলে দেশে চীনের আর্থিক বিনিয়োগ ও সহায়তা বাড়বে। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৯ সাল পর্যন্ত একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ ছিল চীন। কিন্তু এর পরই করোনার কারণে বিনিয়োগে কিছুটা ভাটা পড়ে। বর্তমানে চীনা বিনিয়োগগুলো স্থানান্তর হচ্ছে মূলত আসিয়ানের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দ্য রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) আওতাভুক্ত দেশগুলোয়। বাংলাদেশ এর আওতাভুক্ত হলে এবং চীনের সঙ্গে এফটিএ সই করলে এখানে বিনিয়োগ আরো বাড়বে।’
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের উন্নয়নে গঠিত হয়েছে চীন-বাংলাদেশ সিল্ক রোড ফোরাম। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া এখন বাংলাদেশ-চায়না সিল্ক রোড ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চীনা বিনিয়োগ কমার পেছনে শুধু বাংলাদেশে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা, সেটিও দেখতে হবে। আর যদি চীন ইচ্ছাকৃতভাবে সেটি বন্ধ রাখে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে চীনের বিনিয়োগ যাতে না আসে সেজন্য বহির্বিশ্বের অনেকেই চেষ্টা করে। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এজন্য চীন চাইলেও অর্থ ছাড় করতে পারে না। চীন আমাদের তিস্তা ব্যারাজে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য তা এগোয়নি। তবে সামনের দিনগুলোয় দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেখানে বেইজিংয়ের প্রতি বৈরী দেশগুলো বাংলাদেশকে চীনের কাছে সহজে ছেড়ে দেবে না।’
দেশে চীনের বিনিয়োগে গৃহীত প্রকল্পগুলোয় ঠিকাদারের কাজ প্রধানত চীনা সংস্থাগুলোই পেয়ে থাকে। আবার অন্যান্য দেশের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পেও দেখা যায় চীনা ঠিকাদারদের আধিপত্য। পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রেও মূল সেতু নির্মাণ ও নদীশাসনের কাজ করেছে দুই চীনা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনা ঠিকাদারের মাধ্যমে।
অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৪০টি চীনা কোম্পানি কাজ করছে। আর মার্কিন থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (এইআই) এক হিসাবে উঠে এসেছে, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চীন থেকে ঋণ এসেছে ৭০৭ কোটি ডলারের। আর দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে শুধু নির্মাণকাজের ঠিকাদারিই পেয়েছে ২ হাজার ২৯৪ কোটি ডলারের।
বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক ও নীতিগত নানা প্রশ্নে বর্তমান সরকারের ভিন্নমত ও দূরত্বের কারণে চীনা বিনিয়োগ অনেকটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান নেয়া চীনের প্রকাশ্য ও মৌন সমর্থন পায় বাংলাদেশ। এর পরও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না আসার বিষয়টি কূটনৈতিক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ কমার পেছনে মিশ্র কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা আগের ঋণের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি কিনা সেটা একটি প্রশ্ন। এখানে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতার বিষয় রয়েছে। আর ঋণের অর্থ কাজে লাগাতে না পারলে, শুধু শুধু বেশি ঋণ নেয়ার দরকার নেই। তাছাড়া কভিডের পর চীনের অর্থনীতিও দুর্বল হয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। সেটার কারণেও দেশটি বিনিয়োগ কমাতে পারে।’
বনিক বার্তা