কাজী জাওয়াদ
অনেকটা দৈবযোগেই আবিষ্কৃত হলো আন্তসংসদীয় ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রধানের কাছে লেখা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর চিঠি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে ইউনিয়নের ৫৯তম সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের যোগদানের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ৩১ আগস্ট চিঠিটি লেখা হয়। সেই চিঠি কীভাবে পাওয়া গেল, এটা সেই কাহিনি।
কয়েক দিন আগে এইচ টি ইমামের লেখা ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইটি পড়ছিলাম। লেখক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। তাঁর বইয়ে প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ডের বিবরণ থাকার কথা, আছেও। তিনি প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ডের অনেক বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। সরকারের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের কথা লিখেছেন রাখঢাক না করেই। যেমন ৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘বিশেষ করে শেখ মনি কেন জানি না, কিছুতেই মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্ব মানতে চাইতেন না। …শেখ মনির ক্ষমতার উৎস ছিল ভারতীয় ‘র’ (RAW) নামক গোপন প্রতিষ্ঠান।’
বইটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। মন্ত্রিপরিষদের এক সভা সম্পর্কে এইচ টি ইমাম লিখেছেন, ‘আগস্ট মাসের শেষে ২৪ তারিখে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পররাষ্ট্রবিষয়ক একটি প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা হয়। …সভায় পররাষ্ট্রসচিবের পাঠানো প্রতিবেদনের ইন্দো-মস্কো চুক্তি সম্পর্কিত একটি বিশ্লেষন সম্বন্ধে আলোচনা হয়। …পররাষ্ট্রসচিবের প্রতিবেদন থেকে একটা জিনিস ভালোভাবেই উল্লেখ হয় যে চুক্তি সম্পাদনের দিন থেকে সোভিয়েত সরকারের আচরণ কিছু শীতল হয়ে পড়েছে এবং তাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমর্থন মিলছে না। পররাষ্ট্রসচিবের প্রতিবেদনে এ কথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু এমনটি ছিল না।’ (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, www.pathagar.net থেকে ডাউনলোড করা পিডিএফ সংস্করণ, পৃ. ১৬৭।)
ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা সম্বন্ধে পড়েছি অন্য রকম। রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ তাঁদের বিখ্যাত ‘ওয়ার অ্যান্ড সিসেশন পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ বইয়ের ২০১-২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘…সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মিসেস গান্ধীর মস্কো সফরের কয়েক দিন আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১০ সেপ্টেম্বরের আন্তসংসদীয় ইউনিয়নের সম্মেলনে এবং ১০ দিন পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে আফগান বাদশাহ সফর শেষে যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রশ্নে সমালোচনামূলক অবস্থান না নেওয়ার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য একজন উচ্চপদস্থ সোভিয়েত কূটনীতিক নয়াদিল্লি আসেন।’
এইচ টি ইমাম আগস্ট মাসের শেষ দিকে পররাষ্ট্রসচিবের প্রতিবেদনে সোভিয়েতের নিষ্ক্রিয়তা অস্বীকার করেছেন। আর সিসন ও রোজ লিখছেন, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে নিজেদের ভূমিকার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য সোভিয়েত কূটনীতিকের ভারতে যাওয়ার কথা। একই বিষয়ে দুই বইয়ে দুই রকম বিবরণ। তাই আন্তসংসদীয় ইউনিয়ন (আইপিইউ) সম্মেলন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য ইউনিয়নের সের্গেই চেলনোকভের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি মহাফেজখানা ঘেঁটে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠান। তারপর আরও কিছু প্রশ্ন করায় তিনি খোঁজাখুঁজি করে পেলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মূল চিঠি। আমাকে সেটার ছবি পাঠিয়ে লিখলেন, ‘তোমার জন্য ই-মেইলটা একটু মিষ্টি করে দিলাম।’ জবাব দিলাম, ‘পুরো একটা মিষ্টি পেলাম।’
চিঠির নকল পেয়ে দায়িত্ব বেড়ে গেল। অন্তর্জালে অনুসন্ধান করে দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মহাফেজখানায় চিঠিটার কোনো ছবি নেই। বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’-এর ৪র্থ খণ্ডে এ চিঠির কোনো উল্লেখ নেই। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইটিতেও চিঠিটির উল্লেখ করেননি। বইটি সংবাদ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময় তাঁর আকস্মিক মৃত্যু এর কারণ হতে পারে।
আইপিইউর প্রেসিডেন্ট তখন ফরাসি রাজনীতিক আঁদ্রে চন্দরনগর। তাঁর বংশনামের মধ্যের ‘র’ অক্ষরের বদলে ‘ন’ পড়লে হয় চন্দননগর। নামটা কি চেনা চেনা লাগছে? হ্যাঁ, পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার শহর চন্দননগর। একসময়ের ফরাসি উপনিবেশ। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে এই শহরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আঁদ্রে চন্দরনগরের দুই প্রপিতামহেরই জন্ম হয়েছিল এই শহরে। তাই তাঁদের বংশনাম চন্দরনগর। কী অদ্ভুত কাকতালীয় যোগাযোগ। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কি জানতেন বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ আছে—এমন একজনকে তিনি চিঠিটা লিখেছিলেন? কিংবা নামটা দেখে আমার যেমন কৌতূহল হয়েছে, তাঁরও হয়তো তেমন হয়েছিল। কিন্তু তখন এত সহজে এগুলো জানা যেত না।
চিঠিটার ছবি এখানে দেওয়া হলো। মধ্য লন্ডনের গোরিং স্ট্রিটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধির কার্যালয় থেকে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী চিঠিতে লেখেন:
প্রিয় মি আঁদ্রে চন্দরনগর,
আপনাকে বাংলাদেশ সরকারের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আমি মি এ কে নজরুল ইসলাম এবং ডা. এম এইচ এ প্রামাণিককে পাঠাচ্ছি। তাঁরা আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলবেন।
আপনি দয়া করে সম্ভব হলে তাঁদেরকে সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের সাক্ষাতের এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে বাংলাদেশে সংঘটিত শোকাবহ ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সুযোগ করে দিলে বাধিত হব। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা এখনো গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বেআইনিভাবে বন্দী। গত পাঁচ মাসে তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারেনি। গোপনে তাঁর বিচার চলছে, এগুলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ জেগে উঠেছে এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমরা বিশ্বের সরকারগুলো এবং জনগণের কাছে আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আবেদন জানাই।
গভীর ব্যক্তিগত শুভেচ্ছান্তে, আপনার বিশ্বস্ত,
(বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী)
বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি’
- কাজী জাওয়াদ সাংবাদিক। ই–মেইল: [email protected]