আরেকটি নাইন-ইলেভেন প্রতিরোধ করতে হলে

নয়া দিগন্ত | হামিদ মীর


আফগানিস্তান ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে, যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এ দেশে আক্রমণ করেছিল। সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের এক দশক পর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা আফগানিস্তান আক্রমণ করে। যুক্তরাষ্ট্র গত আগস্টে এ দেশ ত্যাগ করে এবং নাইন-ইলেভেনের ২০ বছর পর আফগানিস্তান ফের ২০২১ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সভার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো। ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আফগানিস্তানের বিষয়টি আলোচনা করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে আফগানিস্তানের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তালেবান সাধারণ পরিষদে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, তবে বাধ্য ছিল না।

২০ বছর আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান ও আলকায়েদার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আজ বিশ্বশক্তিকে তালেবানের বিষয়ে বিভক্ত দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি মানবিকভিত্তিতে আমেরিকা নতুন তালেবান প্রশাসনের জন্য কিছু শিথিলতা ঘোষণা করেছে। তবে বাইডেন প্রশাসন তালেবানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে প্রস্তুত নয়। চীন ও ইরান তালেবানকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। পাকিস্তান তালেবান সরকারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, যদিও ১৫ আগস্টের পর আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্তে সন্ত্রাস বেড়েছে।

বিন লাদেন নাইন-ইলেভেনের হামলার প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড ছিলেন না
সম্প্রতি (সুইজারল্যান্ডের) লুগানোতে আয়োজিত অ্যান্ডোরফিন ফেস্টিভ্যালে সুইজারল্যান্ডে আলকায়েদা ও ড্রাগ মাফিয়ার সাথে তালেবানের সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। বেশির ভাগ প্রশ্নই শুধু আফগানিস্তান নিয়ে ছিল না বরং তালেবান ও চীনের মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিককেন্দ্রিক ছিল। আমরা কি আরো বিপজ্জনক বিশ্বে বাস করছি? ‘ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র’ হিসেবে বিখ্যাত সুইজারল্যান্ডে এটিই ছিল বারবার মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি লুগানো ফেস্টিভ্যালে আমার বহু জাতিগত দর্শকদের জানিয়েছি, উসামা বিন লাদেন নাইন-ইলেভেনের হামলার প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড নন। নাইন ইলেভেনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন খালিদ শেখ মুহাম্মদ। উসামা বিন লাদেন শুধু তার প্রস্তাবিত একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর থেকে এফবিআই খালিদ শেখ মুহাম্মদকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এফবিআইয়ের একজন সাবেক স্পেশাল অ্যাজেন্ট ফ্রাঙ্ক পেলেগ্রিনো ১৯৯৫ সালে খালিদ শেখ মুহাম্মদের বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা জানতে পেরেছিলেন। তিনি খালিদ শেখ মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে খালিদ শেখ মুহাম্মদকে ট্র্যাক করেন এবং তাকে গ্রেফতারের জন্য কাতার পৌঁছেন। খালিদ শেখ মুহাম্মদকে আমেরিকায় ফিরিয়ে নিতে একটি বিমান প্রস্তুত ছিল। কিন্তু গ্রাউন্ডে কিছু ক‚টনীতিকের পক্ষ থেকে বাধা ছিল। অবশেষে খালিদ কাতার থেকে আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। ১৯৯৫ সালে কেবল খালিদ শেখ মুহাম্মদকে গ্রেফতার করে নাইন-ইলেভেন ঠেকানো যেত। কাতার থেকে পালানোর পর খালিদ আলকায়েদায় যোগ দেন।

এফবিআই, সিআইএ আলকায়েদার আগ্রহের কথা জানত
নাইন-ইলেভেন রোধ করার আরেকটি সুযোগ ছিল। এফবিআই ও সিআইএর কাছে তথ্য ছিল যে, আলকায়েদা বিমান প্রশিক্ষণের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই দু’টি শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্থা জানত যে, আলকায়েদা অন্তত তিনজন ছিনতাইকারীকে বিমান প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকায় পাঠিয়েছে। কিন্তু তারা তাদের থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা অভিযানের পরিচালক মাইকেল ম্যাককনেল ২০০৭ সালে অবহেলার কথা স্বীকার করেছিলেন। মার্কিন সরকার কর্তৃক প্রকাশিত নাইন-ইলেভেন কমিশনের প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও চিহ্নিত করা হয়েছে, যার ফলে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলা হয়েছে এবং হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নাইন-ইলেভেন কমিশনের প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, খালিদ শেখ মুহাম্মাদ উসামা বিন লাদেনকে ১০টি বাণিজ্যিক বিমান হাইজ্যাক করার পরামর্শ দিয়েছিলেন যার মধ্যে ৯টি এফবিআই এবং সিআইএ সদর দফতর, কিছু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবনসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বিধ্বস্ত হবে। খালিদ নিজেই মিডিয়ার সামনে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমেরিকার কোনো এক বিমানবন্দরে দশম বিমানটি অবতরণ করাতে চেয়েছিলেন। উসামা বিন লাদেন খালিদ শেখ মুহাম্মদের প্রস্তাব মনোযোগসহকারে শুনেছিলেন, কিন্তু গোটা পরিকল্পনায় রাজি হননি। বিন লাদেন আলকায়েদার কিছু শীর্ষ নেতার চাপে ছিনতাইয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনেন এবং খালিদ শেখ মুহাম্মদকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া কখনোই অনুমোদন করেননি। আলকায়েদা ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত নাইন-ইলেভেনের পরিকল্পনা করেছিল। তারা পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে, তবে এই হামলা রোধ করা যায়নি, যদিও জর্দানের গোয়েন্দারা ২০০১ সালের জুলাইয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের বিমান হামলা সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। আলকায়েদা দুই বছর ধরে এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল। বেশির ভাগ ছিনতাইকারী পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাস করত এবং শিক্ষিত ছিল। তারা জার্মানিতে একসাথে সময় কাটায়। তারা কোনো মাদরাসা থেকে মৌলবাদী হয়ে ওঠেনি। ১৯ জন ছিনতাইকারীর মধ্যে ১৫ জনই ছিল সৌদি আরবের। আসলে তারা তাদের নিজেদের সরকারের মার্কিনপন্থী নীতির বিরুদ্ধে ছিল। তাদের সৌদি জাতীয়তার কারণে তাদের জন্য আমেরিকায় প্রবেশ করা সহজ ছিল। গ্র“প লিডার মুহাম্মদ আতা ছিল মিসরের। এর মানে কী? সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও লেবাননের বিপুল সংখ্যক জনগণ তাদের অঞ্চলে মার্কিন নীতি কখনোই মেনে নেয়নি। এখানে রাজনীতির প্রসঙ্গ চলে আসে। এখন আমাদের নাইন-ইলেভেনের নেপথ্যে রাজনৈতিক কারণ সম্পর্কে কথা বলা উচিত।

বিন লাদেন সাদ্দামের সাথে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন
১৯৯৭ সালে আমার জন্য এটা বোঝা কঠিন ছিল না যে, উসামা বিন লাদেন আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ হামলার আয়োজন করতে চলেছেন। ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমেরিকা আর পরাশক্তি হবে না। তিনি প্রথম সাক্ষাৎকারে মোটেও ধর্মের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কারণ তাকে আমেরিকার চাপে সুদান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তিনি ফিলিস্তিন, সোমালিয়া, কাশ্মির ও অন্যান্য অনেক বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তবে তার মূল ফোকাস ছিল সৌদি আরবে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ইরাকের মরহুম প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত আক্রমণ করেছিলেন, তখন তিনি ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তার সরকারকে তার সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সৌদি সরকার তার প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় এবং মার্কিন সেনাদের আমন্ত্রণ জানাল। উসামা বিন লাদেন তার সরকারের সমালোচনা শুরু করেন। কিন্তু সৌদি আরবে বাকস্বাধীনতা ছিল না। তাকে আটক করা হয়। তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দীন রাব্বানীর হস্তক্ষেপে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তারপর তিনি তার সরকারকে ধোঁকা দিয়ে সুদানে পালিয়ে যান।

মার্কিনিরা ২০০৬ সালে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেয়। উসামা বিন লাদেন ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেনের সাথে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি কিছু পশ্চিমা সাংবাদিক যেমন যুক্তরাজ্যের রবার্ট ফিস্ক ও আমেরিকার পিটার আর্নেটকে সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন। তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে খোলাখুলি কথা বলেছিলেন। নাইন-ইলেভেনের এক বছর পর, উসামা বিন লাদেন আমেরিকাকে একটি পত্র লিখেছিলেন। আমেরিকা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে, তার নীতিগুলো আলকায়েদাকে আরো জনশক্তি প্রদান করেছে। তারা ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। ওয়াশিংটন দাবি করেছিল, সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কারণে তারা ইরাক আক্রমণ করেছিল। আমি সাংবাদিক হিসেবে মার্কিন সেনাদের সাথে ইরাকের রাজধানী বাগদাদেও প্রবেশ করেছি। বহু দিন পর্যন্ত গণবিধ্বংসী অস্ত্র উদ্ধারের অপেক্ষা করেছি। অবশেষে প্রমাণিত হয়েছিল যে, গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু ইরাকে মার্কিন হামলা আইএস নামে এক নতুন চরমপন্থী শক্তি তৈরি করে।

আমার ধারণা, ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর উসামা বিন লাদেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। আর সে কারণেই তিনি সোভিয়েত প্রত্যাহারের কয়েক মাস আগে আলকায়েদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে বেনজির ভুট্টোর সরকার উসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করেছিল। কিন্তু সৌদি আরবে মার্কিন সেনাদের আগমন উসামা বিন লাদেনের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দেয়। তিনি সৌদি রাজপরিবারের সাথে সমস্যা তৈরি করেন, যারা সে সময় ওয়াশিংটনের খুব কাছাকাছি ছিল। তিনি রাজপরিবার ও আমেরিকায় তাদের সমর্থকদের সাথে এক ধরনের ব্যক্তিগত শত্র“তা গড়ে তোলেন। তিনি ১৯৯৩ সালে সোমালিয়ায় আমেরিকানদের শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সেখানে কিছু পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন এবং অবশেষে আমেরিকানদের সোমালিয়া থেকে সরে আসতে বাধ্য করেন। সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনাদের প্রস্থান তাকে বিভিন্ন দেশে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আরো হামলার আয়োজন করতে উৎসাহিত করে। ১৯৯৮ সালে আমার সাথে তার দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারে তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধকে ধর্মের আবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সৌদি আরবে আমেরিকানদের ওপর হামলা করে তিনি গর্ববোধ করেন। সেই হামলায় কিছু নিরীহ মানুষও নিহত হয়েছিল। আমি তাকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি মনে করেন না যে, আপনি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে মুসলমানদের বদনাম করছেন?’ তিনি তার পরিকল্পনাকে ‘ন্যায়সঙ্গত’ আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেন। তিনি তার লাঠি দিয়ে একটি দেয়ালে ঝুলানো মানচিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে আরো কিছু লক্ষ্য চিহ্নিত করেন। তার সব লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা। এইগুলো মূলত এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ছিল। তার অভিযোগ, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স আরবদের খনিজসম্পদ চুরি করতে চেয়েছিল। তিনি আরো একবার রাজনৈতিক অভিযোগ করলেন। তবে এবার তিনি ইসলামের আশ্রয় নিলেন। আমি মনে করি, তিনি তখন পর্যন্ত মোটেও আমেরিকার ভেতরে নাইন-ইলেভেন ঘটানোর পরিকল্পনা করেননি। খালিদ শেখ মুহাম্মদই তাকে আমেরিকার অভ্যন্তরে হামলার ধারণা দিয়েছিলেন। উসামা বিন লাদেন ১৯৯৯ সালে খালিদ শেখ মুহাম্মদের সাথে নাইন-ইলেভেনের চূড়ান্ত ছক তৈরি করেন। তিনি এক আরব সাংবাদিক ও আমার কাছে তার বার্তাবাহককে নাইন ইলেভেনের ব্যাপারে অস্বীকারমূলক বিবৃতি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। বার্তাবাহক হামলার কয়েক মিনিট আগে আমার অফিসে এসেছিলেন। নাইন-ইলেভেনের হামলার পর আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। নিশ্চিত ছিলাম যে, উসামা বিন লাদেন হামলার আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু তিনি আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে রক্ষা করার জন্য নিজের ভ‚মিকাকে অস্বীকার করেছিলেন।

বিন লাদেনের সাক্ষাৎ নিতে আফগানিস্তানে গমন
নাইন-ইলেভেনের সাত সপ্তাহ পরে, ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে যখন তৃতীয়বার তার সাক্ষাৎকার নিলাম, তখন আমি সন্দেহ করিনি যে, তিনি নাইন-ইলেভেনের জন্য দায়ী। পাকিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম দেশে জনমত ছিল বিপরীত। আমার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার অনেক মানুষ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল না যে, আফগানিস্তানের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ আমেরিকার হৃৎপিণ্ডে নাইন-ইলেভেনের আয়োজন করেছিলেন। আমি লুগানো ফেস্টিভ্যালে তরুণ আমেরিকানদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, যারা বিশ্বাস করে না যে, নাইন-ইলেভেনের জন্য উসামা বিন লাদেন দায়ী।

অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নাইন-ইলেভেনের পর আমি কিভাবে মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম? আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি যে, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম, একটি বড় গল্পের জন্য আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলাম এবং মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিকে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম। পশ্চিমা মিডিয়া আমার ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে, কিন্তু পাকিস্তানের কিছু সংবাদপত্র দাবি করেছে, এটি একটি ভুয়া সাক্ষাৎকার। পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আমাকে কিছু সময়ের জন্য আটক করে। যখন প্রমাণ করলাম যে, আমি কোনো আন্তর্জাতিক বা স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করিনি, তখন আমি মুক্তি পেয়েছি। সিএনএনও আমাকে উদ্ধার করেছে। তারা কিছু টেকনিক্যাল এক্সপার্ট নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। তারা সাক্ষাৎকারের টেপ পরীক্ষা করে, ফিল্মের রোল চেক করে দেখে। সিএনএনে নিক রবার্টসনের রিপোর্ট প্রমাণ করেন, এটি একটি সত্যিকারের সাক্ষাৎকার ছিল।

নাইন-ইলেভেনের পরপরই উসামা বিন লাদেন এই অপরাধে তার সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। নাইন-ইলেভেনের তিন বছর পরে হঠাৎ তিনি এক ভিডিও বার্তায় এর জন্য দায় স্বীকার করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি এই বার্তা প্রকাশ করেন। তিনি নৃশংস আরব শাসনের সাথে জর্জ ডব্লিউ বুশের তুলনা করেন। তিনি দাবি করেন যে, তিনি ইসরাইলিদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নিয়েছেন। এটা আবার প্রমাণ করল যে, তিনি রাজনীতি করছেন। তিনি নাইন-ইলেভেনের পর একজন ঝানু রাজনীতিকের মতো আমাকে মিথ্যা বলেছিলেন যে, নাইন-ইলেভেন হামলায় তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু কয়েক বছর পর তিনি কৃতিত্ব নিতে চাইলেন। আমার মনে হয়, তিনি চেয়েছিলেন, বুশ আবার প্রেসিডেন্ট হোক। বুশ মূলত ইরাক আক্রমণ করে তার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিলেন।

২০১১ সালের মে মাসে আমেরিকানরা অবশেষে পাকিস্তানে উসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে। তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ শেষ হয়। উসামা বিন লাদেন সম্পর্কে পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থার দ্বৈত খেলা নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত¡ ছিল, কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আলকায়েদার বিরুদ্ধে ভ‚মিকা রাখার জন্য শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা পাকিস্তানকে ধন্যবাদ জানান। উসামা বিন লাদেন কখনো পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাকে বিশ্বাস করেননি। কিন্তু শত্র“কে ঠকানোর জন্য তিনি পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমির খুব কাছাকাছি একটি আস্তানা বেছে নিয়েছিলেন। তালেবান প্রতিষ্ঠাত মোল্লা ওমরও একই কাজ করেছিলেন। ওমর বহু বছর ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির কাছে লুকিয়ে ছিলেন। বিশ্ব পরাশক্তি উসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর উভয়কেই জীবিত ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। দু’জনেই বছরের পর বছর তাদের সফলভাবে ধোঁকা দিয়েছিলেন। আমি মনে করি, এটি ছিল বিশ্ব পরাশক্তির অযোগ্যতা।

আমেরিকা মূলত ২০২০ সালে যুদ্ধে হেরে গেছে, যখন তারা তালেবানের সাথে শান্তি চুক্তি করেছিল। তারা তালেবানকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। তালেবানরা আবার আফগানিস্তানে শাসন করছে। ২০ বছর আগে তালেবানরা ছিল আমেরিকা, ইরান, চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য অনেক শক্তির লক্ষ্যবস্তু। আজ চীন ও ইরান তালেবানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। রাশিয়াও শান্তভাবে তালেবানদের সহযোগিতা করছে। উসামা বিন লাদেন ১৯৯৭ সালে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তালেবানরা ইরান ও চীনের সাথে আমেরিকা ও ভারতের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠন করুক। এখন ইরান, চীন ও রাশিয়া আইএসের বিরুদ্ধে তালেবানকে সমর্থন করছে। উসামা বিন লাদেন আমেরিকা ও তালেবানদের মাঝে আলোচনার পূর্বাভাসও দিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়ের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। আমেরিকা উসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে, তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার একবার আমাকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন যে, তারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবেন না এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা করবেন। আসল কথা হলো, আমেরিকা ও ন্যাটো দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ গত ২০ বছরে মিডিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বৃদ্ধি করেছে। সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি। তবে এই সন্ত্রাসবিরোধী আইনগুলো অনেক দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কখনো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রচার করেনি। আমেরিকার গুয়ানতানামো বে কারাগার দেখুন। বছরের পর বছর ধরে বহু মানুষ সেখানে বিনা বিচারে আটক ছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে বাগরাম কারাগার স্থাপন করেছিল। আমেরিকা সেই কারাগারকে করেছিল সম্প্রসারিত। আর আজ, তালেবানরা পশ্চিমা মিডিয়াগুলোকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যাতে তারা ছোট খাঁচাগুলো দেখতে পায়, যেখানে কয়েদিরা বন্দী ছিল। আমেরিকা অন্তত গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধ করতে পারে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক। আজ নতুন তালেবান সরকারের অর্ধেক মন্ত্রী এই কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারের সাবেক বন্দী।

জাতিসঙ্ঘ তালেবানদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গত ২০ বছরের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে আমাদের ঐক্য দরকার। আধুনিক বিশ্বের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার উচিত আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক ব্যর্থতার জন্য একে-অপরকে দোষ দেয়া বন্ধ করা। আরেকটি নাইন-ইলেভেন এড়াতে তাদের অবশ্যই নিজেদের সমন্বয় ও সহযোগিতার উন্নতি করতে হবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের গত ২০ বছরের মূল শিক্ষা এটি।
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট