১৭ ঘণ্টায় দুই ব্যাংকের তিন শাখায় অস্ত্রধারীদের হামলা

বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে মঙ্গলবার রাতে সন্ত্রাসীদের হামলায় ব্যাংক লুটের ঘটনা পর পাহারায় এপিবিএন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গতকাল সকাল ১০টায় রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের সামনে
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে মঙ্গলবার রাতে সন্ত্রাসীদের হামলায় ব্যাংক লুটের ঘটনা পর পাহারায় এপিবিএন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গতকাল সকাল ১০টায় রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের সামনেছবি: প্রথম আলো

বান্দরবানের দুই উপজেলা রুমা ও থানচিতে ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা করল অস্ত্রধারীরা। রুমায় তারা অস্ত্রের মুখে মানুষকে জিম্মি করে এবং থানচিতে বাজারে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে।

রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটার দিকে হামলা করেও অস্ত্রধারীরা কোনো টাকা নিতে পারেনি। তবে বুধবার দুপুর একটার দিকে থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলা করে তারা সাড়ে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে যায়।

হামলাকারীরা রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) নিজামুদ্দিনকে জিম্মি করে নিয়ে গেছে। পাশাপাশি তারা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫টি গুলি লুট করেছে। মানুষের মুঠোফোনও নিয়ে গেছে তারা।

রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির সঙ্গে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। অন্যদিকে স্থানীয় লোকজন বলছেন, থানচিতে হামলার সঙ্গেও একই গোষ্ঠী জড়িত।

কেএনএফ পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নতুন সশস্ত্র সংগঠন। তারা ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিপূর্বে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ আলোচনা হয় গত ৫ মার্চ। এরপর হামলার ঘটনা ঘটল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা ইউনিফর্ম (নির্দিষ্ট পোশাক) পরে এসেছিল। তাতে কেএনএফ লেখা ছিল। থানচিতে ব্যাংকে ডাকাতি করার পর তারা ফাঁকা গুলি করতে করতে বেরিয়ে যায়।

বিষয়টি নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বলেন, পুলিশ ও বিজিবি তাদের দায়িত্ব পালন করছে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও কুকি চিন ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযানে যোগ দেবে।

চাঁদের গাড়িতে গিয়ে ব্যাংক লুট

বান্দরবান থেকে সড়কপথে থানচির দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। সেখানে সাপ্তাহিক হাটবার ছিল গতকাল। সকালে বাজারে লোকজন বেশি ছিল। দুপুর হতে হতে ভিড় কমে যায়। হামলা হয় বেলা একটার দিকে। সেখানে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখা দুটির অবস্থান পাশাপাশি। কাছেই থানচি থানা। উপজেলা পরিষদও বাজারের কাছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অস্ত্রধারীরা আসে চার চাকার মোটরগাড়ি যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত দুটি চাঁদের গাড়িতে। সংখ্যায় ছিল ৪০ জনের মতো। ব্যাংকের ভেতরে চার থেকে আটজন ঢুকলেও বাকিরা বাজারের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। এ সময় তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে।

থানচি কৃষি ব্যাংকের শাখার নিরাপত্তা প্রহরী অং সা প্রু প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীদের দেখে তিনি প্রথমে ব্যাংকের দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হন। কিন্তু অস্ত্রধারীরা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচজন অস্ত্রধারী ব্যাংকে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। বাইরে আরও সাত–আটজন অবস্থান করছিল। অল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্রধারীরা ব্যাংকের টাকা লুট করে বেরিয়ে যায়।

ব্যাংকের ভেতরে কী হয়েছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় দুই ব্যাংকের দুই কর্মকর্তার কাছে। কৃষি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক হ্লা সুই থোয়াই প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিফর্ম পরে সাত–আটজন ঢুকে টাকা নিয়ে নেয়। গ্রাহকদের মুঠোফোনও কেড়ে নেয় তারা। এ সময় তাদের কয়েকজনের হাতে থাকা ওয়্যারলেস সেটে বাংলায় টাকা নিয়ে নেওয়ার নির্দেশও শুনতে পান বলে জানান তিনি।

থানচিতে কৃষি ব্যাংকের শাখা
থানচিতে কৃষি ব্যাংকের শাখাছবি: প্রথম আলো

অন্যদিকে সোনালী ব্যাংকের থানচি শাখার ব্যবস্থাপক ফয়সাল হুদা দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারী পাঁচ থেকে সাতজন লোক ব্যাংকে ঢোকে। ক্যাশ কাউন্টারে থাকা টাকা তারা নিয়ে যায়। ব্যাংকের বাইরেও অস্ত্রধারী ১০ থেকে ১২ জন ছিল। পরে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়।

ঘটনার সময় বাজারে ছিলেন রেমাক্রি ইউনিয়নের জন ত্রিপুরা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গুলির শব্দ শোনার পর থেকে মানুষ ছোটাছুটি শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর গুলি থামে। তখন শোনা যায় ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে।

অস্ত্রধারীরা যে চাঁদের গাড়িতে থানচি বাজারে গিয়েছিল, তা ভুসি নেওয়ার কথা বলে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল বলে জানান গাড়ি দুটির চালকেরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন ফোন করে দুটি গাড়ি লাগবে বলে জানায়।

গাড়িচালকদের একজন বলেন, ফোনে ভাড়ার কথা অনুযায়ী তংকং পাড়ায় পৌঁছে কেএনএফ লেখা পোশাক পরা অস্ত্রধারীদের দেখতে পান তিনি। তখন আর ফিরে আসার উপায় ছিল না। ওই দুই গাড়িযোগে প্রায় ৪০ জন অস্ত্রধারী থানচি বাজারে যায়। ডাকাতি শেষে তারা দুটির পাশাপাশি বাজার থেকে আরও একটি গাড়ি নিয়ে তংকং পাড়ায় পৌঁছায়। যাওয়ার পথে ছান্দাকপাড়ার সামনে ফাঁকা গুলি ছোড়ে তারা। দুই চালক দাবি করেছেন, তাঁদের কোনো গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়নি।

রুমায় যেভাবে ডাকাতি

বান্দরবান শহর থেকে রুমার দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। রুমা উপজেলা পরিষদের ২০০ গজ দূরে সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখা। তার পাশে উপজেলা মসজিদ। আশপাশে সব উঁচু উঁচু পাহাড়।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ঢোকার মুখে একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় থাকেন সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় তলার এক পাশে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা। আরেক পাশে থাকেন ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১০ জন পুলিশ সদস্য।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ সদস্যরা হামলার আগে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। এতে উপজেলা পরিষদ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। অস্ত্রধারীরা বান্দরবান-রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের অংশে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়।

হামলায় কেএনএফের শতাধিক সদস্য অংশ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগের পরনে ইউনিফর্ম ছিল। সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সোনালী ব্যাংক, স্থানীয় মসজিদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনের দিকে যায়। ইউএনওর বাসভবনের দিকে তারা আনসার সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়।

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর চট্টগ্রামের উপমহাপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ রাসেল ঘটনাস্থলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দায়িত্বরত আটজন আনসার সদস্যের মধ্যে চারজন আহত হয়েছেন। তাঁদের ৪টি শটগান ও ৩৫টি গুলি লুট করে অস্ত্রধারীরা।

মসজিদে তখন নামাজ চলছিল। সেখানে ২০ জনের মতো মুসল্লি ছিলেন বলে জানিয়ে রুমা উপজেলা মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারী ২০ থেকে ২৫ জন মসজিদে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে তারা সোনালী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে নিয়ে যায়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কেএনএফ সদস্যরা পুলিশের গার্ড কমান্ডার উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) মামুনুর রহমান ও কনস্টেবল তৌহিদুল ইসলামকে আহত করে দুটি লাইট মেশিনগান (এসএমজি) ও আটটি চায়নিজ রাইফেল লুট করে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, কেএনএফ পুলিশের কাছ থেকে ৩৮০টি গুলিও নিয়েছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কনস্টেবল রূপন শীল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আর কনস্টেবল তৌহিদ ব্যাংকের সামনে পাহারায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি ইউনিফর্ম পরা অস্ত্রধারী কয়েকজন। তারা আমাদের ব্যারাকে ঢুকিয়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে থাকা অস্ত্র ও মুঠোফোন নিয়ে নেয়।’

থানচিতে সোনালী ব্যাংকের সামনে  পুলিশের সতর্ক প্রহরা
থানচিতে সোনালী ব্যাংকের সামনে পুলিশের সতর্ক প্রহরাছবি: প্রথম আলো

এদিকে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি। ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুনে দেখা গেছে, মঙ্গলবার রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দুটি চাবি একসঙ্গে দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারীরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি।

নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে

রুমার পর থানচিতেও ডাকাতির ঘটনার পর বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলায় ব্যাংকের লেনদেন সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেলাটির সাত উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের সাতটি শাখা রয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকের শাখাও আছে। এদিকে দুই উপজেলায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

ডাকাতির ঘটনার পর বুধবার রুমায় যান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান মো. মনিরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংক কর্মকর্তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

মানববন্ধন

সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা নিজামুদ্দিনকে অক্ষত উদ্ধার এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার দাবিতে বুুধবার বেলা ১১টার দিকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে রুমা উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। উপজেলা পরিষদ এলাকায় এই মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি সুকান্ত দেব, সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বড়ুয়া প্রমুখ। সুকান্ত দেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি।’

prothom alo