কৃষিতে সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা দিনাজপুর। প্রতি বছর এখানে যে পরিমাণে আলুর আবাদ হয়, তা জেলার চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও যায়। এ বছরই দিনাজপুরে ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর ক্ষেত থেকে কৃষকরা আলু যে দামে বিক্রি করেছেন, ছয় মাস পর সেই আলু প্রায় আড়াইগুণ দামে তাদেরই কিনে খেতে হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা।
দিনাজপুর বাহাদুর বাজার এনএ মার্কেট, রেলওয়ে বাজার, চকবাজারসহ সবখানেই বর্তমানে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে। অথচ গত মার্চ মাসেও এই আলু বিক্রি হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ টাকায়। কৃষক পর্যায়ে যা ছিল আরও কম। ফলে কৃষকদের আক্ষেপের শেষ নেই। কষ্ট করে ঘাম ঝরিয়ে আলু আবাদ করলেও মজুতদাররা লাভবান হচ্ছেন বলে অভিযোগ কৃষকদের।
দিনাজপুর সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের বোলতৈড় এলাকার কৃষক সেলিম রেজা বলেন, ‘যখন আলু জমি থেকে তুলেছি তখন দাম ছিল ১৬ থেকে ১৭ টাকা করে। ওই আলু তো আমরা রেখে দিতে পারি না। কারণ, আলু বিক্রি করার টাকা দিয়েই আমাদের অন্য ফসল উৎপাদনে ঝুঁকতে হয়। এখন আমাদের আবাদ করা আলুই আমাদের কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। আমরা এত কষ্ট করে আবাদ করলাম, অথচ আমাদের লাভ নেই। লাভ হয়ে গেলো মজুত যারা করলো তাদের।’
সদরের ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের উলিপুর গ্রামের কৃষক ইসমাইল আলী বলেন, ‘মার্চে আলু বিক্রি করেছি যে দামে তার চেয়ে ডাবল (দ্বিগুণ) দামে আলু কিনে খেতে হচ্ছে। আলুর দাম বাড়বে, কিন্তু এতটা বেশি? আমরা ঘাম ঝরিয়ে আবাদ করছি, আর লাভবান হচ্ছেন স্টকআলারা (মজুতদাররা)। এটা দেখা দরকার যে কৃষকদের কাছ থেকে আলু, ধান, গম, ভুট্টা নিয়ে লাভবান হচ্ছেন অন্যরা। একবার খালি কৃষকদের কাছ থেকে নিতে পারলেই দাম বেশি।’
একই এলাকার কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে আলু বিক্রি করেছি। আর ছয় মাসের মধ্যেই আলুর দাম দ্বিগুণেরও বেশি। আমরা ক্ষেত থেকে আলু উঠলেই বিক্রি করে দিই। আর সেই আলু ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করে। আমরা যারা আলু আবাদ করি আমাদেরই খেতে হয় দ্বিগুণ দামে। এটা দেখার দায়িত্ব কার?’
হঠাৎ আলুর এমন দাম বৃদ্ধিতে শুধু কৃষকরাই নন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ ক্রেতারাও। পাশাপাশি সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে সেই দামেও বাজারে আলু পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রাম কিংবা শহর সবখানেই আলু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
দিনাজপুরের বাহাদুর বাজারে আলু কিনতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা টানানো থাকলেও সেই দামে আলু পাচ্ছি না। বেশি দামে আলু কিনতে হচ্ছে। কার্ডিনাল জাতের আলু ৪০ টাকা কেজি, কিন্তু মূল্য রয়েছে ৩৬ টাকা কেজি।’
আরেক ক্রেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে আলুরও দাম বেশি। যা উপার্জন হয় তা তো বাজার করতেই শেষ। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েও তো কোনও লাভ নেই।’
বাজারের তৌহিদুল নামে এক সবজি বিক্রেতারা বলেন, ‘আমাদের যে দামে কিনতে হচ্ছে তাতে দুই-এক টাকা লাভ রেখে আলু বিক্রি করছি। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। বড় বড় আড়তদার যারা রয়েছেন, তারাই বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন।’
তালিকা টানানোর পরও দাম বেশি কেন—এমন প্রশ্নে কথা বলতে চাননি ওই বাজারের আড়তদাররা। যদিও তালিকা না থাকা ও বেশি দামে আলু বিক্রি করার অভিযোগে রবিবার একই বাজারে মেসার্স জাকির ট্রেডার্সের মালিক জাকির হোসেন, সোহাগ স্টোর ও গাজী স্টোরকে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
এ বিষয়ে দিনাজপুর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম বলেন, ‘আলুর দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে কয়েকটি হিমাগার ও বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে। জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’