জনগণের টাকায় বেতনভুক্ত দলদাস বিচারক ও পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদি সরকার বরাবরই মামলাকে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করার প্রক্রিয়া গ্রহন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মান নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায়ও সরকার মামলা এবং হামলার পথ বেছে নিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানের বিরোধীতায় সোচ্চার আল্লামা জুনায়েদ বাবু নগরী, আল্লামা মামুনুর হক ও সৈয়দ ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে একাধিক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলা গুলো পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ফ্যাসিবাদি সরকারের আওয়ামী আদালত। এই মামলা গুলো তদন্তাধীন থাকা অবস্থায়ই আহমদ শফির ইন্তেকালকে কেন্দ্র করে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করা হল। এই মামলাটিও একই পদ্ধতিতে আওয়ামী আদালত থেকে ফ্যাসিবাদি সরকারের নিয়ন্ত্রিত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানের বিরোধীতা করে বক্তব্য দেয়ায় আলেমদের চাপে রাখতেই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে ধারণা করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ইস্যুতে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই গত মঙ্গলবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেন কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহমুুদুল হাসানের নেতৃত্বে আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে আলোচনা সফল হয়েছে বলেও দাবি করেছিলেন উভয় পক্ষ।
পরে এ বিষয়ে নিজ দফতরে সংবাদ সম্মেলনও করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি প্রসঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। যেহেতু আমরা আলোচনা শুরু করেছি, শিগগির এর একটি ফলপ্রসূ ফলাফলও পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, তারা (আলেমরা) যে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন, সেসব নিয়ে আলোচনা চলবে। আমরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করব না। আমরা সংবিধানের বাইরে গিয়েও কোনো কিছুই করব না।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে হেফাজতে ইসলামকে ইঙ্গিত করে বলেন, পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবারও ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে মাঠে নেমেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করেই এই অপশক্তি সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।’
এরপরই বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শিপলু কুমার দে’র আদালতে মরহুম আল্লামা শফীর শ্যালক মো. মইন উদ্দিন মামলা দায়ের করেন। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই সরকার পন্থি হিসাবে পরিচিত আল্লামা আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানী বিরোধী।
বাদীর আইনজীবী আবু হানিফ বলেন, আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।
মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে মাওলানা মো. নাসির মুনিরকে। আর দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানের বিরোধিতা করে জোরালো বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় নেতা মীর ইদ্রিস, হাবিব উল্লাহ, আহসান উল্লাহ, জাকারিয়া নোমান ফয়েজীর নামও রয়েছে আসামির তালিকায়।
আইনজীবী আবু হানিফ বলেন, আসামিরা মানসিক নির্যাতন করে আল্লামা শফীকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামি মামুনুল হক এ বছরের ১১ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় এসে হেফাজতের বর্তমান আমীর জুনাইদ বাবুনগরীর সাথে বৈঠক করেন। পরে তারা আনাস মাদানিকে বহিষ্কারের দাবি করেন তার বাবা আহমদ শফীর কাছে। আহমদ শফী বিক্ষুব্ধদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। আনাস মাদানিকে বহিষ্কার না করলে হেফাজতের তৎকালীন আমীরের চরম ক্ষতি করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয় বিক্ষুব্ধদের পক্ষ থেকে। এ সময় অসুস্থ আহমদ শফীকে বিক্ষুব্ধরা নানাভাবে বিরক্ত করেন এবং হুমকি দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীকে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন এবং তার নাকে লাগানো অক্সিজেন নল খুলে ফেলেন বিক্ষুব্ধরা। এসময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মাদ্রাসার বাইরে আনার চেষ্টা করেও পারা যায়নি। যে কারণে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
উল্লেখ্য গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা ও হাটহাজারী মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের পরিচালক আহমদ শফী মারা যান।
তার আগের দিন শফীর অব্যাহতি এবং তার ছেলে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানির বহিষ্কার দাবিতে মাদ্রাসায় বিক্ষোভ করেন মাদ্রাসাটির সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা ।
শিক্ষার্থীদেরর অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে ১৭ সেপ্টেম্বর শূরা কমিটির বৈঠকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন ‘বড় হুজুর’ খ্যাত আল্লামা আহমদ শফী।
ওই বৈঠকে আল্লামা শফীর ছেলেসহ দুই শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় দৃশ্যত আহমদ শফীর সুদীর্ঘ দিনের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। তাঁর সাথে সরকারের দালাল বলে পরিচিত গ্রুপটিকে হাটহাজারি মাদ্রাসা ছাড়তে হয়।
সেই বৈঠকের পরপরই আহমদ শফীকে মাদ্রাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়া হলে পরদিন তিনি মারা যান।
তাঁর ইন্তেকালের পর থেকেই একটি চক্র এনিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে। তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন আহমদ শফি মানষিক চাপে মারা গেছেন। কখনো বলা হয়েছে, তাঁকে সময় মত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এরকম নানা অভিযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল শুরু থেকেই। কিন্তু এই চক্রটির এসব দাবী তখন হালে পানি পায়নি। আল্লামা আহমদ শফিকে স্বাভাবিক নিয়মে হাটহাজারি মাদ্রাসায় জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
আল্লামা আহমদ শফিকর ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে কে আসবেন এনিয়ে প্রশ্ন উঠে। স্বাভাবিক নিয়মে হেফাজতে ইসলামের আমির নির্বাচনের পদ্ধতি অনুযায়ী সারা দেশের কাউন্সিলরদের ডেকে সম্মেলনের মাধ্যমে নূতন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। কাউন্সিলে আল্লামা জুনায়েদ বাবু নগরীকে আমির ও আল্লামা নুর হোসাইন কাশেমীকে (মরহুম) মহাসচিব নির্বাচিত করে নূতন কমিটি গঠন করা হয়।