হিরো আলমের ‘মানহানির মূল্য’ ৫০ কোটি টাকা কেন?

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৫৪
হিরো আলমের ‘মানহানির মূল্য’ ৫০ কোটি টাকা কেন? – ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে আশরাফুল আলম- যিনি হিরো আলম হিসেবে পরিচিত, ৫০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন রকম আলোচনা শুরু হয়েছে।

হিরো আলম বলেছেন, ‘আমাকে হেয় করে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা কোনো মানুষ সম্পর্কে কেউ বলতে পারে না। আমার যথাযথ যোগ্যতা ছিল বলেই নির্বাচন কমিশন আমার প্রার্থিতা বহাল রেখেছে, আমাকে দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দিয়েছে। তিনি তো আমাকে নিয়ে এভাবে কথা বলতে পারেন না। তাই আমি মানহানির মামলা করেছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এত দিন ধরে যারা আমাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম বাজে কথা বলেছে, খারাপ মন্তব্য করেছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে আমার আরো আগে থেকেই মানহানির মামলা করা উচিত ছিল। তারা আমাকে পছন্দ না করতে পারে, কিন্তু আমাকে অপমান করে তো কথা বলতে পারেন না। ভবিষ্যতেও যারা এভাবে কথা বলবে, তাদের বিরুদ্ধেও আমি আইনি ব্যবস্থা নেব।’

গত ১৮ জুলাই রাজশাহীতে এক কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার সময় হিরো আলমের বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

বাংলাদেশে কারো মন্তব্যের বা সংবাদের জের ধরে মানহানির মামলা করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। সংবাদ প্রকাশের জেরে ‘সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হওয়ার দাবি করে শতাধিক কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলার উদাহরণও রয়েছে।

কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে, কেন আর কিভাবে মানহানির মামলা করা হয়? ‘সম্মানের মূল্য’ কিভাবে নির্ধারণ করা হয় আর ক্ষতিপূরণ কতটা পাওয়া যায়?

মানহানির মামলা কী?
বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেছেন, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করা উদ্দেশে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অবমাননাকর শব্দাবলী বা চিহ্ন বা প্রতীকের সাহায্যে নিন্দা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এমনকি মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তার উত্তরাধিকারীরা এটা করতে পারে।

আইন অনুযায়ী, অভিযোগ বা বক্তব্য অবশ্যই মানহানিকর হতে হবে, যার বিরুদ্ধে এটা করা হয়েছে, তার সামাজিক মর্যাদায় ব্যাঘাত করবে এবং যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, সেটা বিদ্বেষমূলক হতে হবে। এসব উপাদান প্রমাণ করতে পারলে মানহানি হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে।

মিতি সানজানা বলেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশে যারা কথায় কথায় প্রতিনিয়ত মানহানির মামলা করেন, বেশিরভাগ মামলাই বিদ্বেষমূলক বা হয়রানিমূলক হয়ে থাকে। কারো বিষয়ে সত্য প্রকাশ করা হলে বা জনস্বার্থে প্রকাশ করা হলে কিন্তু মানহানি হবে না।’

সম্মানের মূল্য কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
মিতি সানজানা বলেন, ‘কারো বক্তব্যে বা সংবাদে কার কতটা মানহানি হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই। মামলার বাদী যেভাবে চায়, সেভাবেই ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করে থাকে। তবে আদালত তার রায়ের ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, আয় বা মর্যাদা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারে।’

হিরো আলম জানিয়েছেন, তিনি মানহানির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০ কোটি টাকা দাবি করেছেন। দুটি কারণে তিনি এই অঙ্ক নির্ধারণ করেছেন। তিনি চাননি, স্বল্প মূল্য নির্ধারণ করে তার এই বিষয়টিকে হালকা করে দেখা হোক। আবার শতাধিক কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে অযৌক্তিক কোনো দাবি করতে চাননি।

তিনি বলেন, ‘আমি একেবারে কম দাবি করে হালকা করতে চাইনি, আবার অযৌক্তিক কোনো টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে চাইনি। আমি ৫০ কোটি টাকার স্ট্যান্ডার্ড একটা টাকা সমমূল্যের মানহানির ক্ষতিপূরণ দাবি করেছি।’

একজন অভিনেতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে এই অঙ্ক যথাযথ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

মিতি সানজানা বলছেন, ‘অনেক সময় এক শ’ কোটি টাকা, দুই শ’ কোটি টাকা চেয়ে মানহানির ক্ষতিপূরণের মামলা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা সম্পূর্ণ বিদ্বেষমূলকভাবে করা হয়, অপর পক্ষকে চাপে ফেলার জন্য বা হয়রানি করার জন্য। বিশেষ করে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে চাপ তৈরি করার জন্য প্রায়ই এমন মামলা দেখা যায়। পরে এসব মামলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয় না বা কোনো ফলাফল আসে না। তবে যথাযথ তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যৌক্তিকভাবে মানহানির ক্ষতিপূরণের মামলা করা হলে এবং সেটা প্রমাণ করতে পারলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ আছে।’

নিয়ম অনুযায়ী, যে পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়, তার একটি অংশ প্রথমেই আদালতে জমা দিতে হয়।

তবে বাংলাদেশে নতুন যে সাইবার সিকিউরিটি আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে মানহানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার অঙ্ক বেধে দেয়া হয়েছে। আগে মানহানির মামলা হলেই গ্রেপ্তার করার যে নিয়ম ছিল, সেটা তুলে দেয়া হয়েছে নতুন আইনে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মানহানি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা বিধান ছিল। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা। জরিমানা না দিলে তিন মাস বা ছয় মাস কারাদণ্ড হতে পারে।

তবে আগের মতোই মানহানি, অবমাননা বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার বিষয়টি দেওয়ানি আইনের পরিবর্তে ফৌজদারি আইনে করার বিধান রাখা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক কয়েক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অবমাননা বা মানহানির মামলাগুলো আসলে দেওয়ানি ব্যবস্থায় থাকা উচিত। মানহানির মামলা ফৌজদারি আইনে করা হলে তাতে যে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে তা ওই ব্যক্তি পাবে না, বরং সেটা পাবে রাষ্ট্র। আর এই একই মামলা দেওয়ানি আইনে করা হলে ক্ষতিপূরণ পাবে ব্যক্তি। যা ন্যায়সঙ্গত নয় বলে তিনি মনে করেন।

আলোচিত কয়েকটি মানহানির মামলা
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে নিয়ে ‘মানহানিকর বক্তব্য’ দেয়ার অভিযোগ এনে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দুটি মানহানির মামলা করেছিলেন দু’জন আইনজীবী। পরে অবশ্য তাপস বলেছেন, তিনি ওই মামলায় সম্পৃক্ত নন, দু’জন অতি উৎসাহী আইনজীবী মামলা করেছেন।

টেলিভিশনে একটি টকশোতে এক নারী সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে অশালীন বক্তব্যের জের ধরে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে অন্তত ২০টি মানহানির মামলা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব মামলা হয়েছিল, যেখানে তার কাছে ২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল। সেসব মামলায় তিনি কিছু দিন কারাগার ছিলেন।

২০১৬ সালে টেলিভিশনে একটি বক্তব্যের জের ধরে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারাদেশে ৬৭টি মামলা করা হয়। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে ৭১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল।

যদিও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, মানহানির মামলায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো মামলা করার বিধান নেই এবং একই অপরাধে একাধিক মামলা করা যায় না। তবে এসব ঘটনায় দেখা গেছে, একটি ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেছে এবং আদালত তা আমলে নিয়েছে।

’অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে নৌমন্ত্রীর কোটি কোটি টাকা অপচয়, ১৪ বার বিদেশ ভ্রমণ’- এমন শিরোনামের একটি সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০১১ সালে ১০ কোটি টাকা সমমূল্যের মানহানি হয়েছে বলে যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। প্রায় ১২ বছর চলার পরে ওই মামলা থেকে তারা অব্যাহতি পান।

মেয়ের করোনা সনদ নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশের জের ধরে ইনকিলাব সম্পাদক এবং আরেকজনে বিরুদ্ধে তিনি ২০২০ সালে মানহানির মামলা করেছিলেন, যার এখনো কোনো রায় হয়নি।

আবার ওই বছর আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগ এনে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী ইলিয়াস কাঞ্চন ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

ক্ষতিপূরণ কতটা পাওয়া যায়?
আইনজীবীরা বলছেন, মানহানির অনেক মামলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব মামলার আর কোনো ফলাফল হয় না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবু আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সামাজিক অবস্থান থেকে যে যেই অঙ্কের ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করে, ওই টাকার মানহানির মামলা করেন। তা বিচারে গেলে আদালত ঠিক করবে যে আসলে তার কী মানহানি হয়েছে, তখন ক্ষতিপূরণ বা সাজা দেয়ার প্রশ্ন আসবে।’

তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আইনজীবী হিসেবে তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মানহানির মামলায় রায় হওয়ার বা কারো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার তথ্য তিনি শোনেননি।

তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ মামলাই পরে বাতিল হয়ে যায় অথবা আদালতের বাইরে আপস-মীমাংসা হয়ে যায়।’

কিন্তু মানহানির পাশাপাশি তার অঙ্গহানির বা অন্য কোনো ক্ষতির শিকার হলে সেটার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উদাহরণ রয়েছে বলে তিনি জানান।
সূত্র : বিবিসি