হিরো আলমকে নিয়ে বিবৃতি সরকারের অসন্তোষ, দূতদের পাল্টা জবাব

logo

মিজানুর রহমান

২৭ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার

mzamin

facebook sharing button

ভোটের দিনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিরো আলমের ওপর বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদানকারী ১৩ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অসন্তোষের কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যৌথ বিবৃতি প্রদানকারী বিদেশি মিশন প্রধানের হাতে অভিন্ন প্রতিবাদপত্রও (প্রটেস্ট নোট) ধরিয়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বুধবার বিকালে ঢাকাস্থ ১২ দেশের রাষ্ট্রদূত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধানকে ডেকে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ডাকে সাড়া দেয়া ১৩ কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি। সেখানে তিনি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন। বলেন, দলবদ্ধভাবে কূটনীতিকদের এমন বিবৃতি ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার’-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি দাবি করেন বিবৃতিটি বস্তুনিষ্ঠ ছিল না। প্রতিমন্ত্রী ভবিষ্যতে এমন ‘অকূটনৈতিক’ আচরণ থেকে বিরত থাকতে বিদেশি দূতদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তার প্রাথমিক বক্তব্যের সমাপ্তি টানেন। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, এ পর্যায়ে তিনি দূতদের কথা বলার জন্য ফ্লোর উন্মুক্ত করেন।

প্রথমেই ফ্লোর নেন ডাচ্ রাষ্ট্রদূত। তিনি তাদের বিবৃতি প্রদানের যুক্তি তুলে ধরেন।

বলেন, সেখানে তারা হামলার নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। সুষ্ঠু ভোটের পথে অন্তরায় এমন ঘটনা সরকারও চায় না বলে বহুদিন ধরে যে দাবি করে আসছে তারা সেটাই বিবৃতিতে তুলে ধরেছেন। পরে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক কথা বলেন। কূটনৈতিক সূত্র মানবজমিনকে জানায়, বৈঠকে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক প্রতিমন্ত্রীর কাছে খোলাখুলিভাবেই জানতে চান তাদের আমন্ত্রণ বা তলব করা হয়েছে? জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘না, এটা তলব নয়। আমরা এটা আমন্ত্রণই বলছি।’ সূত্র জানায়, বৈঠকে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ ৪-৫ জন রাষ্ট্রদূত কথা বলেন। তাদের সকলের অবস্থান ছিল প্রায় অভিন্ন। তারা বিবৃতির যৌক্তিকতা প্রমাণে সরকারের দায়িত্বশীলদের অবাধ, সুষ্ঠু এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির কথাই রেফারেন্স হিসেবে বারবার তুলে ধরছিলেন। বৈঠক শেষ হওয়ার আগে ডাচ্ রাষ্ট্রদূত ফের কথা বলার সুযোগ চান। অবশ্য সময় স্বল্পতায় তা সম্ভব হয়নি দাবি করে বৈঠকে উপস্থিত সরকারের একজন কর্মকতা বলেন, পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের এক পর্যায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা কূটনীতিকদের কাছে জানতে চান কেন বিবৃতি প্রদানের আগে সরকারের সঙ্গে তারা কথা বলেননি? কেন ঘটনা পরবর্তী আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অ্যাকশন বা ত্বরিৎ পদক্ষেপের বিষয়টি  কূটনীতিকদের বিবৃতিতে স্থান পায়নি? সরকারকে পাশ কাটানো বা ঘটনা পরবর্তী পদক্ষেপগুলোকে আমলে না নিয়ে ‘প্রিমেচিউর’ এমন বিবৃতি কেবলই পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করবে বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। 

গত ১৭ই জুলাই ভোট চলাকালে কূটনৈতিক জোন খ্যাত বনানী এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ভোট শেষ হওয়ার অল্প আগে সংঘটিত ওই হামলার ভিডিও মুহূর্তেই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার ঝড় তোলে। যার প্রেক্ষিতে ঢাকাস্থ পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিনিধিরা একক এবং জোটবদ্ধভাবে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। ১৩ দূতের যৌথ বিবৃতিতে হামলার নিন্দা জানানো ছাড়াও দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানানো হয়েছিল। মা‌র্কিন দূতাবাস প্রচারিত বিবৃ‌তি‌তে বলা হয়, আমরা গত ১৭ই জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী আশরাফুল আলম- যিনি হিরো আলম নামে পরিচিত-তার ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহিতার দাবি জানাই। আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় সেজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই। বিবৃ‌তিতে স্বাক্ষরকারী দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন। কূটনীতিকদের এমন বিবৃতিকে ভালোভাবে নেয়নি সরকার। তাৎক্ষণিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বুুধবার সেই বিবৃতি প্রদানকারী ১৩টি বিদেশি মিশন প্রধানকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা’য় ডেকে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ছাড়াও সেই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রিয়ার এডমিরাল অব. খুরশেদ আলম, ঢাকা-১৭ আসনে জয়ী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত, অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়ামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এমন ‘অকূটনৈতিক আচরণ’ থেকে বিরত থাকবেন ১৩ মিশনপ্রধানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: এদিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সরকারের অসন্তোষ জ্ঞাপনের পর রমনাস্থ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে  সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি। সেখানে তিনি বলেন, আজ দুপুরে রাষ্ট্রদূতদের আমরা ডেকেছিলাম। তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণে আমরা আমাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছি। আমরা বলেছি যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা দিয়ে সারাদিনের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, হিরো আলম ওইদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে অবাধে ঘুরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভোট শেষ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনিও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হননি বা কোনো অভিযোগ করেননি। অন্য প্রার্থীরাও কোনো ধরনের সহিংসতা বা অন্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ করেননি। তাই শুধু একটি কেন্দ্রের শেষ মুহূর্তের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে গুটিকয় কূটনীতিক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা কখনোই সারাদিনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রতিফলন নয়। দ্রুত একটি প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তারা তাদের মূল্যায়নটির বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেননি।

হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়ে জানার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশন ও সরকার দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১৯শে জুলাই কূটনীতিকরা যৌথ বিবৃতি দেয়ার অনেক আগেই দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৮ই জুলাই তা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। অথচ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার পরেও এই কূটনীতিকরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যা অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়। শাহরিয়ার আলম বলেন, যে দ্রুততা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির সমালোচনা তারা করেছেন, সেই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু তারা সরকারের গৃহীত তাৎক্ষণিক ও ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করেননি। তাই যৌথ বিবৃতিটির বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়।

যৌথ বিবৃতিটি ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে যথা সময়ের অনেক আগেই তড়িঘড়ি করে অপরিণতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে মন্তব্য করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করি, আমাদের আজকের আলোচনার পর তারা সেটি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন এবং ভবিষ্যতে এমন অকূটনৈতিক আচরণ থেকে বিরত থাকবেন। এ সময় বিদেশি মিশনপ্রধানদের কূটনৈতিক আচরণবিধি সম্পর্কিত ভিয়েনা কনভেনশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে গঠনমূলক হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। স্মরণ করা যায়, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমের (হিরো আলম) ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। ওই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকায় জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়কারী শেলডন ইয়েটকে গত ২০শে জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে একইভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকার।