Farhad Mazhar 15 October 2022
হিন্দুত্ববাদের আঁতুড়ঘর ইংরেজি শিক্ষিত আধুনিক উচ্চ বর্ণের হিন্দুর বাংলাভাষা ও সাহিত্য। ‘সাহেব-পণ্ডিতদের বাংলা’ বলা যায়। উত্তর ভারত, কিম্বা হিন্দি ভাষা নয়, বরং হিন্দুত্ববাদের জন্মস্থান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলার, কিন্তু হিন্দুত্ববাদের আদর্শিক ভিত্তি তাঁর হাতেই গড়ে উঠেছে। তিনিই প্রথম পুরাণকে ইতিহাস বলে দাবি করেছেন, কৃষ্ণকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। রামায়নও এখন ইতিহাসের বই।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য কর্মের রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ ব্যক্ত হয়েছে বিনায়ক দামোদর সাভারকর (১৮৮৩-১৯৬৬) -এর রচনা ও তৎপরতায়। সাভারকর ১৯২২ সালে রত্নগিরিতে বন্দী থাকার সময় হিন্দুত্বের পক্ষে – অর্থাৎ ভারত শুধু হিন্দুদের এই প্রকার হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ গড়ে তোলেন। সেটা ছিল জাতিবাদের যুগ। সাভারকার হিন্দু মহাসভার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়ে তিনি হিন্দুত্ব (হিন্দুত্ব) শব্দটিকে জনপ্রিয় করেন, এবং ভারতীয় জাতিবাদকে ইসলাম নির্মূল রাজনীতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। উপনিবেশবিরোধী জাতিবাদের যুগে সেটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু একালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সাভারকারের হিন্দুত্ববাদকে যে রূপ দান করেছে এবং নরেন্দ মোদীর বিজেপি তার যে রূপ খাড়া করেছে তাকে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করাই সঙ্গত। সনাতন ধর্মের সঙ্গে এর সম্পর্ক অতিশয় ক্ষীণ। ইহুদিবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দক্ষিণ এশীয় মতাদর্শ হিশাবে ভারতে হিন্দুত্ববাদ গড়ে উঠেছে। যার রূপ আমরা ওয়ার অন টেররের মধ্যে দেখেছি।
যেটা ভুলে যাওয়া ঠিক না সেটা হোল সাভারকার ছিলেন নাস্তিক। সনাতন ধর্মের বৈচিত্র, ঐতিহাসিক উপলব্ধি, কিম্বা ভাবগত মর্মের গভীরতা সম্পর্কে তার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। নাস্তিকতা হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত ধারা হিশাবে বাইরের কিছু না। উপমহাদেশে বিভিন্ন ভূগোল, আবাস, ভাষা, ধর্মের পার্থক্য, বৈচিত্র এবং বিরোধ রয়েছে। সেই বৈচিত্র্য ও বিরোধের মধ্যে ঐক্যের সাধনা উপমহাদেশের বৈশিষ্ট্য। তার গোড়া নষ্ট করে দিয়েছে নাস্তিক্যবাদী সেকুলার হিন্দুত্ব । ফলে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চিনের বিপরীতে ভারতকে শক্তি হিশাবে গড়ে তোলার ভারতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারন হিন্দুত্ববাদ ভারতীয় স্পিরিট বা আত্মিক শক্তিকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে। ভারত সাম্রাজ্য হতে পেরেছিল যখন মুঘল বা সুলতানরা ‘বহিরাগত’ হয়ে নয়, ভারতীয় হয়ে দেশ শাসন করেছেন। আসলে তারা শাসক থাকলেও শাসন ব্যবস্থার সকল স্তরে ছিলেন ‘হিন্দু’ বা ভারতীয়। ‘বহিরাগত’ এবং বিশুদ্ধ কাল্পনিক হিন্দুর ধারণা ভারতকে ভেতর থেকে নষ্ট করে দিয়েছে। এর ফলে ভারত মূলত নিজেকে শুধু নয় — সেন্ট্রাল এশিয়া ও মধ্য এশিয়ারও প্রতিনিধি হয়ে ওঠা — অর্থাৎ চিন ও রাশিয়ার বিপরীতে আরও বৃহত্তর ও শক্তিশালী শক্তি হিশাবে বিকাশের সম্ভাবনাও সমূলে বিনষ্ট হয়েছে।
হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল কালপর্ব থেকে মুক্ত হতে চায়। তাই মুঘল বা সুলতানদের ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে যে ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলা হয় সেটা পায়খানায় এসে আটকে যায়। ভারত এখনও তার শৌচকর্মকে সংস্কৃতির অন্তর্গত করতে পারে নি। সাম্রাজ্য হওয়া দূরের কথা। তার বাইরে যে ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতির কথা বলা হয় সেটা অরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদীদের ভাষ্য। ভারত ইউরোপের প্রাচ্যবাদী কল্পনার এক্সোটিক স্বর্গরাজ্য হতে চায়। সেটা চায় গরু খাওয়া বা গরু বেচাবিক্রির অপরাধে নিরীহ মুসলমান পিটিয়ে মারার সভ্যতা প্রদর্শন করে। এই বর্বরতাকেই সভ্যতা হিশাবে হাজির করার বাসনা হিন্দুত্ববাদীদের। এই প্রকার হিন্দুত্ববাদী ভারতকে রাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশের জনগণ কিছুটা বুঝতে পেরেছে। নাস্তিক্যবাদ যে শুধু বাংলাদেশের নয় , সর্ব ভারতীয় সমস্যা সেটা বাংলাদেশে পরিষ্কার।
বড় বাংলার শক্তিশালী ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সাভারকরের হিন্দুত্ববাদ সাংঘর্ষিক। আধুনিক জাতিবাদের বিকৃত ও সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে হিন্দুত্ববাদ পুরা উপমহাদেশকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলতে উদ্যত। অথচ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে দরকার পতনশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নতুন পরাশক্তি হিশাবে চিনের উত্থানের বিপরীতে উপমহাদেশকে নতুন ভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করা। আসন্ন বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে যেখানে দরকার নিজের বিচিত্র ও সমৃদ্ধ সভ্যতা নিয়ে গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো, কিম্বা যেখানে কার্ল মার্কসের সূত্র ধরে গর্ব করে বলা দরকার যে ভারত সকল বহিরাগতদের ‘হিন্দুভূত’ করে ফেলতে পেরেছে, যা অন্য কোন সভ্যতার পক্ষে সম্ভব হয় নি, সেই ভারত মাটি খুঁড়ে যত্রতত্র শিবলিঙ্গ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভারতের পরিচয় হয়ে উঠেছে মসজিদ ভাঙা এবং অতীতের সকল ঐতিহাসিক স্থাপনার নীচে শিবলিঙ্গ খুঁজে বেড়ানো মানসিক ভাবে অসুস্থ একটি জাতি হিশাবে। ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা ধূলায় লুন্ঠিত। পরম মিত্র হওয়া সত্ত্বেও বিব্রত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেই কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। এটা পরিষ্কার হিন্দুত্ববাদ ইসলাম নির্মূল ও মুসলমান নিধনের রাজনীতি চর্চা করার মধ্য দিয়ে মূলত শক্তিশালী ভারতের আবির্ভাবকে কয়েক শ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব ব্যবস্থায় হিন্দুত্ববাদী ভারত পরাশক্তি হিশাবে নয়, পরিচিত হয়ে উঠছে একটি বর্বর ও পশ্চাতপদ দেশ হিশাবে, যারা তাদের দেশের নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অক্ষম। অর্থাৎ বিশ্ব ব্যবস্থায় আত্মসম্মানের সাথে দাঁড়াবার যোগ্যতা ভারত হারিয়ে ফেলছে।
এই দুর্দশা সনাতন ধর্মের নয়, ভারতীয় ঐতিহ্যের নয়, কারন এই ধর্ম বা ঐতিহ্যে ‘অন্তর্গত’ ও ‘বহিরাগত’ নামক কোন ভেদবুদ্ধি নাই। সেই ভেদবুদ্ধি বা আর্য/অনার্য ভেদের শুরু ঔপনিবেশিক আমলে। আর্যবাদীদের ঔপনবেশিক কাল গেল। এখনকার হিন্দুত্ববাদ আধুনিক জাতিবাদী ও নাস্তিক্যবাদী সাভারকার মার্কা হিন্দুত্ববাদের করুণ পরিণতি। মনে রাখা দরকার বাংলার ভক্তি আন্দোলনের দিক থেকে বিচার করলে নাস্তিক্যবাদ উপমহাদেশে আধুনিক জাতিবাদী হিন্দুত্ববাদেরই রকমফের মাত্র। সাভারকারের নাস্তিক্যবাদকে হাল্কা ভাবে নেবার কোন সুযোগ নাই।
এই সেকুলার ও নাস্তিক্যবাদী হিন্দুত্ববাদ — অর্থাৎ আধুনিক হিন্দু জাতিবাদ ভারতে প্রতিটি মসজিদের নীচে শিবলিঙ্গ খুঁজে পাচ্ছে । হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদ আরও ভাঙবে, তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর পরিণতি উপমহাদেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ভাবেও খারাপ হবে এটা সম্ভবত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের নেতা মোহন ভাগবতও টের পাচ্ছেন। (কমেন্ট বক্সে দেখুন)। তিনি এখন বলছেন , সব মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার কি? কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, তাই না? জ্ঞানবাপী মসজিদসহ আরও অনেক মসজিদ ভাঙার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে।
শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতি কিম্বা সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত নির্দোষ কায়কারবার গণ্য করা ঠিক নয়। একালে ভু-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে শিল্প-সাহিত্যকে আলাদা বিচার করাও যারপরনাই কঠিন। বঙ্কিম পুরানকে ‘পুরাণ’ মেনে নিলেন না, তাকে ইতিহাস বানাতে চেয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে ঐতিহাসিক চরিত্র। তাহলে ‘রাম’ও বা আর রামায়নে পুরাণের নীতিকথন বা গল্প হয়ে থাকবেন কেন? তিনিও ইতিহাস হয়েছেন এবং অযোধ্যার মসজিদও ভাঙা হয়েছে। বাংলা সাহিত্য হিন্দুত্ববাদের জন্ম ও বিকাশের গোড়ায় এই অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। পুরাণকে ইহিহাস হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করা। অস্বীকার করে লাভ নাই।
মানুষের মহিমা পুনর্স্থাপনের জন্য নাস্তিকতা তো খারাপ কিছু না। সেটা হওয়া সহজও বটে। কিন্তু নিজেকে নাস্তিক দাবি করলেই ঈশ্বর মরে ভূত হয়ে যান না, বরং আরও শক্তিশালী ফিরে আসেন। বাংল ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ করতে গেলে বোঝা যায় আনন্দমঠ থেকে অযোধ্যার মসজিদ ভাঙার দূরত্ব খুব বেশী নয়। মানুষের জগত নিছকই বুদ্ধি আর জ্ঞানতাত্ত্বিক দুনিয়া না, যুক্তি দিয়ে আল্লা নাই প্রমাণ করলে আল্লা নাই হয়ে যান না। বরং প্রশ্ন হয়ে ফিরে আসেন। যেমন কাকে ‘আছে’ বলি আমরা? কিভাবে ‘নাই’ নির্ণয় করি? শুধু বুদ্ধি নয় মানুষের জগত কল্পনার, আবেগের, হৃদয়েরও জগত। আল্লা, ভগবান, ঈশ্বর, গড যে নামেই ডাকুন তিনি স্বয়ং মনের মসজিদে, মনের মন্দিরে মনের মঠে বা মনের গির্জায় নিজেকে ঠিকই রক্ষা করেন। সেখান থে্কে তাঁকে হঠানো মুশকিল।
বিনায়ক দামোদর সাভারকার নাস্তিক ছিলেন, বিষয়টা গুরুতর।