ইসরাইলের অহমিকা চূর্ন করেছে হামাস

মোতালেব জামালী : ইসরাইল বিশ্বের সেরা ৫টি সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর একটি- এই ধারণাকে মাত্র একদিনে সাধারণ অস্ত্রে সজ্জিত হাজারখানেক যোদ্ধার এক দু:সাহসী অভিযানে পাল্টে দিয়েছে হামাস। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনি এই সংগঠনটি। এখন প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে ইসরাইল হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলেও ইহুদিবাদী এই দেশটি তার হারানো সম্মান ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা আর কোনদিনই ফিরে পাবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

হামাসের সাতই অক্টোবরের বিষ্ময়কর হামলার পর ইসরাইলের খ্যাতিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেরুন র‌্যাপোর্ট বলেছেন, ইসরাইল এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রবেশ করছে, দেশটি তার ভাগ্য আর নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। হামাস এবং ফিলিস্তিনের অন্য সশস্ত্র সংগঠনগুলো সেদিন যে মাত্রার হামলা চালিয়ে লড়াই করেছে তা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর দেখা যায়নি।

মিডল ইষ্ট আইকে মেরুন র‌্যাপোর্ট বলেন, ৫০ বছর আগে ১৯৭৩ সালে ইসরাইলে মিসরের আকস্মিক আক্রমনও হামাসের এবারের হামলার মতো এতোটা বিষ্ময় সৃষ্টি করতে পারেনি। সাত অক্টোবর সকালে যেভাবে হামাসের শত শত যোদ্ধা ইসরাইলে প্রবেশ করেছেন তা ইসরাইলিরা কখনো কল্পনাও করেনি। এছাড়া চেকপোস্টে থাকা ইসরাইলি সেনাদের যেভাবে হামাসের সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে সেটি অনেকের কাছেই এক বিষ্ময়কর ঘটনা হয়ে থাকবে।

মেরুন র‌্যাপোর্ট বলেন, হামাসের এই হামলা ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে বললে খুব বেশি বলা হবে না। নিজেদের সেনাবাহিনীর উপর ইসরাইলি জনগণের আস্থা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এই বিশ্লেষক বলেন, ১৯৭৩ সালে আমরা যুদ্ধ করেছি একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন আমরা এমন একদল লোকের হামলা নিয়ে কথা বলছি যাদের কাছে কালাশনিকভ রাইফেল ছাড়া আর কিছু নেই। এটি একটি অকল্পনীয় ঘটনা। ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা এমন একটা ধাক্কা খেয়েছে যে, সেখান থেকে তাদের আত্মবিশ^াস ফিরে পেতে দীর্ঘ সময় লাগবে।

ইসরাইলি সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, দক্ষিন ইসরাইলে হামাসের আকস্মিক হামলায় নিহতদের মধ্যে উর্ধতন কর্মকর্তাসহ ৪০ জনেরও বেশি সেনা সদস্য আছেন। এছাড়া কয়েকজন কমান্ডারসহ অন্তত ৩৫ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমকর্তাসহ দমকল বাহিনীর তিনজন। এছাড়া হামাস ও ইসলামিক জিহাদ ইসরাইলের একজন জেনারেল ও কর্ণেলসহ কয়েক ডজন সেনা সদস্যকে পনবন্দি করেছে যা ইসরাইলের সামরিক ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

বিশ্লেষক মেরুন র‌্যাপোর্ট বলেন, ইসরাইলের অপূরনীয় ক্ষতি থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, হামাস কতটা নিখুত পরিকল্পনা করে সেদিন ভোরের হামলা শুরু করে। অথচ ইসরাইলের সামরিক ও অভ্যন্তরীনসহ তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার কোনটিই এই হামলা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। তাদেরকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে হামাস ও ইসলামিক জিহাদ নিজেদের পরিকল্পনা সফল ভাবে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে , তারা ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর চেয়ে কতটা দক্ষ ও পারদর্শী।

ইসরাইল বছরের পর বছর ধরে গাজা উপত্যকার ভিতরে এবং বাইরে অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও নজরদারি অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। এই গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও নজরদারি অবকাঠামোর মধ্যে আছে ক্যামেরা, আকাশে আছে সার্বক্ষনিক ড্রোন। এরপরও আছে নিরাপত্তা বেড়া।

ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিট যেটি ইউনিট ৮২০০ নামে পরিচিত, তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খুটিনাটি বিষয়েরই খবর রাখে, নজরদারি করে। কিন্তু দীর্ঘদিন পরিকল্পনা করে কয়েকশ বা হাজারো ফিলিস্তিনি যোদ্ধা যে ইসরাইলে একটি জটিল ও বিস্তৃত হামলার পরিকল্পনা করেছিল সে সম্পর্কে চৌকস এই গোয়েন্দা ইউনিট কিছুই জানতে পারেনি।

হামাস ইসরাইলের সব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে অকেজো করে দিয়ে নিরাপত্তা বেড়া ভেঙ্গে নিরাপদে ইসরাইলের ভিতরে পৌছে যায়। এরপর তাদের কিছু সদস্য ইসরাইলি সেনা সদস্য ও সাধারণ মানুষসহ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে ধরে গাজায় এনে তাদের সুড়ঙ্গে ঢ়ুকিয়ে ফেলে। কেউ তাদেরকে বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি যা কল্পনাও করা যায় না। এরপর ইসরাইলের সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের এত প্রশিক্ষণের আর কোন মূল্য থাকে কি ? এমন প্রশ্ন করেন বিশ্লেষক মেরুন র‌্যাপোর্ট।

অধিকৃত পশ্চিমতীরে ৩৩ ব্যাটেলিয়ন সেনা বসিয়ে রেখে গাজা উপত্যকার সাথে সীমান্ত অনিরাপদ রাখলে তার এমন মাসুল যে দিতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হামাসের এই দু:সাহসিক অভিযানের পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হয়তো গাজা উপত্যকাকে ধূলোয় মিশিয়ে দেবেন, হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করবেন। কিন্তু এই সামরিক অভিযানের আর কোনই গুরুত্ব ও তাৎপর্য নেই। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল ও তার সামরিক বাহিনী যা হারিয়েছে তা আর কোন দিনই ফিরে পাবে না।
ইসরাইলের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরাইল সামরিকভাবে গাজা উপত্যকাকে আর কোন দিনই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেনা। সেটা করতে গেলে শত শত সেনা সদস্যও মারা যাবে। একই সাথে ইসরাইলের এ ধরণের অভিযান আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। পশ্চিমতীরের বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সংগঠন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, এমনকি সিরিয়া ও জর্ডানও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন ইসরাইলি এই বিশ্লেষক।

আরব বিশে^র কয়েকটি গণমাধ্যম বলছে, এখনো নিখোঁজ রয়েছে ইসরাইলের অন্তত ৭৫০ জন নাগরিক। বিশ্লেষকগন মনে করেন, হামাস আসলে কতজন ইসরাইলি নাগরিককে জিম্মি করেছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ইসরাইলি সেনা সদস্য ও সাধারণ মানুষ ছাড়াও মার্কিন নাগরিকরা রয়েছেন হামাসের হাতে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে। হামাস ও ইসলামিক জিহাদ এখন পর্যন্ত ১৩০ জন আটকের কথা জানিয়েছে।

ইসরাইলি ও বিদেশি নাগরিকদের আটকের ঘটনা ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ ইতিহাসে হামাসের সবচেয়ে বড় বিজয় । কারণ ইসরাইলি সেনা ও মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি নিয়ে বন্দিবিনিময় চুক্তির সূর্য উঠবে ফিলিস্তিনের আকাশে। হামাসের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে উঠেবে জিম্মি ইসরাইলি মার্কিনীরা। কারণ বন্দি বিনিময় চুক্তি’র অংশ হিসাবে ইসরাইলি কারাগারে থাকা ৫ হাজার ২০০ ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির দুয়ার খুলে যাবে।

২০০৬ সালে ইসরাইলি সৈনিক গিলাদ শালিত গাজার কাছে একটি অভিযানের সময় হামাসের হাতে ধরা পড়েন। পাঁচ বছর আটকে রাখার পর ইসরাইলি কারাগারে বন্দি এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে শালিতকে মুক্তি দিয়েছিল। এবারও একই রকম বন্দি বিনিময়ের আশা করছেন ফিলিস্তিনিরা।

হামাসের সামরিক শাখার নেতা মোহাম্মদ দেইফ বলেছেন, ‘আমাদের শতাধিক বন্দি ২০ বছর অথবা তারও বেশি সময় ধরে ইসরাইলে কারাগারের অন্ধকারে আছেন। কারাগারে আমাদের কয়েক হাজার ভাই ও বোনেরা ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে নিঃশেষ হয়ে গেছে। চিকিৎসার অবহেলায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে।’ অন্যদিকে, হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ‘হামাসের লক্ষ্য আমাদের ভূমি, আমাদের পবিত্র স্থান, আমাদের আল-আকসা এবং আমাদের বন্দিদের মুক্ত করা।

আল জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা মনে করেন, হামাসের বিস্ময়কর হামলাটি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। মাত্র ১০ ঘণ্টায় ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যকে হতবিহবল করে দিয়েছে হামাস যোদ্ধারা। এই নাটকীয় ১০ ঘণ্টা এই অঞ্চলের জন্য সমীকরণ বদলে দিয়েছে। ফিলিস্তিনি ও ইসরাইল উভয়ের সামরিক ও রাজনৈতিক হিসাব বদলে দিয়েছে এ হামলার ঘটনা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে নাকি ইসরাইলকে শত্রু গণ্য করবে, তা নিয়ে এখন নতুন করে চিন্তা করতে হবে তাদের।
মাত্র কয়েকদিন আগেই ইসরাইলের কট্টরপন্থি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে দম্ভ করে বলেছিলেন, ইসরাইল ও তার নতুন আরব অংশিদারদের কেন্দ্র করে একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ে উঠবে। তিনি তার এই আঞ্চলিক ম্যাপ থেকে ফিলিস্তিনিদের নাম-নিশানা মুছে ফেলেছিলেন। কিন্তু হামাসের হামলার মাধ্যমে নেতানিয়াহু ও ইসরাইলকে রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে একটি দাতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে যোদ্ধারা।
ইসরাইল যে অজেয় কোন সামরিক শক্তি নয় তা সুস্পষ্টভাবে প্রমান করে দিয়েছে হামাস। তাদের হামলার ভয়ে ইসরাইলের শহর ও গ্রামগুলোর থেকে শত শত মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে- স্যোসাল মিডিয়ায় প্রচারিত এই দৃশ্য বহুদিন ইসরাইলকে তাড়া করে ফিরবে বলে মনে করেন মারওয়ান বিশারা।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, হামাসের এবারের অভিযানের লক্ষ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। দখলদারিত্ব, হত্যা-নির্যাতন, ধরে নিয়ে কারাগারে বছরের পর বছর আটকে রাখা, ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে অবৈধ বসতি নির্মান এবং জেরুসালেমে পবিত্র আল আকসা মসজিদের অবমাননার জন্য ইসরাইলকে শাস্তি দেয়া।
একই সাথে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য উদ্যোগি আরব দেশগুলোকে একটি সতর্কবার্তা দেয়া। সবশেষ- আরেকটি বন্দি বিনিময় চুক্তি করা। বিশেষ করে যত বেশি সম্ভব ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করা। নিজেদের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে হামাসের শর্ত মেনে নিতে হবে বলে মনে করেন মারওয়ান বিশারা।