হাসিনার মাফিয়া পুলিশ

 আমার দেশ
১৯ মার্চ ২০২৩

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

মাহমুুদুর রহমান

শেখ হাসিনার পৈত্রিক জেলা গোপালগঞ্জের মোট জনসংখ্যা ১১ লাখ সত্তর হাজারের কাছাকাছি। মুসলমানের সংখ্যা সাত লাখ আশি হাজার, হিন্দু জনগোষ্ঠী ৩ লাখ ৭১ হাজার। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মিলে এই জেলায় সংখ্যালঘুর হার বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে অধিক, প্রায় ৩৩ শতাংশ। এই মুহূর্তে আমার কাছে পুরো দেশের জেলাওয়ারি সর্বশেষ জনসংখ্যার পরিসংখ্যান নাই। কাজেই জনসংখ্যার হারে গোপালগঞ্জের চেয়ে অধিক হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস বাংলাদেশের অন্য কোন জেলায় আছে কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। থাকতেও পারে। তবে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছাড়াও একটি বিশেষ সরকারী চাকরিতে গোপালগঞ্জ যে অনেক আগেই এক নম্বরে পৌঁছে গেছে, সেটি অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে বেশ আলোচনার খোরাক। বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলি।

২০১০ সালের জুনের আট তারিখে জীবনে প্রথমবারের মত পুলিশ রিমান্ডের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সন্ধ্যার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের গারদ থেকে পুরনো ঢাকার কোতোয়ালি থানায় গেলাম। রাত নয়টা পর্যন্ত একাই অপরিষ্কার এক গারদে মাটিতে বসে ছিলাম। তারপর ওসির ঘর থেকে ডাক এলো। ওসি ব্যক্তিটি তখনও আসেন নাই। সেকেন্ড অফিসার জানালো তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। চেয়ারে বসতে দিল, টুকটাক কথা হলো, আপাত:ভদ্র অফিসারটির নাম ভুলে গেছি। এমন সময় পুরো থানা যেন রাজার আগমনের অপেক্ষায় ভয়ে কম্পমান হয়ে পড়লো। টিশার্ট আর জিন্স পরিহিত রাজা এলেন। আমার দিকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ও রাগত দৃষ্টি হেনে আপন আসনে বসে জানালেন তার নাম সালাহ উদ্দিন। তার বাড়ি যে গোপালগঞ্জ সেটাও অহমিকার সাথে বললেন। তারপর এক তরফা বি এন পি সরকারের বিরুদ্ধে মিনিট দশেকের বিষোদগারের মধ্যে তিনটি কথা আমার খুব মনে পড়ে।

১। গোপালগঞ্জের অফিসাররা শুধু রাজধানীতে কেন, সারা দেশে পুলিশে রাজত্ব করবে তাতে কার কি বলার আছে?

২। আপার (শেখ হাসিনা) সাথে তার সার্বক্ষণিক সরাসরি যোগাযোগ থাকে।

৩। এক রাতের রিমান্ডে আমাকে তার ঘরেই কাটাতে দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও উপরের নির্দেশে গারদেই পাঠাতে হচ্ছে। এক কাপ চা দিলেও উপরের নির্দেশে কিনা জানিনা কাপ শেষ না হতেই সঙ্গের কনস্টেবল আমাকে গারদে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ফিরে গিয়ে দেখেছিলাম, এত অল্প সময়ের মধ্যে কোন্ এক পুলিশি ম্যাজিকে, নির্জন গারদে নানা কিসিমের এত বন্দি আনা হয়েছে যে, আমাকে জায়গার অভাবে সারারাত দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়েছিল। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে একটা অপরিষ্কার ঘর হলেও যে এত পুঁতিগন্ধময় হতে পারে সেটাও আমার ধারনায় ছিল না। বিষ্ঠা ও মূত্রে নরক বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। শারীরিক লাঞ্ছনা না দিয়েও কত অসহনীয় মানসিক এবং শারীরিক, উভয় কষ্ট দেয়া যায় তার সম্যক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ওসি সালাহ উদ্দিনের থানা থেকে পরদিন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে জ্যান্ত ফিরেছিলাম। তখনও জানতাম না যে, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট থানায় আসলেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে।

ব্যক্তিগত আলোচনার এখানেই ইতি। উপরের প্রসঙ্গটি এনেছিলাম কারণ কাহিনীর প্রধান চরিত্রে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ব্যক্তিগত খুনি পুলিশ বাহিনীর এক ভয়ানক, মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের গল্প বলতে চেয়েছিলাম। এই সালাহ উদ্দিনের এক হতভাগ্যকে ক্রসফায়ারে একশ গুলি করে মারারও ইতিহাস রয়েছে। কয়েকটা গুলি করে মেরে তার নাকি মন ভরতো না। আর থানায় নিয়ে টর্চার? এমন কোন নৃশংস পদ্ধতি নাই যা ব্যবহার করে সালাহ উদ্দিন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পুলিশ হেফাজতে টর্চার করে নাই।

বাংলাদেশের মাফিয়া পুলিশের দুর্গন্ধ এখন আর কেবল রাষ্ট্রীয় সীমানায় আটকে নেই। সেই দুর্গন্ধ ভারত, দুবাই, কানাডা, ইউরোপ, আমেরিকা, সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বাড়িও সেই গোপালগঞ্জেই। বেনজীর গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে মার্কিন স্যাংকশনপ্রাপ্ত। দুবাইতে গোপালগঞ্জের কোন এক আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, রীতিমত বটগাছ হওয়া সন্ত্রাসীর বিপুল সম্পদের সাথে বেনজীরের নাম কদিন ধরে মুখে মুখে উচ্চারিত। বাংলাদেশের বর্তমান পুলিশ প্রধানও একই অপরাধে মার্কিন স্যাংকশনপ্রাপ্ত। তিনি অবশ্য বেনজীরের মত গোপালগঞ্জের কোন স্পেশ্যাল সন্তান নন। অন্য কোন জেলার বাসিন্দা। বাংলাদেশে যেখানেই এখন নোংরা ঘাটতে যাবেন সেখানেই পুলিশের পোষাকে হাসিনার খুনিদের সম্পৃক্ততা মিলবে।

এই গতকাল কে এক মহা বিতর্কিত সিনেমার নায়িকাকে (অসভ্য সাবেক মন্ত্রি মুরাদ সংশ্লিষ্ট) নিয়ে বিমান বন্দর, থানা, পুলিশ, আদালত, জেলখানায় সারাদিন ধরে নাটক চলেছে। কারাগারে যাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জামিনের ব্যবস্থা করার মত ক্ষমতার অধিকারী সেই অভিনেত্রীর বক্তব্য থেকেও নাম এসেছে হাসিনার আর এক অতি ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, মোল্যা নজরুল ইসলামের। শোনা কথা যে, নজরুলের বাড়িও নাকি গোপালগঞ্জেই। এক সময়ের মহা ক্ষমতাধর ডিবি পুলিশ প্রধান, মোল্যা নজরুল এখন গাজীপুর মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার। বছর দশেক আগে তার বিরুদ্ধে এক লোকের কাছ থেকে রীতিমত পুলিশের দলবল সাথে নিয়ে ব্যাংক থেকে ৭৫ লাখ টাকা মেরে দেয়ার অভিযোগ ছিল। মোল্যা নজরুলের দেশের বাড়ির বিষয়ে আমি নিশ্চিত না হলেও, পুলিশের আর এক মহা ক্ষমতাবান ব্যক্তি মনিরুল ইসলাম যে বাংলাদেশের অঘোষিত রাজপরিবার, শেখদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ থেকেই এসেছে এ বিষয়ে আমি শত ভাগ নিশ্চিত। মনিরুল ইসলামের বর্তমান দায়িত্ব হলো বাংলাদেশে সব ভুয়া ইসলামী জঙ্গী দল আবিষ্কার এবং শেখ হাসিনার নির্দেশ পেলে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের জঙ্গী সাজিয়ে এনকাউন্টারে হত্যা করা। মানতেই হবে, আজ থেকে তেরো বছর আগে ওসি সালাহ উদ্দিন আমার কাছে মিথ্যা দম্ভ করে নাই। প্রকৃতপক্ষেই গোপালগঞ্জ বাংলাদেশ পুলিশের উপর রাজত্ব করছে।

চলচ্চিত্র নায়িকাদের সাথে হাসিনার মাফিয়া পুলিশের সংশ্লেষ কোন নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও আর এক বিতর্কিত নায়িকার বহুল আলোচিত ঘটনাতেও তৎকালিন আইজিপি বেনজির এবং বর্তমানে ডিবি পুলিশ প্রধান, হাসিনার আর এক ব্যক্তিগত খুনি, হারুনের নাম এসেছিল। এই হারুন নারায়নগঞ্জের পুলিশ কমিশনার থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত জিঘাংষা মেটানোর জন্য আইন ও এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে গুলশানে তার ফোর্স নিয়ে এসে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের এক পুত্রবধু এবং নাতিকে বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। দেশে বিন্দুমাত্র আইনের শাসন থাকলে হারুনের চাকরী থাকার কথা ছিল না। কিন্তু, হারুনের মাথার উপর হাসিনার হাতের সাথে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হাতও ছিল। আবদুল হামিদ এবং হারুন কেবল যে একই জেলার বাসিন্দা তাই নয়, শোনা যায়, জাতীয় জোকারের ভেক ধরা সর্ব দিক দিয়ে চূড়ান্ত অসৎ, আবদুল হামিদের দুর্নীতিলব্ধ, বিশাল সম্পত্তি, ব্যবসা ইত্যাদি ডিবি হারুনই দেখভাল করে থাকে। তাছাড়া, বিএনপির সাবেক চীফ হুইপ জয়নাল আবেদিনের প্রকাশ্যে মাথা ফাটিয়ে হারুনের লাইমলাইটে আসার ঘটনা তো বাংলাদেশের সবাই জানেন।

উপরোক্ত ঘটনায় হারুনের সাথে তৎকালিন এসি বিপ্লব সরকারও লাইমলাইটে এসেছিল। বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল পত্রিকা প্রথম আলো-ডেইলি স্টার আবার এই বিপ্লবের মহা প্রমোটার। নব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর দেশটিকে হিন্দুত্ববাদিদের হাতে তুলে দেওয়ার কলকাঠি পত্রিকাদ্বয় জন্মলগ্ন থেকেই নেড়ে চলেছে। সুতরাং, হিন্দুত্ববাদের এদেশিয় এজেন্ট বিপ্লবের সাথে প্রথম আলো গোষ্ঠীর মাখামাখি থাকাই স্বাভাবিক। গত বছর ৭ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপি’র প্রধান অফিসে পুলিশি অভিযান পরিচালনায় বিপ্লব সরকারই নেতৃত্ব দিয়েছিল। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিল এসপি মেহেদি। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মাফিয়া পুলিশের একটি বড় অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুল সম্পত্তি ও নগদ অর্থ প্রেরণ করে ইতোমধ্যে হয় নাগরিকত্ব অথবা বসবাস করবার অনুমতির ব্যবস্থা করেছে। পুলিশের সকল পর্যায়ে প্রচার রয়েছে যে, হারুন এবং বিপ্লব, উভয়ের পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। মোট কথা, বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে এক ব্যক্তি ও পরিবারের লাঠিয়ালে পরিণত হয়েছে। এদের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে ভয়ানক দুর্নীতি ও পাপাচার ক্যান্সারের মত বিস্তার লাভ করেছে। এদেরকে সমূলে বিনাশ না করলে জাতির মুক্তি নাই। জনগণের বিজয়ের মুহূর্তে এরা যেন পালাতে না পারে সেজন্য সবাই এখন থেকেই সজাগ থাকুন।

লেখক-সম্পাদক, আমার দেশ
১৯-০৩-২০২৩