হাসিনার ‘ট্রাম্প কার্ড’ ষড়যন্ত্র

রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার যে রক্ত ঝরিয়েছেন, ঢাকাসহ সারা দেশের রাজপথ যেভাবে রক্তে রঞ্জিত করেছে, সে ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনো মুঁছে যায়নি। মহানগরীর সড়ক ও বিল্ডিংয়ের দেয়ালে দেয়ালে এখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। আহতরা হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। সেই গণহত্যার রক্তের দাগ শুকানোর আগেই পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনা একের পর এক হুমকি দিচ্ছেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতাড়িত করার হুমকি দিচ্ছেন। মোদি কার্ড ষড়যন্ত্রের ব্যর্থ হওয়ার পর এবার হাসিনা ‘ট্রাম্প কার্ড’ ছুড়ছেন।

১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এই হুমকি দেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতের খুঁটির জোরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। হাসিনার ষড়যন্ত্র ও হুমকিতেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ‘নাকে সর্ষের তেল’ দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছেÑ হাসিনা কী ঘটাবেন আজ ১০ নভেম্বর? নরেন্দ্র মোদির ‘নাচের পুতুল’ হাসিনা কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে কোনো অঘটন ঘটাতে চাচ্ছেন? কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া শেখ হাসিনার অডিও বার্তায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলে অস্ত্র রয়েছে সে খোঁজখবর নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাসিনা বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলের কোথায় অস্ত্র রাখে খবর নাও। অস্ত্র উদ্ধারে হলে হলে সার্চ করানো হবে। আমি সেনাবাহিনী দিয়ে সার্চ করাব। দু-একটি অস্ত্র পেলেই হয়।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। আগে থেকেই বিদেশে নিরাপদে ছিল তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। কয়েকশ সাবেক মন্ত্রী এমপি ও হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকে বিপদে ফেলে পালিয়ে যাওয়ায় বিপদগ্রস্ত নেতারা হাসিনাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমা দিয়েছেন। গণহত্যার মাধ্যমে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে পালিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যত রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটে গেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের চাঙ্গা করতে নানা কথাবার্তা বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। ভারতের সহায়তায় হাসিনার অলিগার্করা এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসিনা এ কাজে ১৫ বছরের তৈরি প্রশাসনে দলদাস কর্মকর্তাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা যেন ‘ক্ষমতার চেয়ার’ পেয়ে দিবানিদ্রায় গেছেন। হাসিনা একের পর এক ষড়যন্ত্র করছেন, বিভিন্ন এঙ্গেলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তারপরও উপদেষ্টাদের যেন হুঁশ হচ্ছে না। পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন, র‌্যাব, বিজিবি সর্বত্রই হাসিনার সেবাদাস কর্মকর্তারা এখন বকধার্মিক। ছাত্র-জনতার চাপে হাসিনার ‘একান্ত অনুগত দলদাস’ কিছু কর্মকর্তাকে বদলি, বাধ্যতামূলক অবসর দিলেও প্রশাসনযন্ত্রের চাবি এখনো হাসিনা অনুগত আমলাদের হাতেই। ভারতে থেকে হাসিনা তাদের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করতে চাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা লিখেছেন, ‘সিভিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তাকে ‘নির্বাচনী সার্কাসে’ ব্যবহার করে বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বানিয়েছেন। বৈধ-অবৈধভাবে তাদের টাকা কামানোর ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। তারা শেখ হাসিনাকে প্রতিদান দেয়ার লক্ষ্যে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।

৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই দাবি উঠেছিল শেখ হাসিনার অনুগত সরকারি আমলা-পুলিশের বিতর্কিত কর্মকর্তাসহ অন্যান্য বাহিনীর হাসিনা অনুগতদের বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে তাদের অপকর্ম জনসম্মুখে উন্মোচন করা হোক। পাশাপাশি যাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে এবং যারা ১৫ বছর হাসিনার দাস-দাসী হিসেবে অনৈতিকতা ও মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করেছেন তাদের গ্রেফতার করতে হবে। এ দাবিতে আন্দোলন করা হয়। বাস্তবতা সরকারের মধ্যে তেমন কিছু দেখা যায়নি; বরং কয়েকজন আমলাকে রদবদল এবং কয়েক জেলায় ডিসি নিয়োগে টাকার খেলার অভিযোগ ওঠে। ফলে হাসিনার দাস-দাসীরা প্রশাসনে থেকে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। অথচ উপদেষ্টারা কেউ এনজিও স্টাইলে, কেউ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম কেউবা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো অহিংস নীতিতে অগ্রসর হচ্ছেন। হোমিও প্যাথি স্টাইলে প্রশাসন চালাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। দীর্ঘ তিন মাসেও তিনি পুলিশ প্রশাসনকে গতিশীল করতে পারেননি। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী পিলখানায় সেনা হত্যাকাণ্ড ও শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডের নতুন তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেননি। এমনকি যে সব পুলিশ কর্মকর্তা বিতর্কিত এবং যাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি; বরং বিতর্কিত কর্মকর্তাদের কৌশলে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন একজন সাবেক আমলা। তিনি জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। দিল্লিতে বসে মাদার অব মাফিয়া হাসিনা একের পর এক ষড়যন্ত্র করছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছেন। অথচ প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। ভারতের একজন ছিঁচকে চোর বাংলাদেশের আশ্রয়ে থাকলে ভারত অভিযোগ তোলে বাংলাদেশ সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। অথচ হাসিনার মতো খুনি, গণহত্যাকারীকে দিল্লি আশ্রয় দিলেও পররাষ্ট্র সচিব নীরব দর্শক। এমনকি বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম ও হাসিনা বিদেশের বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালালেও বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশন ও দূসাবাসগুলোর মাধ্যমে পাল্টা প্রচারণা ও প্রতিবাদ করা হয়নি। যার পরিণতি সুইজারল্যান্ডে আইন বিচার ও সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে আওয়ামী চক্রের হাতে হেনস্তা হতে হয়।

বাংলাদেশ নিয়ে হাসিনা ঘোটপাকাচ্ছে অথচ অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে রয়েছে। সরকারের ভেতরে ও বাইরে থাকা আওয়ামী আমলা, বুদ্ধিজীবী, সুশীলরা সংস্কারের নামে অন্তর্বর্তী সরকারকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রেখে রাজনৈতিভাবে মৃত আওয়ামী লীগকে জাগিয়ে তুলতে চায়। দিল্লিতে বসেই হাসিনা যাতে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে সময় পান সে লক্ষ্যে ‘সংস্কার’ চিৎকার করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আওয়ামী আদর্শের বিপরীতমুখী জামায়াত। তারাও দিল্লির অ্যাজেন্ডায় সংস্কারের নির্বাচন ইস্যুতে সময়ক্ষেপণ করার পক্ষে। শুধু তাই নয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সংসদে আনতে ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন’ পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভারতের এ নীল নকশা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের তাঁবেদাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। অনুগত সাংবাদিক, কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মাধ্যমে তথাকথিত জরিপের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতের জনসমর্থনকে সমান করে দেখাতে মনগড়া তথ্য প্রচার করছে। হাসিনার অনুগত কিছু গণমাধ্যম দিল্লির অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী একদিকে সংস্কারের প্রতি জোর দিচ্ছে; অন্যদিকে বিএনপিকে পতিত আওয়ামী লীগের মতো সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ তকমা দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে। ধূরন্ধর হাসিনার দুরভিসন্ধি টের পেয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে হাসিনার কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না।’ কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সারা বিশ্বে তার অনুসারী ও বন্ধু রয়েছে। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে সেটি দেখা গেছে। তাকে সহায়তার জন্য বিশ্বের বহু দেশ ও সংস্থা আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনকে হাসিনার অনুসারীমুক্ত করা এবং বিভিন্ন বাহিনীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তিনি ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছেন। এতে করে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার সর্বশেষ যে অডিও বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, সেখানে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে কর্মীদের মাঠ নামতে বলেছেন, পুলিশ পেটালে যাতে ট্রাম্পের ছবির ওপর পেটায় এবং ভিডিও করে ছবি তুলে মার্কিন প্রশাসনের পাঠানোর কথা বলেছেন; হাসিনা সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বৈরাচার হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ড. ইউনূস জুলাই-আগস্ট গণহত্যা করেছেন এবং কয়েকশ পুলিশ হত্যা করেছেন। অতএব দিল্লিতে মোদির হেফাজতে থাকা হাসিনার কোনো ষড়যন্ত্র সফল হলে তার দায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস এড়াতে পারবেন না। ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা ও সহনশীলতা দিয়ে হাসিনার মতো মাদার অব মাফিয়াকে মোকাবিলা কোনো কাজের কথা নয়। সাপকে যতই দুধকলা দিয়ে পোষ মানানো হোক, সুযোগ পেলে সে ছোঁবল দেবেই। লোকলজ্জা-চক্ষুলজ্জার কারণে হাসিনার দোসরদের প্রশাসনে রাখলে সুযোগ পেলেই তারা ছোঁবল দেবে। তখন আর আফসোস করে লাভ হবে না।

তবে শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গতকাল ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘গণহত্যাকারী ও নিষিদ্ধ সংগঠনের কেউ কর্মসূচি করার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’

inqilab

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here