হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে রোগীদের মৃত্যু, কী বলছে কর্তৃপক্ষ


সাতক্ষীরা ও খুলনার পর এবার বগুড়ায় করোনা হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে করোনায় আক্রান্ত তথা কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অক্সিজেনের অভাবে কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। এর মধ্যে বগুড়ায় একটি সরকারি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার রাত থকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টায় সাতজন মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন। তবে সাতক্ষীরা ও খুলনার ঘটনা স্বাস্থ্য অধিদফতর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে।

করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর সাতক্ষীরা, খুলনা ও বগুড়ায় করোনা হাসপাতালে ভর্তি হয়েও অক্সিজেনের অভাবে বেশ কয়েকজন মারা গেছে বলে জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা।

সাতক্ষীরার শাহজাহান আলী বলেন, ‘আমার সামনে ১০ মিনিটের মধ্যে তিনজন মারা যায়। আমার শাশুড়ির অবস্থা এর মধ্যে খারাপ হয়ে যায়।’ সাতক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সঙ্কটে বুধবার সন্ধ্যার পর সাত রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কিন্তু দেশের কোথাও অক্সিজেনের ঘাটতি থাকতে পারে বলে মনে করেন না স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র সুহাস চন্দ্র হালদার বলেন, আমাদের কোনো রোগী এখন পর্যন্ত অক্সিজেন ছাড়া ছিল না, এখনো থাকবে না।

সাতক্ষীরায় তদন্ত কমিটি
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরায় অক্সিজেনের অভাবে সাতজন মারা গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে নাজমা খাতুন একজন। শুধু কোভিড চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর তিনি মারা যান। তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শাহজাহান আলী ওই সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন।

শাহজাহান আলী জানান, তার শাশুড়ি ভর্তি ছিল হাসপাতালে, যার দেখাশোনা তিনি করছিলেন। হঠাৎ ফোন পেলেন যে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে লোক মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি দ্রুত চলে যাই হাসপাতালে। যেয়ে দেখি অক্সিজেনের ফ্লো কমে একদম নেমে গেছে। আমার সামনে ১০ মিনিটের মধ্যে তিনজন মারা যায়। এর এক ঘণ্টা পরে অক্সিজেনের একটা ট্রাক আসে। আমার শাশুড়ির অবস্থা এর মধ্যে খারাপ হয়ে যায়। পরে যখন তাকে আবার অক্সিজেন দেয়া হয় ততক্ষণে তিনি মারা যান।’

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হুসেইন সাফায়াত বলছেন, এই ঘটনায় দু’টি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। একটা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে, অপরটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে।

খুলনা শহরে কী অবস্থা?
এদিকে দেশে এখন মৃত্যুর সংখ্যা যে শহরে সবচেয়ে বেশি তা খুলনায়। সেখানে কোভিড চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালেও এখন অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে বলে রোগীর পরিবার অভিযোগ করেছেন।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাবাকে করোনার চিকিৎসা করাতে যান মোহাম্মদ শহীদুল। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার অক্সিজেনের অভাব প্রকট আকার ধারণ করায় তার বাবার বেঁচে থাকা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়। এদিন আমি ৮০ ভাগ আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম আমার আব্বা হয়ত বাঁচবে না।

তিনি একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছ থেকে একটা সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালের সিলিন্ডার আসে দুপুর ২টার দিকে। সারাদিন একটা সঙ্কট লেগেই আছে।

তবে হাসপাতালটির মুখপাত্র সুহাস চন্দ্র হালদার বলেন, খুলনার কোভিড চিকিৎসার নির্ধারিত এই হাসপাতালে কোনো প্রকার অক্সিজেনের স্বল্পতা নেই। আমাদের কোনো রোগী এ পর্যন্ত অক্সিজেন ছাড়া ছিল না, এখনো থাকবে না। আমাদের সেই পরিমাণ অক্সিজেন মজুদ আছে।

সুহাস চন্দ্র হালদার বলেন, হাসপাতালে ১৩০ শয্যার বিপরীতে ২০৪ জন রোগী আছে, যাদের অনেককে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। যদি কোনো রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন হয় তাহলে একটা সিলিন্ডার খুলে আরেকটা সেট করতে দুই-তিন মিনিট লাগতে পারে। এছাড়া আমাদের কখনোই অক্সিজেন ঘাটতি হয় না।

বগুড়ায় বড় সঙ্কটের আভাস
এদিকে বগুড়ায় কোভিড চিকিৎসার নির্ধারিত মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে শুক্রবার সকালে একজন অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন বলে মৃত ছেলে অভিযোগ করেছেন।

মোস্তাক আলী নামে ওই ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, তার বাবা শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মারা যান চরম শ্বাসকষ্ট ও অক্সিজেনের অভাবে। কিন্তু হাসপাতালের হাসপাতালের পরিচালক এটিএম নুরুজ্জামান অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘অক্সিজেনের অভাবে কেউ মারা যায়নি।’ শুক্রবার বিকেলে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজন মারা গেছে। এই তথ্য তারা স্বাস্থ্য অধিদফতরকেও জানিয়েছেন।

যদিও বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শফিক আমিন কাজল নয়া দিগন্তকে জানান, হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ চালু হলেও সবগুলো শয্যায় উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা এখনো যুক্ত হয়নি। এমনকি আট শয্যা নিয়ে চালু করা আইসিইউ ইউনিটেরও মাত্র দু’টিতে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে। ফলে পুরো হাসপাতালের মধ্যে আইসিইউ ইউনিটের ওই দু’টি শয্যায় কেবল উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সররবরাহ করা সম্ভব। এর বাইরে ভর্তি দুই শতাধিক রোগীকে হয় ফেস মাস্ক অথবা রিব্রিদার মাস্ক দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হচ্ছে।

ডা: কাজল বলেন, ফেস মাস্ক দিয়ে একজন করোনা রোগীকে প্রতি মিনিটে মাত্র পাঁচ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব। অন্য দিকে রিব্রিদার মাস্ক দিয়ে প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। আর হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে একজন রোগীকে প্রতি মিনিটে ৬০ লিটার অক্সিজেন দেয়া যায়। তিনি বলেন, যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০-এর ওপরে কেবল তাদের ফেস মাস্ক দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করে সুস্থ্য করে তোলা সম্ভব। আর যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০-এর নিচে কিন্তু ৮৭-এর ওপরে তাদের রিব্রিদার মাস্ক দিয়ে সুস্থ্য করে তোলা যায়। তবে যাদের অক্সিজেনের মাত্রা ৮৭-এর নিচে তাদের জন্য অবশ্যই উচ্চ মাত্রার অর্থাৎ হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাযুক্ত অক্সিজেন প্রয়োজন। তাছাড়া তাদের বাঁচানো কঠিন।

অক্সিজেন সঙ্কটে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা
২০০ শয্যার ওই হাসপাতালে শুক্রবার সকালে ২২৩ জন রোগী ভর্তির তথ্য দিয়ে ডা: কাজল বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালে এখন যেসব রোগী আসছেন তাদের বেশিরভাগেরই অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬০ থেকে ৭২-এর মধ্যে। তাদের হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের হাসপাতালে শুধু আইসিইউ ইউনিটের দু’টি শয্যায় ওই ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে দু’শতাধিক রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অক্সিজেন সঙ্কটের কারণে বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আরো অন্তত ১০ জনের অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন।’

‘দেশে অক্সিজেনের ঘাটতি নেই’
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন বলেছেন, দেশে এখন যে পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন করা হচ্ছে সে অনুপাতে চাহিদা এখনো তৈরি হয়নি। সে হিসেবে বলা যাবে না যে দেশে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিদিন দেশে ১৯০ টন অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা তো ১৯০ টন না। আর সব রোগীর যে অক্সিজেন লাগবে সেটাও না। তিনি আরো বলেন, একটা হাসপাতালে কয়টা সিলিন্ডার ও কয়টা সেন্ট্রাল লাইন আছে সেটা হিসাব করে যদি একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে দেয়া হয়, সেটা ভুল হবে।

সূত্র : বিবিসি ও নয়া দিগন্ত সংবাদদাতা