হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে বিপদে চীন ও ভারত

ফয়সাল আল-ইয়াফি :

গত সপ্তাহে হামাস যোদ্ধারা হঠাৎ যখন গাজা সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে হামলা করছিল, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের একদল সিনেটর বেইজিং সফরে ছিলেন। এ সংঘাতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বিবৃতি দেন, সেখানে পরিষ্কারভাবে বেইজিংয়ের নিরপেক্ষ অবস্থান প্রকাশ পায়। বিবৃতিতে দুই পক্ষের সংযত আচরণ ও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়।

বেইজিং সফররত সিনেটরদের নেতৃত্বে ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির চাক শুমেখার। চীনে অবস্থানকালেই তিনি বেইজিংয়ের বিবৃতির সমালোচনা করে বললেন, তিনি আশা করেছিলেন হামাসকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানাবে চীন।

চীন এই সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই সমালোচনা সেই কঠিন বাস্তবতাকে সামনে এনেছে, মধ্যপ্রাচ্যে এশিয়ার যে বড় দেশগুলো প্রভাব বিস্তারকারীর ভূমিকায় আসতে চাইছে, তাদের সামনে রাজনৈতিক বাধাটা অনেক শক্তভাবেই রয়ে গেছে।

এশিয়ার শক্তিশালী দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে ঈর্ষার চোখে দেখে এবং তারা সেই প্রভাবে একটু কামড় বসাতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ইসরায়েল এখন যেভাবে যুদ্ধের উন্মাদনা দেখাচ্ছে, তাতে করে সেখানে এশিয়ার শক্তিধর দেশগুলোর পক্ষে প্রভাব তৈরি করা কঠিন।

চীনের কূটনীতির কথা ধরা যাক। বেইজিং একটা ভারসাম্য বজায় রাখার কঠিন নীতি নিয়েছে। বেইজিং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক গভীর করে চলেছে। জুন মাসে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস চীন সফর করেন। আর ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এ বছরের শেষে চীন সফর করার কথা রয়েছে।

ভারতের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের সঙ্গে দিল্লির শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। চীন ও ভারত দুই দেশই এখন ‘দূরে থেকে জেতার’ নীতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক অর্জন করতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের মারপ্যাঁচ থেকে তারা নিজেদের দূরে রাখতে চেয়েছে।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন সংঘাতে ভারত ও চীন দুই দেশই এখন ‘টান টান দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার’ মতো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে তাদের এই ভারসাম্য বজায় রাখার কূটনীতি বজায় রাখা কঠিন হবে।

ভারতের চেয়ে চীনের কূটনৈতিক পথ আরও কঠিন হবে। এর কারণ হলো, চীন নিজেদের বিশ্বের পরবর্তী পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং প্রমাণ করতে চায় যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তাদের কূটনীতি ভিন্ন। কিন্তু চীনের এই চিন্তার সামনে বিস্তর চ্যালেঞ্জ আছে।

পরাশক্তি হিসেবে চীন যদি নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে কোনো একটা দেশে হস্তক্ষেপ করার মতো সামর্থ্য তাদের থাকতে হবে। কিংবা কমপক্ষে এটা প্রমাণ করতে হবে যে অন্য একটা দেশের রাজনৈতিক বিন্যাস বদলে দেওয়ার সামর্থ্য তাদের আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে তাদের নীতির পার্থক্য তৈরি করতে হলে চীনকে আরও সূক্ষ্ম কূটনীতি গ্রহণ করতে হবে। কেননা হামাসের হাতে ইসরায়েলিদের অপহরণের ছবি ও ভিডিও এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে।

হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে এখন পর্যন্ত চীন তাদের নিরপেক্ষতা নীতি পরিষ্কারভাবে বজায় রাখতে পেরেছে। কিন্তু ইসরায়েল স্থলযুদ্ধ শুরু করলে সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

ইসরায়েলি শিবির ও পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থানকে সমর্থন করলে সমালোচিত হবে চীন। আবার ফিলিস্তিনকে যদি সমর্থন করে, তাহলে কার্যত হামাস যোদ্ধাদের সমর্থন দেওয়ার জন্য তারা সমালোচিত হবে। নিরপেক্ষতার নীতি অনেক বিকল্প সম্ভাবনাকে বাদ দিয়ে দেয়।

হামাস-ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধের পুরো পরিস্থিতি বেইজিংয়ের জন্য অপ্রত্যাশিত ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। এ বছরের শুরুর দিকে সৌদি আরব-ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মধ্যস্থতা করে বেইজিং একটা মিথ্যা নিরাপত্তার বোধের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন রয়েছে। সৌদি আরব ও ইরানের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা সম্ভব হয়েছে তার কারণ হলো, দুই দেশই সম্পর্কের উন্নয়ন চেয়েছে। কিন্তু হামাস ও ইসরায়েলের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি পুরোটাই ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরেই তারা পরস্পরের শত্রু। এখন দুই পক্ষ যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছে।

জুন মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এর মানে এই নয় যে চীন ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করেছে অথবা হামাসকে দোষারোপ করছে। এর বদলে আরও গ্রহণযোগ্য বিষয় শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান ছিল এই আলিঙ্গনে।

শুধু মাহমুদ আব্বাসই নন, মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিং যে আরও মিত্রের সন্ধানে রয়েছে, তার প্রমাণ হলো গত মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সফরে যান বেইজিং। সিরিয়ার সীমান্তের বাইরে আসাদের এ ধরনের সফর নজিরবিহীন।

যাহোক, এ ক্ষেত্রেও সংঘাত থেকে বাস্তবতা অনেক অনেক দূরে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সিরিয়ার আসাদ সরকারকে যতই বিনিয়োগের প্রস্তাব দিক আর যতই বলুক না কেন দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্কে পৌঁছে গেছে, গাজা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আর সেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে বেইজিং সিরিয়ার পক্ষে অবস্থান নেবে।

ভারতের ক্ষেত্রেও তাদের ভারসাম্যমূলক কূটনীতি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ইসরায়েল যদি স্থল অভিযান শুরু করে এবং তাতে গাজায় মানবিক সংকট যদি তীব্র রূপ নেয়, তখন ভারত কতটা নিরপেক্ষ কূটনীতি বজায় রাখতে পারবে, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ ব্যাপার। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিজের দেশে জনমত বাড়তে থকবে এবং আরব বিশ্বে যেখানে ভারতের বিশালসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক আছেন, সেখানে ভারত সরকারের সমালোচনা তীব্র হবে, তাতে করে মোদির বর্তমান নীতি চাপে পড়বে।

আরেকটি বিষয় এখানে বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভারত তাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই ধারণা মেনে চলে যে লম্বা সময় ধরে চলা কোনো সংঘাতের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে।

এবারের জি-২০ সম্মেলনে ইউরোপ, ভারত ও আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য করিডর করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। মোদি বলেন, এই প্রকল্প শত শত বছর ধরে চলা বিশ্ববাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতে সেই প্রকল্প বড় ধরনের বাধার মুখে পড়ল। কেননা এই বাণিজ্য করিডরের জন্য সৌদি আরব ও ইসরায়েলের ভালো সম্পর্ক প্রয়োজন। দীর্ঘ যুদ্ধ হলে সেই প্রকল্প বিপদে পড়বে।

এটাই এশিয়ার বড় শক্তিগুলোর উভয় সংকট। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে গেলে করমর্দনের চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন। রাজনীতিতে তাদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।

চীনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ভারতের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা—এ বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্যে চীন ও ভারত যদি মধ্যপ্রাচ্যে শক্তভাবে তাদের পা রাখতে চায়, তাহলে বৈশ্বিক পরিসরে শক্তি দেখানোর মতো সক্ষমতা তাদের অর্জন করতে হবে।

  • ফয়সাল আল-ইয়াফি মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বইয়ের লেখক; বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষক
প্রথম আলো