হামাসের হামলায় মুহূর্তে পালটে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি

প্যাট্রিক উইন্টুর : হামাসের ভয়াবহ রকেট হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতির চিত্রই বদলে গেছে। একদিকে যখন মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে বহুগুণ, তখন হামাসের হামলা পরিকল্পনার জন্য তেহরানের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে ইসরাইল। এই হামলার জন্ম হয়তো ক্ষোভ থেকে। বিশেষ করে আল-আকসা মসজিদে উস্কানিসহ কয়েক মাস বয়সী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়ুহুর জোটের আচরণের কারণে এই ক্ষোভ।
  আবার ইরান দীর্ঘদিন ধরে হামাসকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তারা এর মাধ্যমে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করাকে ভণ্ডুল করে দিতে চায় ইরান। কারণ সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরও জোরালোভাবে প্রবেশ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের লক্ষ্যই এ অঞ্চলকে অস্বাভাবিক করা। তারা ইসরাইলের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসা সৌদি আরবের জন্য প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। পক্ষান্তরে ইসরাইল চাইছে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংকট কূটনৈতিকভাবে কমিয়ে আনতে। এতে করে ফিলিস্তিন ইস্যু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
কাতারের মাধ্যমে গাজায় সহায়তা পৌছানো ইসরাইলের এই কৌশলের একটি অংশ। এই সপ্তাহের শুরুর দিকে একটি বক্তৃতায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি রিয়াদকে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, কোনও উপসাগরীয় রাষ্ট্র যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে তারা ভুল পক্ষকে সমর্থন করছে। যেসব দেশ ইহুদিবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের ঝুঁকি নিচ্ছে, তারা দ্রুতই এর পরিনতি ভোগ করবে। আজ ইহুদিবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক করার ভুল তাদের করা উচিৎ নয়। শুক্রবার তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ইসলামিক জিহাদের প্রধান জিয়াদ আল-নাখালা। তিনি বলেন, যারা ইহুদিবাদীদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের দিকে ধাবিত হয় তাদের অবশ্যই জানা উচিত যে, এর মধ্য দিয়ে তারা স্বীকার করে নেবে যে ফিলিস্তিন আমাদের নয়, জেরুজালেম ও তার মসজিদগুলো আমাদের নয়। 

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয়ার কারণে সৌদি আরবের অর্থনীতি এ বছর সঙ্কুচিত হবে। দেশটি এমন অবস্থায় বিদেশী বিনিয়োগের জন্য মরিয়া। তারা ইসরাইলের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও কামনা করছে। ইসরাইলের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার পর ২০২২ সালে তাদের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়ে ২.৫৬ বিলিয়ন হয়েছে। কিন্তু রিয়াদ এখন বেসামরিক পারমাণবিক শক্তির অ্যাক্সেস চায়।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আগামী সপ্তাহে একটি আঞ্চলিক সফরে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এখন হামাস যা করেছে তা একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। ফলে এর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হিসাবও পাল্টে গেছে। হামাস তার শক্তি দেখিয়েছে এবং গাজার বাইরেও তার ঘাঁটি প্রসারিত করেছে। ফলে সংঘাত সংকোচন না হয়ে আরও প্রসারিত হয়েছে।

হামাসের আক্রমণের পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় রিয়াদ উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানায়। হামাসের সঙ্গে সৌদির খুব কম যোগাযোগ রয়েছে। সৌদি আরব যেভাবে হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা ইসরাইলের জন্য সুখের ছিল না। সৌদি আরব আবারও দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে একটি বিশ্বাসযোগ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কাতার যদিও সরাসরি বলেছে যে, ইসরাইল পুলিশের সুরক্ষায় আল-আকসা মসজিদে সাম্প্রতিক বারবার অনুপ্রবেশ সহ ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের ক্রমাগত লঙ্ঘনের কারণেই হামাস হামলা চালাতে বাধ্য হয়েছে।

হামাসের হামলার পর থেকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন, ইইউর হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেল এবং উপসাগরীয় প্রতিটি দেশে সাথে কথা বলে চলেছেন। আসল কূটনৈতিক কাজ হবে গোপনে। স্বল্প মেয়াদে তুরস্ক ও মিসর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবে। দুই মাস পর মিশরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তারা এমন সময় গাজায় ধ্বংসজজ্ঞ চলতে দিতে চাইবে না। হামাসের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে এটা নিশ্চিত করা যে, ইসরাইল যেনো গাজায় হামলা চালাতে এখন থেকে দুই বার ভাবে। হামাসের আল-কাসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবাইদা বলেন, ইসরায়েলি বন্দীদের সংখ্যা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যা ঘোষণা করেছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাদের সঙ্গে সেটাই হবে, যেটা গাজার মানুষের সঙ্গে হয়েছে।

হিজবুল্লাহও মিশরের মাধ্যমে ইসরাইলকে গাজায় হামলার বিষয়ে সতর্ক করে বার্তা পাঠিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষ থেকে ইসরাইলকে উত্তেজনা কমাতে, স্থল হামলা বন্ধ করতে এবং হামাসকে আলোচনায় বাধ্য করার জন্য গাজার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার মতো পদক্ষেপের উপর নির্ভর করার আহ্বান জানিয়েছে। ইসরাইলের অভ্যন্তরেও শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা যখন হুমকিতে তখন একটি ইউনিটি গভার্নমেন্ট প্রয়োজন। এটি হলে নেতানিয়াহুকে আর ক্ষমতায় থাকার জন্য চরমপন্থীদের ওপর নির্ভর করতে হবে না।

অনেক ইসরাইলী এখন হামাসের হাতে বন্দি। এমন অবস্থায় প্রতিশোধ নিতে গেলে তাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। নেতানিয়াহু জানেন কীভাবে রাজনীতির খেলায় টিকে থাকতে হয়। তবে তিনিও নিজের ওপর থেকে দায় ঝেরে ফেলতে পারবেন না। ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের ছয় মাসের মধ্যে গোল্ডা মিরকে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হয়েছিল। এরপর ১৯৭৮ সালেই ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই মুহূর্তে যদিও সে ধরনের ইতিবাচক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা বেশ কম।

দ্য গার্ডিয়ান/ মানবজমিন