বাংলাদেশ ক্রনিক্যাল ডেস্ক: হামাস – ইসরাইল যুদ্ধ ধীরে ধীরে আঞ্চলিক যুদ্ধে রুপ নিচ্ছে। ইসরাইলকে সব ধরনের অস্ত্র- গোলাবারুদ সরবরাহ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে মার্কিন মেরিন সেনারা গাজায় অভিযানে যোগ দিতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া আরব বিশ্বের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্টীগুলো মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানার হুশিয়ারি দিয়েছে। এরমধ্যে ইয়েমেনের হুথি ও ইরাকের সশস্ত্র সংগঠনগুলোও আছে। হামাসের সাথে ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছে হিজবুল্লাহ। রাশিয়া, তুরস্ক ও চীন এই পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেছে।
এদিকে হামাসের হামলায় ইসরাইলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১২০০ হয়েছে বলে ইসরাইলি সম্প্রচার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আজ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলি দূতাবাস জানিয়েছে, হামলায় আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪১৮ জন মানুষ। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শনিবার ইসরাইল পাল্টা বিমান হামলা শুরু করার পর থেকে গাজা উপত্যকায় এখন পর্যন্ত আন্তত: ৯০০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ৫০০০ জন। তবে এটি প্রকৃত সংখ্যা নয়।
গাজায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় কোথায় কত লোক মারা গেছে তার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স ঘোষণা করেছে, তাদের বিমান হামলায় ফিলিস্তিনি অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী জোয়াদ আবু সামাল্লাহ ও হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা জাকারিয়া আবু মোয়াম্মার নিহত হয়েছেন। এছাড়াও গতকাল নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৪ জন জন সাংবাদিক রয়েছেন। গাজায় ইসরাইলি হামলায় এ নিয়ে মোট ৮ জন সাংবাদিক নিহত হলেন বলে গাজা উপত্যকার সাংবাদিক ইউনিয়ন জানিয়েছে।
এদিকে হামাস নতুন করে হামলা জোরদার করেছে। ইসরাইলের দক্ষিণ উপকূলীয় শহর আশকেলনে মঙ্গলবার রকেট হামলা চালিয়েছে হামাস। এর আগে শহরটির জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছিলো হামাস। তারা স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় আশকেলনে বোমা হামলা চালাবে বলে আগেই ঘোষণা দেয়।
হামাস সদস্যরা এখনও ইসরাইলের ভেতরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিন ইসরাইলের কাফর আজা এলাকায়ও ভারি মেশিনগানের গুলির শব্দ শোনা গেছে। ইসরাইলের ভেতরে যোদ্ধাদের লড়াইয়ের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে হামাস। কাফর আজায় ইসরাইলি সেনারা শহরটির সড়ক বন্ধ করে দিয়ে সেখানে হামাস যোদ্ধাদের ধরতে তল্লাশি চালায়। কিন্তু যুদ্ধ এখনও চলছে। গাজার সমুদ্রবন্দরে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে বেশ কিছু মাছ ধরা নৌকা সহ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকালে গাইডেড মিসাইল দিয়ে একটি ইসরাইলি ট্যাঙ্কে হামলা করেছে হিজবুল্লাহ। লেবাননের নিরাপত্তা সূত্রগুলো এ তথ্য জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, লেবাননের ভূখন্ড থেকে তাদের একটি সামরিক যান লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এছাড়া তাদের একটি সামরিক হেলিকপ্টার হিজবুল্লাহর নিয়ন্ত্রিত একপি মনিটরিং টাওয়ারের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। তবে এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কিনা সে ব্যাপারে কোন কিছু জানায়নি ইসরাইল সেনাবাহিনী।
লেবাননের দক্ষিন সীমান্ত থেকে ইসরাইল লক্ষ্য করে টানা তৃতীয় দিনের মতো রকেট হামলা করা হয়েছে। এর আগে লেবাননের গেরিলা গ্রুপ হিজবুল্লাহ ও ইসরাইল সেনাদের মধ্যে গোলা বিনিময় হয়েছে। এতে ইসরাইলের ৩০০ তম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডারসহ তিন জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে ইসলাইলের গোলা বর্ষণে হিজবুল্লাহর ৪ যোদ্ধা প্রান হারান।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে গাজায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে তাহলে তারাও মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহন করবে। হুথি বিদ্রোহীদের নেতা আব্দুল মালেক আল হুথি গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি গাজার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তার বাহিনীর যোদ্ধারাও এই অঞ্চলে মার্কিন সেনাদের উপর ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালাবে। তিনি আরো বলেন, প্রয়োজনে এই অঞ্চলের অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর সাথে সমন্বয় করে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছেন তারা। ইরাকের একজন রাজনীতিকও একই ঘোষণা দিয়েছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান গাজা উপত্যকা ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ বন্ধের উপায় নিয়ে মঙ্গলবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিয়োনে কথা বলেছেন। পরে ক্রেমরিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দুই নেতা ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত দ্রুত বন্ধ করা ও সংলাপ শুরুর উপায় নিয়ে কথা বলেছেন।
ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে যে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনের একমাত্র উপায় হচ্ছে দুই-রাষ্ট্র সমাধানে উপনীত হওয়া এবং জেরুসালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পুতিন আরো বলেছেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত এটাই প্রমান করেছে , মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মস্কো সফররত ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপকালে পুতিন এই মন্তব্য করেন।
এদিকে, আমেরিকান বার্তা সংস্থা এপি’র এক খবরে বলা হয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইসরাইলের জলসীমার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহি রণতরি পাঠানোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এধরণের পদক্ষেপ ফিলিস্তিনে গণহত্যার পথকে প্রশস্ত করবে। এছাড়াও তিনি ইসরাইলের গাজা অবরোধেরও সমালোচনা করে বলেন, এর ফলে ফিলিস্তিনিদের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে।
এরদোয়ান গতকাল মঙ্গলবার অষ্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহাম্মার সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্কব্য দেয়ার সময় এসব কথা বলেন। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘ইসরাইলে মার্কিন বিমানবাহি রণতরী কি করছে? কি জন্য সেটা এখানে এসেছে?’ এটি গাজার আশেপাশের এলাকায় হামলা করে অবরুদ্ধ এই এলাকায় মারাত্মক গণহত্যার পথই প্রশস্ত করবে বলে মন্তব্য করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।
হামাসের গত শনিবারের আকস্মিক হামলার জন্য ইসরাইল নিজেই দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। গতকাল মঙ্গলবার তিনি এই মন্তব্য করেন বলে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি গণমাধ্যম। খামেনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতা ও নিপীড়নের জবাব দিতেই এই হামলা চালিয়েছে হামাস। সফল এই হামলার জন্য হামাসকে অভিনন্দনও জানান তিনি। তবে হামাসের এই হামলার পরিকল্পনায় ইরানের সহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ইসরাইলের সামরিক এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণেই হামাস সফলভাবে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
খামেনি আরো বলেন, আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে আছি। তাদের স্বাধীনতা অর্জনের এই লড়াইকে পূর্ণ সমর্থন করি। ইহুদিরা নিজেরাই তাদের এই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। হামাসের যেসব যোদ্ধা ইসরাইলে হামলার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে তাদেরকে আমরা অভিবাদন জানাই। তাদেরকে নিয়ে আমরা গর্বিত।
হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘাতে উভয় পক্ষেই সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলার নিন্দা জানিয়েছে চীন। দেশটি সংঘাত বন্ধে অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির আহবান জানিয়েছে। চীনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত ঝাই জুন গতকাল এক বিবৃতিতে এই আহবান জানান। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ে এমন ধরণের তৎপরতার আমরা বিরোধিতা করি ও এর নিন্দা জানাই। চীন অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির আহবান জানাচ্ছে বলেও বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন।
ইসরাইলে হামাসের হামলায় গোয়েন্দা তথ্য এবং সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহযোগিতা করেছে কিছু ইসরাইলি সেনা সদস্য। ইরানের তাসনিম বার্তা সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন তথ্য জানিয়েছেন একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া ইসরাইলে ঢ়ুকে কীভাবে হামাস যোদ্ধারা এত বড় হামলা চালালো তা নিয়ে যখন নেতানিয়াহুর সরকার দিশেহারা, তখন চাঞ্চল্যকর এই তথ্য জানালেন ঐ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা সোমবার তাসনিম নিউজ এজেন্সিকে বলেন, অনেক দিন ধরেই ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সম্পর্ক রয়েছে কিছু ইসরাইলি সেনার সাথে। তাদের মাধ্যমে ইসরাইলের বহু গোপন ও স্পর্শকাতর তথ্য পেয়েছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। গত শনিবার অভিযান শুরুর পর ইসরাইলি সেনা ঘাঁটিগুলোতে সহজে ঢুকে পড়তে এসব গোয়েন্দা তথ্য অনেক কাজে লেগেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গোয়েন্দা তথ্যের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাদের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জামের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও পেয়েছে বলে জানান ঐ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা। ইসরাইলের হিব্রু ভাষার বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে ইরানি বার্তা সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, ইসরাইলি সেনাদের অনেকেই মাদকাসক্ত। বিশেষ করে রিজার্ভ সেনারা অনেক বেশি মাদক গ্রহণ করে। মাদক কেনার টাকার বিনিময়ে বা সরাসরি মাদকের বিনিময়ে তারা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের কাছে নিজেদের অস্ত্র বিক্রি করে।
২০১৯ সালের মে মাসে এক প্রতিবেদনে ইসরাইলি সংবাদপত্র মারিভ জানিয়েছিল, পশ্চিম গ্যালিলি অঞ্চলের একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে মাত্র এক মাসে ৪৬টি এম১৬ রাইফেল চুরি হয় যা পরে আর উদ্ধার করা যায়নি। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ৭ অক্টোবরের হামলায় একই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে।
ইসরাইলে হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনে উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধ করার ঘোষণা দেন ইউরোপিয়ান কমিশনার ফর নেইবারহুড অ্যান্ড এনলার্জমেন্ট ওলিভার ভারহেলি। গত সোমবার তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দকৃত ৬৯১ মিলিয়ন ইউরোর উন্নয়ন সহযোগিতা প্রদান স্থগিত করা হবে। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন । কমিশনার ভারহেলির এই ঘোষণার পর ইইউ’র কয়েকটি সদস্য দেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ওই কমিশনের নেই। এ খবর দিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ভারহেলির ঘোষণা দেওয়ার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর কমিশন একটি বিবৃতি প্রদান করে। এতে বলা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনকে খুব শিগগিরই কোনও অর্থ পরিশোধের সূচি না থাকায় তা স্থগিত করার প্রশ্নও উঠে না।
এদিকে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি জানিয়েছেন মিশর থেকে গাজার মধ্যে একটি মানবিক করিডোর খোলার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে।